skip to Main Content

ফিচার I বিসর্জনের হরেক রূপ

উৎসবের ইতি টানতেই এই পর্ব। রীতিটির চর্চা আজও দেখা যায়। প্রাচীন ইউরোপে বৃক্ষের ওপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছিল। সেই সূত্রে বিসর্জনের বিচিত্র আনুষ্ঠানিকতা চলত। লিখেছেন শিবলী আহমেদ

বিসর্জনের উৎস খুঁজতে গেলে ‘সর্বপ্রাণবাদ’ থেকে শুরু করতে হয়। আদিম মানুষের কল্পনা থেকে এই মতবাদের উদ্ভব ঘটেছিল। সমমর্মী ও সংক্রমণের জাদুচর্চা তাদেরকে জড় বস্তুর আত্মায় বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল। ফলে পাথর থেকে শুরু করে আকাশ-বাতাস—সবকিছুরই আত্মা রয়েছে বলে তারা মানত। তখন পৃথিবী ছিল অরণ্যেঘেরা। মানুষের নিকট প্রতিবেশী ছিল গাছ। ফলে বৃক্ষের ওপর আত্মা আরোপ করেছিল তারা। তবে সরাসরি নয়। গাছের নিজস্ব আত্মা কিংবা প্রাণ আছে—এই মতবাদে তারা পৌঁছুতে পারেনি; বরং বিশেষ কিছু বৃক্ষকে মনে করত মৃত মানুষের আত্মার বাসস্থান। নিজ গোত্রের যারা মারা গেল, তাদের আত্মা গাছে চড়ে বসবাস শুরু করত বলে ধারণা ছিল তখন। তবে সেই আত্মারা সব সময় বৃক্ষে বসে থাকত না। তারা নিচে নামত, ঘুরে বেড়াত, ইচ্ছা হলে জীবিত কারও ক্ষতি করত, কিংবা রোগাক্রান্ত করে মারত। এসব কারণে গাছবাসী সেসব আত্মাকে জীবিতরা ভীষণ ভয় পেত। ওগুলোকে বিরক্ত করতে চাইত না তারা; বরং নৈবেদ্য দিয়ে ওদেরকে খুশি রাখার তাগিদ বোধ করত। অন্যথায় আত্মাগুলো রেগে গিয়ে অনিষ্ট করে বসে যদি! এই ভীতি থেকেই ওসব তরু-আত্মার ওপর দেবত্ব আরোপ হতে থাকে। আদিম সমাজ থেকে এসব রীতি ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে প্রাচীনে এসেছে। এখনকার সমাজেও খোঁজ করলে এসব বিশ্বাসের প্রয়োগ মেলে। ঊনিশ শতকেও ছিল ওসব রীতি পালনের তোড়জোড়। তবে তা শুধু আদিবাসীদের মধ্যে। যেমন স্লেভ কোস্টের আদিবাসীদের বিশ্বাস, বিশেষ কিছু তুলাগাছে ‘বুন্টিন’ নামের এক দেবতা তথা আত্মা বাস করে। সেটির শান্তি নিশ্চিত করতে বৃক্ষটির নিচে মুরগি ও পাম তেল উৎসর্গ করে অর্চকেরা। কোনো কোনো গোত্রের বৃক্ষপূজারিরা মাঝেমধ্যে গাছে মই পেতে দেয়। নয়তো গাছ থেকে সেই আত্মা নেমে আসবে কীভাবে! বিসর্জন প্রথার সঙ্গে এসব বৃক্ষ ও গাছবাসী আত্মার সূক্ষ্ম যোগ রয়েছে।
ঊনিশ শতকের ইউরোপে আদিবাসী কৃষকদের যাপিত জীবনে লক্ষ করলে দেখা যায়, তারা গাছের আত্মার পূজা-অর্চনাবিষয়ক একটি উৎসব পালন করত। যেটি সম্পর্কে স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার তার ‘গোল্ডেন বাউ’ বইতে বিস্তারিত বলেছেন। উদ্ধৃত করেছেন ১৮৬২ সালে স্যার হেনরি পিয়ার্স রচিত ‘ডেসক্রিপশন অব ওয়েস্টমিথ’ বইয়ের কিছু বাক্য। গোল্ডেন বাউ বইটি বাংলা অনুবাদ করেছেন খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। অনুবাদক ইউরোপের কৃষকদের সেই গাছ-আত্মাবিষয়ক উৎসবের নাম দিয়েছেন ‘মে দিবস’। পার্বণটি হতো গ্রীষ্ম কিংবা বসন্তে। এই দিনে কৃষকেরা বন থেকে বিশেষ গাছের ডাল কেটে এনে বাড়িতে বেঁধে কিংবা পুঁতে রাখত। তারা মনে করত, এতে করে বৃক্ষ-আত্মার শক্তিতে তাদের বাড়িঘর ভরে উঠবে। তা ছাড়া গাছের ডাল বাড়ি বাড়ি ফেরি করে আত্মার শক্তির বণ্টন করত চাষিরা। রাশিয়ার গ্রামবাসীরা প্রায় একই ধরনের একটি উৎসব পালন করত। সেটির নাম ‘হুইটসানডে’। উৎসবের আগের বৃহস্পতিবার গোত্রের লোকেরা আমোদ করতে করতে বনে চলে যেত। কেটে আনত কচি বার্চগাছ। এসব বৃক্ষ বন থেকে বয়ে আনার ঘটনাও ছিল। এখনকার দেবদেবীরা যেমন কোনো না কোনো বাহনে চড়ে আসে, ওসব আত্মাধর বৃক্ষের ডালগুলোও বিশেষ বাহনে আসত। এ ক্ষেত্রে ১৫৮৩ সালে ফিলিপ স্টাবস রচিত ‘অ্যানাটমি অব অ্যাবিউসাস’ বইয়ে বর্ণিত ইংল্যান্ডের হুইটসানডে অনুষ্ঠানের কথা বলা যেতে পারে। তারা বন থেকে গাছের ডাল নিয়ে আসত গাড়িতে করে। তা সম্মিলিতভাবে টানত ২০ কিংবা ১৪টি বলদ ও ষাঁড়। মানে ওই বৃক্ষ-আত্মার বাহন ছিল গরু। তারপর ডালটিকে বাড়ি এনে সাজিয়ে পূজা-অর্চনা করা হতো। রাশিয়ান হুইটসানডেতে গাছকে সাজানো হতো নানান ফিতা ও বাহারি কাপড়ে। তারপর তিন দিন ধরে চলত পূজা। শেষে সজ্জিত গাছটি ফেলে আসা হতো খর¯্রােতা পানিতে।
ট্রানসিলভিনিয়া ও রোমানিয়ার জিপসিরা ‘জর্জ’ নামের একটি উৎসব পালন করত। পার্বণের আগের দিন তারা একটি উইলোগাছ কেটে আনত। তারপর সেটিকে লতাপাতা দিয়ে সজ্জিত করে মাটিতে পুঁতে দিত। পূজা-অর্চনা ও মানত করত। পূজারিরা তিনটি পেরেক সেই উইলোগাছে ঠুকত। পরে সেগুলো তুলে স্রোতোস্বিনী পানিতে ছুড়ে ফেলত। শেষে উইলোগাছের কুশপুত্তলিকাটিও পানিতে বিসর্জন দেওয়া হতো।
বোহেমিয়ার একটি জনপদ শুক্লেনাউ। সেখানকার কিছু লোকজনের মধ্যে ঊনিশ শতকে এক প্রকার বিসর্জনরীতি দেখা যেত। তারা একটি কৃত্যাচার করত। তাতে একজনকে জংলি সাজে সাজাত গ্রামবাসী। তার ভেতরে পুরে দিত রক্তের মতো রঙে ভরা থলে। পরে জংলি লোকটিকে গ্রামের নানান অলিগলি ঘুরিয়ে একটি নির্দিষ্ট পথে তাড়িয়ে আনা হতো। সেই রাস্তার শেষে থাকত দড়ি বাঁধা। ফলে তাড়া খেয়ে জংলি লোকটি তাতে পা পেঁচিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ত। পতনমাত্রই অন্যরা তার ওপর চড়াও হতো এবং খুঁচিয়ে থলেটি ছিদ্র করে দিত। জংলি লোকটি রক্তপাতে মৃত্যুর অভিনয় করত। পরের দিন তাকে খাটিয়ায় চড়িয়ে নেওয়া হতো জলাশয়ের কাছে। সেখানে বাহনসহ তাকে ছুড়ে ফেলা হতো। এই পার্বণের নাম ‘প্রমোদ উৎসবের বিসর্জন’।
আধুনিক সভ্যতার মধ্যলগ্নে পূজ্যকে পানিতে বিসর্জন দেওয়া ছাড়াও আগুনে পুড়িয়েও বিলীন করার রীতি দেখা যেত। বোহেমিয়ার কিছু অঞ্চলে ‘সেন্ট জন’ পার্বণের সন্ধ্যায় বন থেকে ছেলেরা লম্বা লম্বা ফার কিংবা পাইনগাছ কেটে এনে গ্রামের উঁচু কোনো স্থানে স্থাপন করত। তারপর গ্রাম্য তরুণীরা সেটিকে ফুলের তোড়া, মালা ও লাল ফিতা দিয়ে সাজাত। আনন্দ উৎসব শেষ হলে তারা গাছটিকে পুড়িয়ে ফেলত। এভাবেই হতো তাদের পূজ্য বৃক্ষ-আত্মার বিসর্জন।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top