skip to Main Content

এডিটরস কলাম I সময় আর মুক্তির অনুভব

যারা রসিক এবং আড্ডাবাজ, তারা সামাজিক ও উদার না হয়ে পারেন না

‘Time for you and time for me,
And time yet for a hundred indecisions,
And for a hundred visions and revisions,
Before the taking of a toast and tea.’

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে টি এস এলিয়ট রচিত ‘দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’ কবিতার এই অংশবিশেষ উদ্ধৃত করার কারণ আছে। তা এই, চা হলো একটা সময়, যা গ্রহণের আগে শত সিদ্ধান্তহীনতা, ভাবনা আর পুনর্ভাবনা এসে মস্তিষ্কে এসে ভিড় করে। তাহলে কি চা পানের সঙ্গে সঙ্গে সব মিটে যায়? আমার কখনো কখনো এমন হয়, মাথায় জট পাকিয়ে গেছে, ভাবনার গিঁট খুলতে পারছি না। তখন এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মীমাংসা বা সমাধান পেয়ে যাই। দিনের যেকোনো সময়। পানীয়টির জনপ্রিয় হয়ে ওঠার এবং অভ্যাসে পরিণত হওয়ার এটাই হয়তো রহস্য। এমনিতেই পড়ার জন্য যখন হাতে নিই কোনো বই, দেখার জন্য মুভি নির্বাচন করি, শোনার জন্য সুখকর কোনো গান— এক মগ চা আমার লাগবেই। এটা ¯্রফে পানীয় নয়, অভ্যাসের অনুষঙ্গও কেবল নয়; বিশেষ এক অনুভূতি, অভিজ্ঞতাও বটে। বলতে চাইছি, সহজলভ্য হলেও চা সাধারণ কিছু নয়। এমন কয়েকজন কবি-লেখককে আমি চিনি, যারা টেবিলে এক কাপ চা ছাড়া লেখার প্রস্তুতিই নিতে পারেন না।
দুই
কবি-লেখকদের প্রসঙ্গ যখন এল, কাজী নজরুল ইসলামের চা খাওয়া নিয়ে একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি ফরিদপুরে গিয়েছিলেন। উঠেছিলেন কবি জসীমউদ্্দীনের বাড়িতে। সম্মেলনের পর সবাই নজরুলকে আরও কিছুদিন সেখানে বেড়ানোর অনুরোধ করেন। শুনেই তিনি রাজি হয়ে যান। জানতে পারলেন, পদ্মার ওপারে একটি গ্রাম রয়েছে, যেখানে সন্ধ্যায় বাউলগানের আসর বসে। পরদিন সেই নদী পাড়ি দিয়ে জসীমউদ্্দীনসহ নজরুল গ্রামটিতে গেলেন। উদ্দেশ্য, রাতভর গান শোনা। উল্লেখ্য, চায়ে নজরুলের ভীষণ নেশা ছিল, পাশাপাশি পানও খেতেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গে গ্রামীণ জনপদে তখন পান মিললেও চা পাওয়া যেত না। মধ্যরাতে তার চায়ের নেশা চাপল। অস্থির হয়ে উঠলেন। সারা গ্রামে কারও বাড়িতে যখন এটি খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন জানা গেল, পাশের গ্রামের এক মাতবরের বাড়িতে চা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কলকাতা থেকে সেই ব্যক্তি কিছু চা-পাতা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তৈরির পদ্ধতি জানা না থাকায় অব্যবহৃত রয়ে গেছে। সেই বাড়ি থেকে চা নিয়ে আসা হলো এবং গভীর রাতে নারীরা তা ‘রান্না’ করতে বসলেন। আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ ইত্যাদি সহযোগে চা রান্না করা হলো। পাত্রভর্তি সেই তরলের চেহারা আর গন্ধে জসীমউদ্্্দীন হতভম্ভ! চায়ের তৃষ্ণায় অস্থির নজরুল পরম আগ্রহে সেই তরল পান করলেন এবং রায় দিলেন, ‘এই গাঁয়ের চা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চা!’।
তিন
ভুলভাবে তৈরি করা অদ্ভুত স্বাদের এই চা পানের পর নজরুল যে উক্তি করেছিলেন, তাকে রসিকতা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আমি অন্তত দেখি না; বরং তাতে প্রকাশিত হয়েছিল ব্যক্তিমানুষ হিসেবে নজরুলের উদারতা। সবকিছুকে সহজভাবে নেওয়ার বিরল মানসিকতা। আরেকটা কথা এখানে বলতে মন চাইছে। আমি দেখেছি, যারা নিয়মিত চা পান করেন, তাদের বেশির ভাগই আমুদে, প্রাণচঞ্চল, রসিক, আড্ডাবাজ। স্বভাবে উদারও বটে। আমার কাছে চা পান যতটা ব্যক্তিগত, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। ফলে চা-কে আমার অনেক সময় সামাজিক পানীয় মনে হয়। যারা রসিক এবং আড্ডাবাজ, তারা সামাজিক ও উদার না হয়ে পারেন না। এটা আমার পর্যবেক্ষণ।
চার
নোবেল বিজয়ী কবি টি এস এলিয়টের একটি পঙ্্ক্তি দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। ওই স্তবকে চা মানে সময়। এক বিশেষ পরিস্থিতিও বটে। যখন ব্যক্তির দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্নায়ুকে পীড়িত করে, যখন কোনো সিদ্ধান্তের জন্য সভা হয় এবং যখন বিষণœতা বা একাকিত্বে আমরা মুহ্যমান হয়ে যাই— এক কাপ চা তখন হয়ে ওঠে কাক্সিক্ষত সঙ্গীর সমকক্ষ। এর স্বাদে-গন্ধে সেই মুহূর্তে আমাদের চিন্তার আর অনুভবের মুক্তি ঘটে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top