skip to Main Content

যাপনচিত্র I ‘শিরায় শিরায় গাঢ় অন্ধকার’

সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন। ‘বেসবাবা’খ্যাত কিংবদন্তি রকস্টার। ‘অর্থহীন’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, বেজিস্ট, লিরিসিস্ট ও ভোকালিস্ট। ‘অদ্ভুত সেই ছেলে’, ‘চাইতেই পারো’র মতো তুমুল জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে মাতিয়েছেন অসংখ্য কনসার্ট। ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে আবারও ফিরেছেন গানে; তবু মিউজিক তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি নয়

‘জোছনায় অজানা পথে চলা’
২০১২ সাল। মেরুদন্ডে ক্যানসার ধরা পড়ল ‘বেসবাবা’ সুমনের। ডাক্তার জানালেন, স্টেজ ওয়ান। ভয় নেই তেমন। তবু গাঢ় অন্ধকার এই রকস্টারের চোখে-মুখে। টানা দুই সপ্তাহ নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষে খুঁজে পেলেন আত্মবিশ্বাস। মেরুদন্ড থেকে অপসারণ করা হলো দুটি টিউমার। ডাক্তারের পরামর্শে এর ছয় মাস পর রুটিন চেকআপ শেষে জানলেন ক্যানসার থেকে মুক্তির সুসংবাদ। আত্মবিশ্বাসে টগবগে সুমন তখন যেন দাপুটে ঘোড়ার মতো ছুটছিলেন। কে জানত, সহসাই ফিরে আসবে এই মরণব্যাধি, ভয়াবহ রূপে!
২০১২ সালের শেষ বা ২০১৩ এর শুরুর দিকে পাকস্থলীতে ক্যানসার ধরা পড়ে সুমনের; স্টেজ থ্রি-বি। পাকস্থলীর ৮৫ ভাগ কেটে ফেলে দেন চিকিৎসক। চলে কেমোথেরাপিসহ আনুষঙ্গিক চিকিৎসা। খাদ্যরসিক এই রকস্টারের শুরু হয় অজানা পথে চলার নতুন লড়াই। প্রাথমিকভাবে জিতেও যান। কিন্তু আরও বিপৎসঙ্কুল পথ যেন ছিল অপেক্ষায়। ২০১৬ সালে ক্যানসারটি ফিরে আসার লক্ষণ দেখা দিলে, বাকি থাকা সেই ১৫ ভাগ পাকস্থলীও কেটে ফেলতে হয়। সেই থেকে বেসবাবার শরীরে কোনো পাকস্থলী নেই।
‘যাচ্ছে চলে সবকিছু আজ অনেক দূরে’
‘আমি খাই কীভাবে? খাবারটা আসলে খাদ্যনালিতে যায়। তাই বেশি কিছু খেতে পারি না। খাদ্য গেলে খাদ্যনালিটা ইলাস্টিকের মতো ফুলে যায়। আমার খাদ্যনালি তাই একটু ফোলা’ বলেন সুমন। আরও বলেন, ‘আমার শিরদাঁড়া এখনো ভাঙা। যখন স্পাইনের খুবই খারাপ অবস্থা ছিল, তিন বছর বিছানায় একদম শোয়া ছিলাম। বসতে পারতাম না। দাঁড়াতে পারতাম একটু। স্পাইনের হাড্ডির একটা টুকরো ভাঙা অবস্থায় এখনো পড়ে আছে, বসতে চাইলেই সেটার ঘষা লেগে অসম্ভব যন্ত্রণা হতো। একটা মানুষ যদি আক্ষরিক অর্থেই তিন বছর শোয়া অবস্থায়, একটুও না হাঁটে, সারা দিন খেতে থাকে, তার কী হওয়ার কথা? আমিও অসম্ভব মোটা হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যখন হাসপাতালে গেলাম, আমার স্পাইনে সিভিয়ার ট্রিটমেন্ট হয়, আলটিমেটলি সুস্থ হয়ে উঠি। তবে ডাক্তার বলে দিয়েছেন, “হাড্ডির ভাঙা টুকরোটা একটা জায়গায় আছে, আমরা ওটাকে কোনোমতে একটুখানি সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে ওজন কমাতে হবে। হাঁটতে পারবে, তবে এক্সারসাইজ করতে পারবে না; সাঁতরাতেও পারবে না আপাতত। খাবার কমিয়ে দিতে হবে।”’
না খেয়ে তো বাঁচা সম্ভব নয়। পুষ্টিবিদের পরামর্শমতে ফাইবার ক্যাসপুল, মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল ধরনের বিভিন্ন ফুড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ শুরু করেন বেসবাবা। স্বাভাবিক খাবার বলতে শুধুই চা আর সামান্য টোস্ট বিস্কিট। আঁটসাঁট ওই খাদ্যতালিকায় দু-এক দিন পর পর পিৎজা, সুসি বা সাশিমির মতো নিজের খুব প্রিয় কোনো খাবারের অতি সামান্য অংশ চেখে দেখেন তিনি। বলেন, ‘যখন থেকে পিৎজা, সুসি বা সাশিমি খাওয়া শুরু করেছি, তখন থেকে সুগার একেবারেই অফ করে দিয়েছি, যেন মোটা হয়ে না যাই। গত চার মাসে এক ফোঁটা মিষ্টিও খাইনি।’ ডাক্তারের পরামর্শে এভাবেই সাড়ে পাঁচ মাসে ৩৫ কেজি ওজন কমিয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছেন তিনি। ‘আমার খাদ্যাভ্যাস খুবই উইয়ার্ড। অনুরোধ করব, কেউ যেন ফলো না করে,’ বললেন খানিকটা হেঁয়ালিতে। দীর্ঘ লড়াই শেষে আবারও কর্মব্যস্ততায় ফিরতে পেরে তিনি দারুণ খুশি।
‘আবার আমি উঠে দাঁড়াই’
‘অনেকের ধারণা, আমি প্রফেশনাল মিউজিশিয়ান। আসলে তা নই। মিউজিক আমার প্যাশন। আমি মূলত বিজনেসম্যান। ফ্যামিলি বিজনেস আছে। তাই আমাকে কাজ করতে হয়। সব সময় যে অফিসে যেতে হয়, তা নয়। বাসায় থেকেও কাজ করি; কখনো অফিসে যাই, কখনো আবার ফ্যাক্টরিতে,’ বললেন বেসবাবা। দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন, তার কাছে ব্যবসা ও পরিবারের গুরুত্বই সবার আগে; মিউজিকের অবস্থান তৃতীয়। তবে ব্যবসা কিংবা পরিবারের বিষয়টি একেবারেই একান্ত ব্যক্তিগত বলে সে ব্যাপারে জনসমক্ষে বিস্তারিত কিছু জানাতে তিনি অনিচ্ছুক। ‘অর্থহীন’-এর হাল-হকিকত সম্পর্কে বললেন, ‘প্রতিদিন রিহার্সাল করি—ব্যাপারটা সে রকমও না। সপ্তাহে বড়জোর দু-তিন দিন একসাথে জড়ো হই। যদি গান বানানোর বা স্টুডিওতে বসার ব্যাপার থাকে, সেই সময়টায় বসি আমরা। তা ছাড়া এখন ডিজিটাল যুগে পাশাপাশি না বসলেও চলে।’
অসুখের আগে সুমন ইচ্ছেমতো রাত জাগতেন, বেলা করে উঠতেন ঘুম থেকে। বদলে গেছে সেই রুটিন। বললেন, ‘ইউজুয়ালি ঘুম থেকে উঠি সাড়ে নয়টার দিকে। প্রথমে উঠেই বুঝতে হয়, সারা দিন কী কাজ আছে? অফিসে যেতে হবে নাকি? সেটার ওপর ডিপেন্ড করে অন্য জিনিসগুলো। এর মধ্যে কনসার্ট থাকলে ‘অর্থহীন’-এর পেছনে এক্সট্রা যে সময় দিতে হয় ব্যবসা ও পরিবারকে সময় দেওয়ার দায়িত্ব পালন শেষে, সে ক্ষেত্রে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত দুইটা-তিনটা বেজে যায়। তবু উঠি সেই একই সময়ে। তবে এমনিতে আমার স্ট্রেট ফরোয়ার্ড রুটিন হচ্ছে রাত ১২টার মধ্যে ঘুমোতে যাওয়া। ৯ ঘণ্টা ঘুম আমার এই বয়সের জন্য যথেষ্ট বলেই মনে করি।’
‘আমার শরীরজুড়ে বৃষ্টি নামে’
‘যেহেতু চাকরি করি না, বিজনেস করি, ফলে সাপ্তাহিক ছুটির ব্যাপারটা নেই। হয়তো সপ্তাহের মাঝখানে কোনো দিন ছুটি কাটাই। কোনো কোনো সপ্তাহে চার দিন ছুটি নিয়ে বসে থাকি। কোনো কোনো সপ্তাহে হয়তো এক দিনও পাই না। এটা আসলে আগে থেকে ঠিক করে রাখা যায় না,’ বললেন সুমন।
তবু এমন ছুটির দিন পেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, টিভি দেখেন, খেলেন গেমস। বললেন, ‘আই অ্যাম আ বিগ ফ্যান অব পিসি গেমিং। আমি মুভি ফ্রিক। মুভি দেখি। টিভি সিরিজ দেখি। কোনো কোনো দিন ওটিটির কোনো সিরিজ হয়তো ১০-১২ এপিসোড একটানা বসে দেখে ফেলি। আসলে আমি যদি কোনো জিনিসের মধ্যে ঢুকি, ধরুন পিসি গেম খেলছি—তখন টের পাই না কখন দুপুর বা বিকেল বা রাত হলো। একটা কিছু যদি এনজয় করতে থাকি, তখন কোনো প্রহরকে আলাদাভাবে দেখা হয় না। এমনকি মিউজিক করার সময়ও। ‘অর্থহীন’-এর অ্যালবাম যখন করেছি, এমনও হয়েছে, কাজ ধরার তিন-চার দিন পর আমরা স্টুডিও থেকে বের হয়েছি। এর মাঝখানে একেকজন ব্যান্ড মেম্বার হয়তোবা তিন-চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। একজন ঘুমাচ্ছে স্টুডিওর এক রুমে, আরেক রুমে আমি কাজ করছি, আরেক রুমে শিশির কাজ করছে, যখন রাফা ছিল—সে আরেকটা রুমে রেকর্ডিং করছে…হুলস্থুল অবস্থা। কাজের মধ্যে থাকলে দুপুর বলি বা রাত বলি, ওই ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে থাকে না অ্যাকচুয়ালি।’ অবশ্য, যদি প্রহর টের পান আর অবসর থাকে হাতে, তাহলে সন্ধ্যাটা কফি হাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেন।
‘এক মুঠো গোলাপ আর ঐ নীল আকাশ’
ক্যানসার থেকে সেরে ওঠার আগে এই অসুখের কথা ভক্ত বা গণমাধ্যম তো দূরের কথা, পরিবারকেও জানতে দেননি বেসবাবা। বললেন, ‘ক্যানসার থেকে যখন বেরিয়ে এসেছি, তখনো পরিবার জানত না, কেউ জানত না। পরে জেনেছে। ওটা থেকে সুস্থ হওয়ার পর উপলব্ধি করেছি, এখন থেকে যে জীবন কাটাচ্ছি, এটা স্রষ্টার দেওয়া বিশেষ উপহার—বোনাস লাইফ। তখন থেকে জীবনকে অন্যভাবে দেখা শুরু করেছি: যেহেতু বেঁচে আছি, নিশ্চয়ই এর কোনো পারপাস আছে। এখন আমি সবকিছুই ইতিবাচকভাবে দেখি।’
 রুদ্র আরিফ
ছবি: রনি বাউল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top