skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I পরাজয় তার সিলেবাসেই ছিল না

আলী যাকের [৬ নভেম্বর ১৯৪৪—২৭ নভেম্বর ২০২০]। বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা। জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস সামনে রেখে প্রয়াত এই কিংবদন্তিকে নিয়ে লিখেছেন তার পুত্র ও অভিনেতা ইরেশ যাকের

আমার কন্যার বয়স এখন দুই বছর নয় মাস। প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস শেখে, নতুন নতুন কিছু করে। বাবা হওয়া এক অদ্ভুত অনুভূতি। যখনই মনে হয় এই মানুষটিকে আমি এর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারব না, তখনই ভুল প্রমাণিত হই। এই স্বপ্নের যেন কোনো শেষ নেই।
তবে হ্যাঁ, বাবা হওয়া সহজ কাজ নয়। মেহা আমাকে যে রকম অন্ধভাবে ভালোবাসে, আমার প্রতি তার যে অগাধ আস্থা, যে অপরিসীম বিশ্বাস—তার প্রতিদান আমি কীভাবে দেব? ভালো লাগা, ভালোবাসার বাইরেও অনেক সময় একটা সংশয় কাজ করে। যত দূর বুঝি, বাবা হওয়ার একটা বড় অংশ নিজের সন্তানকে এই সংশয় বুঝতে না দেওয়া। সন্তানের চোখে নিজের এই শক্তিশালী অবয়ব ধরে রাখা। এই কাজটা আমার বাবা আলী যাকের খুব ভালো পারতেন।

আলী যাকেরের প্রিয় চেয়ার

বাবাকে ছাড়া আমার দ্বিতীয় বাবা দিবস। অনেকে বলেন, প্রতিদিনই বাবা-মা দিবস। যে রকম প্রতিদিনই ভালোবাসার মানুষের দিবস। একদিক দিয়ে এটা সত্য, আবার অন্যদিক দিয়ে একটা বিশেষ দিনে ভালোবাসার মানুষগুলোকে একটু বেশি করে মনে করতে পারলে, ভালোবাসাটাকে একটু বেশি করে উদযাপন করতে পারলে খারাপ কি?

তবে যে কথায় ছিলাম। বাবার শক্তি। অথবা আমাদেরকে তার দুর্বলতাগুলো বুঝতে না দেওয়ার ক্ষমতা মাঝে মাঝে মনে হয় অসীম। বাবা এমনিতেই খুবই ভালো অভিনেতা ছিলেন। কিছুদিন আগে তারিক আনাম ভাই [অভিনেতা তারিক আনাম খান] বললেন, বাবার অভিনয়শক্তির একটা বড় কারণ তার বিশ্বাস। বাবা যে ভূমিকাতেই অভিনয় করতেন, সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে করতেন। বাস্তব জীবনে বাবা চরিত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে ছোট ছোট অনেক ঘটনা মনে পড়ে।
বাবার শক্তি আমি হয়তো সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পেরেছি তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে। যখন বাবা ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। একদিন সিঙ্গাপুরে। তখন বাবার দ্বিতীয়বারের মতো কেমোথেরাপি চলছে। হাসপাতালের নবম তলায় ডাক্তার দেখিয়ে দশম তলায় থেরাপিতে যেতে হবে। বাবার এমনিতেই পায়ের সমস্যা, তাই হাঁটতে কষ্ট হতো। তার ওপর ক্যানসারের কারণে তত দিনে বাবা প্রায় পুরোটা সময়ই হুইলচেয়ারে থাকতেন। শরীর অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এদিকে আমরা লিফট পাচ্ছি না। যতবারই নয়তলায় থামে, লিফট ভর্তি মানুষ। এদিকে কেমোথেরাপির সময় হয়ে আসছে। আমি একসময় ঠাট্টা করে বললাম, ‘চলো, সিঁড়িতে হেঁটে যাই।’ বাবা বললেন, ‘চলো যাই!’ আমি বললাম, ‘পাগল নাকি?’ তিনি বললেন, ‘না, আসলেই চলো।’ ওই অবস্থায় হেঁটে হেঁটে উঠলেন তিনি। সেটাই সম্ভবত তার শেষ সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। কোনো একদিন সুযোগ হলে আমি ওই সিঁড়ির একটা ছবি তুলে রাখব।
আরও পরের কথা। বাবা চলে যাওয়ার এক মাস আগে আমরা রতনপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেলাম। তত দিনে বাবা ক্যানসারের শেষ স্টেজে। বাড়ির বাইরে, উঠানে বসে আছি। বাবা আমাকে দেখে বললেন, ‘তোমার ফিগারটা সুন্দর হয়েছে। আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি; ঢাকায় গিয়ে জিম করতে হবে।’ কতটা আত্মবিশ্বাস, কতটা বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকলে একটা মানুষ এটা বলতে পারে! সত্যি বলতে, এত বড় একটা অসুখের পরও বাবাকে কখনো বলতে শুনিনি তার কষ্ট হচ্ছে। একবারও বলতে শুনিনি, ‘আমার কষ্ট হচ্ছে।’ একবারও বলেননি, ‘আমি এই রোগের সঙ্গে লড়াই করে পারব না।’ পরাজয় তার সিলেবাসেই ছিল না; বরং মাঝেমধ্যে যখন আমি বা আমার বোন ভেঙে পড়তাম, বাবা উল্টো আমাদের সান্ত¡না দিতেন। বলতেন, ‘আমি তো আছি।’ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করত, ‘কিন্তু তুমি তো থাকবে না!’ ভাগ্যিস, বলিনি।

ইরেশ যাকের

সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা খুব একটা আবেগের কথা বলেন না। তবে বাবা চলে যাওয়ার দু-তিন দিন আগে আমরা যখন শেষবারের মতো বাবার ডাক্তারের সঙ্গে অনলাইনে কথা বললাম, উনি আমাদেরকে বললেন, একটা মানুষ মানসিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী না হলে এত দিন এই রোগের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন না। ক্যানসার চিকিৎসার চার বছর বাবার সঙ্গে থেকে সেদিন আমি আসলেই টের পেয়েছিলাম, বাবার যুদ্ধ ঠিক কতটা কঠিন এবং কতটা গৌরবময় ছিল। যুদ্ধ চলছে জানতাম; কিন্তু এত বড় যুদ্ধ যে চলছে, বাবা কখনোই আমাকে বুঝতে দেননি। বাবার মতো সাহসী হয়তো আমি কখনোই হতে পারব না। কিন্তু আমার কন্যা মেহার জন্য আমার বাবার বীরত্ব একটু হলেও নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে।
বড় বড় ব্যাপার তো আছেই, তবে চলে যাওয়ার পরে কেন যেন ছোট জিনিসগুলো বেশি মনে পড়ে। বাবা যদিও খেতে ভালোবাসতেন, বাইরের থেকে খাবার আনানোর ব্যাপারে তিনি তেমন পারদর্শী ছিলেন না। ওই কাজ আমি, আমার বোন বা মা-ই করতাম। বাইরের খাওয়া বলতে তিনি একমাত্র আনাতেন পিৎজা। কিছুদিন পরপরই ফোন করে বলতেন, ‘আজকে তোমরা চলে এসো, আমি পিৎজা আনিয়েছি।’ আর প্রতিবার একই জায়গা থেকে ওই একই পিৎজা। বড়ই সরল ছিলেন আমার বাবাটা!
প্লেনে উঠে বাবাকে কখনো সিনেমা দেখাতে পারিনি। বসে বসে প্লেনের ফ্লাইট পাথ দেখতেন। আমি কিছুদিন আগে অনেক দিন পর প্লেনে উঠলাম। প্লেনের টেলিভিশনের পর্দায় ফ্লাইট পাথ দেখে বাবার কথা খুবই মনে পড়ল। বাবা হয়তো এখন কোথাও থেকে আমার আর মেহার ফ্লাইট পাথ দেখছেন—ভাবতে ভালো লাগে। আবার মন খারাপ হয়। বাবা ছাড়া আমার যাত্রা বড়ই একা লাগে মাঝে মাঝে।
বাবা দিবসে সকল বাবার প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top