skip to Main Content

এডিটরস কলাম I জেন্ডার ইকুয়ালিটি টেকসই আগামীর জন্য

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

নারী। অভিধান ঘাঁটলে এ শব্দের অর্থ দাঁড়ায়—মানবী, মনুষ্যা, রমণী, নন্দিনী, আওরাত, জেনানা, অবলা, ভাবিনী, অন্তঃপুরবাসিনী, অপরাজিতা…আরও কত কী! শুধু আভিধানিক অর্থে এর মাহাত্ম্য কিংবা ব্যাপ্তিকে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়; উচিতও নয়। নারী যেকোনো পর্যায়ে, যেকোনো পরিচয়ে, যেকোনো মানুষের জন্য জীবনযাত্রার এক অনিবার্য সহযাত্রী। সামাজিক প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে, পশ্চাৎপদ মানসিকতায় অনেক ক্ষেত্রেই যদিও নারীর মর্যাদাকে করা হয় হেয়; তবু প্রকৃত অর্থে কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে নারী কোনো অংশে কম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে বেশিই বরং। সাংস্কৃতিক ভাণ্ডারে নজর দিলে দেখা যায়, প্রচলিত মানসিকতার বিশ্লেষণে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের নাম রেখেছেন ‘দেবী ও দানবী’। সেখানে তিনি লিখেছেন, পুরুষের কাছে নারী চিরদিনই এক অশেষ অস্বস্তির নাম। নারীকে পুরুষ কখনো মহীয়সী, আবার কখনো পাপাচারী হিসেবে গণ্য করার মাধ্যমে বহুকাল ধরে নিজ স্বার্থে ক্রমাগত অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন করে এসেছে। অন্যদিকে, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির তার ‘সূর্যকন্যা’ চলচ্চিত্রে অ্যানিমেশনের সাহায্যে দেখিয়েছেন, আদিকালে নারীশাসিত সমাজে কীভাবে কিছু চতুর পুরুষ তাদের রানিকে বন্দি করার মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থে নারীকে অবরুদ্ধ রাখার ফন্দি এঁটেছিল। তাদের সেই কূটকৌশলই কর্তৃত্বপরায়ণ ও লৈঙ্গিক বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘটিয়েছে প্রতিষ্ঠা। নারী ও পুরুষের মধ্যে বানোয়াট বিভেদের দেয়াল তুলে এখনো জগৎজুড়ে সেই বৈষম্যের চর্চা চলমান। সেই সব বৈষম্য কিংবা বিভেদের প্রসঙ্গ আপাতত থাক; বরং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙ্ক্তির আশ্রয় নিয়ে চলুন আরও একবার বলি: ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

দুই
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বছরের একটা দিন আলাদা করে নারীদের জন্য বিশেষভাবে উদযাপনের প্রয়োজন কতটুকু—এ নিয়ে প্রায় প্রতিবছরই একধরনের আলোচনার উদ্রেক ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ যুগে একদিকে যেমন ভাইরালপ্রবণ লোকজন এ নিয়ে নানা হাসি-তামাশা-টিপ্পনীতে মেতে ওঠে, অন্যদিকে কোনো কোনো জাঁদরেল নারীবাদীকেও দেখা যায় এই বিশেষ দিবসের বিরোধিতা করে রাশভারী কথা বা ভাবনার বিস্তার ঘটাতে। বিতর্ক চলে, চলুক; আমরা বরং এই ফাঁকে ইতিহাসে একটু ঢুঁ দিতে পারি। মূলত দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে এবং তাদের অবদানের প্রশংসা করতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উদ্ভব। ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তৎকালীন সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার নেতৃত্বে পোশাকশ্রমিকদের কাজের সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে শুরু হয় ধর্মঘট। নারীদের জন্য নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কাজ এবং পুরুষের সমতুল্য বেতন দেওয়ার দাবি রেখে চলে হরতাল। পরের বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষে আয়োজিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন আয়োজিত হয়। যোগ দেন ১৭ দেশের ১০০ নারী প্রতিনিধি। সেই সম্মেলন থেকে প্রতিবছরের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন ক্লারা। এই প্রস্তাবে সাড়া পড়ে যায় দুনিয়াজুড়ে। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে লেগে যায় ৬ দশকের বেশি। ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ।

তিন
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি টুডে ফর আ সাসটেইনেবল টুমরো’। সহজ বাংলায়, আজকের লৈঙ্গিক সমতাই দিতে পারে টেকসই আগামীর নিশ্চয়তা। জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ইউএন উইমেন’ জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও যথাযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সবার জন্য আরও বেশি টেকসই আগামী তৈরির নেপথ্যে দুনিয়াজুড়ে নেতৃস্থানীয় অবদান রাখা নারীদের চিহ্নিতকরণ এবং সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই এই থিম নির্ধারণ করা হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতা সুনিশ্চিত করা একুশ শতকের পৃথিবীতে অন্যতম প্রধান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। কে না জানে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনা ও সাসটেইনেবিলিটি আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে; ভবিষ্যতেও ফেলবে। অসহায় ও প্রান্তিক মানুষের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। জাতিসংঘের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল পুরুষের তুলনায় নারীর ওপর তুলনামূলক বেশি পড়ছে। কেননা, তারা তুলনামূলক বেশি দারিদ্র্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এবং বৈষম্যের কারণে অন্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং একে প্রশমিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ও শক্তিশালী নেতৃত্বদানকারী এবং চেঞ্জ-মেকার হিসেবে নারীরা ভীষণ জোরালো ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন টেকসই পদক্ষেপ নিয়ে এবং তুলনামূলক কার্যকর ক্লাইমেট অ্যাকশন গ্রহণ করে ইতিমধ্যেই নিজেদের মেধার প্রমাণ রেখেছে তারা। তাই টেকসই উন্নয়ন ও ব্যাপক লৈঙ্গিক সমতা সুনিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন ও সাসটেইনেবিলিটি-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। এককথায়, আজকের দিনে যদি লৈঙ্গিক সমতা না থাকে, তাহলে টেকসই কিংবা সমতার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা আগামীর জন্য হয়ে উঠবে দুরূহ।

চার
টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সমতার চর্চা শুরু করা যেতে পারে পরিবার থেকেই। আমরা যদি নিজ নিজ পরিবারের দিকে তাকাই—জননী, স্ত্রী, কন্যা, দাদি, নানি—যে পরিচয়েই থাকুক নারী, তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে শিখি, সেটি পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে শুধু জাতীয় পর্যায়েই নয়, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও বয়ে আনবে টেকসই সুফল। যদি কাঁধে কাঁধ রেখে পথচলার চর্চা করি, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিরাট সংকটও সামাল দেওয়া আমাদের পক্ষে হয়ে উঠবে তুলনামূলক সহজ। আর তাতে বেঁচে যাবে ধরিত্রীমাতা, বেঁচে যাবে মানবসভ্যতা।
নামকরণের সীমারেখায় আটকে থাকার দিন নয় এটি, বরং ‘নারী দিবস’-এর ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। নারী শব্দ তার আভিধানিক অর্থের ঘেরাটোপ পেরিয়ে সমগ্র মানবজাতির উপমায় পরিণত হওয়ার উপলক্ষ। নারীর জয় হোক। জয় হোক সব মানুষের। জয় হোক মানবসভ্যতার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top