skip to Main Content

ফিচার I সকাল বেলার রোদ্দুর

মর্নিং ওয়াক। এক দারুণ অভ্যাস। না থাকলে আজই গড়ে তুলুন

গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস বলেছিলেন, সমুদ্রপাড়ে দাঁড়ালে মানুষের মন বড় হয়ে যায়। কথাটা কতটা সত্য, তা জানতে হলে গিয়ে দাঁড়ান না একবার সৈকতে! আর এই দাঁড়ানো যদি হয় দিনের প্রথম আলোয়, তবে তো কথাই নেই। দেখবেন, মনটা কেমন বড় হয়ে যাচ্ছে। বাঁধ ছেড়ে দিলে পানি যেমন তুমুল গতিতে ছুটে চলে, ঠিক তেমনি মনটা দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে যাবে। গাড়ির চাকার মতো। সামনের দিকে।
বাতাস মাঝেমধ্যে গতি পাল্টায়। পাহাড় বা দালানের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে যায়। কিন্তু সকালের আলোয় সাগরপাড়, নাগরিক পার্ক কিংবা ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া মনের চাকা গতি পাল্টাবে না কখনো। পেছনে ছুটবেও না। কেবলই এগিয়ে দেবে আপনাকে। কেননা সকালের সূর্য সোনা রং নিয়ে পৃথিবীর পথে নামে। ধীরে ধীরে রাঙিয়ে যায় ঘুণে ধরা সব রং। মানুষের মনের রঙেও লাগিয়ে দেয় নতুন দোলা।
মর্নিং ওয়াকে বের হওয়া আপনার তারুণ্য মনে দিয়ে যায় নভোযানের গতি। সেই গতিতে আপনি সারা দিন ছুটে চলেন ফুরফুরে! আর যারা সকালের সোনা রোদ গায়ে মাখতে শেখেননি, তারা দিনে রোদের পাড়ে দাঁড়িয়েও ওল্টান মন খারাপের পাতা; শুনে যান কান্নার ইতিহাস!
তাই সূর্য যখন মুক্ত বাতাসের সঙ্গে চুক্তি করে সকালের সোনা রোদ বিলিয়ে যায়, তখন মুখ থুবড়ে শিকড় কাটা লাউয়ের ডগার মতো বিছানায় পড়ে না থেকে বেরিয়ে পড়–ন। না হয় পিছিয়ে পড়বেন; শারীরিক ও মানসিকভাবে, এমনকি জীবনের রেসে। আপনার পাশে বেড়ে ওঠা মানুষের চেয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিতেই বেরিয়ে পড়–ন মর্নিং ওয়াকে। মুক্ত বাতাসে বড় নিশ্বাস নিয়ে সাজিয়ে নিন দিনের কর্মপরিকল্পনা।
মর্নিং ওয়াকের উপকারিতা, প্রয়োজনীয়তা ও সময় নিয়ে কথা হয় দুই বিশিষ্ট চিকিৎসক সজল আশফাক ও মিজানুর রহমান কল্লোলের সঙ্গে। তাদের মতে, সব ধরনের ব্যায়ামের মধ্যে শরীরের জন্য সবচেয়ে উপকারী মর্নিং ওয়াক। রোজ সকালে ২০ থেকে ৩০ মিনিট টানা হাঁটার অভ্যাস আছে অনেকেরই। যাদের নেই, তাদেরও গড়ে তোলা উচিত এই অভ্যাস। কারণ, প্রতিদিন সকালে মাত্র ২০-৩০ মিনিট হাঁটলে শরীরের সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল হওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিনের কাজ করার শক্তি মজুত করা যায়।
চলুন, এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কথার আরেকটু গভীরে ডুবি—
কাজের চাপেও মুচকি হাসি
অফিস কিংবা ক্লাসে অনেকেই পাশের মানুষটি দেখে অবাক হন। ভাবেন, কই পান তিনি এত এনার্জি! এত কাজের পরও কেমন করে মুখে লেগে থাকে ভুবন ভোলানো হাসি! সমীক্ষায় চোখ রেখে দেখা যায়, এমন কর্মক্ষমতা ও চনমনে মনে আপনিও থাকতে পারেন কেবল প্রতিদিন সকালে নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে। যারা স্বপ্ন দেখছেন মা হওয়ার, তারা এখনই মানসিক প্রস্তুতি নিন মর্নিং ওয়াকের। কারণ, গর্ভাবস্থায় শরীর সুস্থ রাখার প্রধান উপায় সকালের মুক্ত বাতাসে অন্তত ১৫ মিনিট হাঁটা। যারা বয়সের কথা ভাবছেন তাদের বলি, আপনি যে বয়সীই হোন না কেন, যখনই দেখবেন ঘুম থেকে উঠেও ক্লান্তি লাগছে, শক্তি পাচ্ছেন না কাজে, তখনই বেরিয়ে পড়ুন পথে। একটু হাঁটলেই শরীরে মজুত হয়ে যাবে পর্যাপ্ত প্রাণশক্তি।
ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি
ঘুম নিয়ে দুশ্চিন্তায় যারা চোখে অন্ধকার দেখেন, তাদের বলি, মর্নিং ওয়াক আপনার পর্যাপ্ত মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ করবে। এতে আপনি নির্দিষ্ট সময়ে ভালো ঘুম দিতে পারবেন। বিছানায় শোয়ামাত্রই নেমে আসবে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি! চোখে দিয়ে যাবে রাজ্যের ঘুম। নিদ্রাহীনতা দূর করে আপনার শরীরে ঘুমের ওষুধ ছাড়াই হরমোনাল ভারসাম্য এনে দেবে মর্নিং ওয়াক।
মেদ-ভুঁড়িকে চোখ রাঙানো
ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করতে পারছেন না বলেই মেদ ঝরানোর আর কোনো উপায় নেই যারা ভাবছেন তাদের বলি, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট নিয়ম করে হাঁটলে নিজের মেদহীন এক সুস্থ শরীর নিয়ে গর্ব করতে পারবেন। জোরে হাঁটলে অনেক সময় ট্রেডমিলে ছোটার চেয়েও বেশি ক্যালরি খরচ হয়। মর্নিং ওয়াকের ফলে আপনার নির্দিষ্ট সময়ে খিদেও পাবে। কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা জীবন থেকে দূর হবে। ফলে উল্টো মেদ-ভুঁড়িকে চোখ রাঙাতে পারবেন।
কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়!
সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করেন, হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকের আশঙ্কা তাদের কম। এ ছাড়া এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। হাঁটলে সারা শরীরে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। এটি একার্থে সারা শরীরের ব্যায়াম। আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎস্পন্দনের মাত্রাও স্বাভাবিক করে তোলে মর্নিং ওয়াক। যদি উচ্চ কিংবা নিম্ন রক্তচাপের মতো সমস্যায় ভোগেন, মর্নিং ওয়াক আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে পারে। প্রতিদিন নিয়ম করে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটলে হৃদরোগের প্রবণতা কমে যায় ৩৫ শতাংশ।
মানসিক চাপ ও অবসাদ থেকে মুক্তি
যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ও অবসাদের হাত থেকে নিষ্কৃতির বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি লুকিয়ে রয়েছে মর্নিং ওয়াক বা ভোরের প্রথম আলোয় হাঁটার ভেতর। প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস মন জুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আপনাকে সুস্থ চিন্তাভাবনা করারও কিছুটা সময় দেবে। হাঁটলে নিঃসৃত হয় সেরোটোনিন এবং এন্ডরফিনের মতো আনন্দ-হরমোন, যা আপনাকে ভেতর থেকে উজ্জীবিত ও আশাবাদী করে তুলবে। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়ে আপনার ব্রেনের কার্যক্ষমতা অনেকখানি বাড়িয়ে তুলবে। এটি স্মৃতিশক্তি বিকাশে এবং সমস্যা সমাধানের পারদর্শিতা বাড়াতেও বেশ কার্যকর উপায়, যা আলঝেইমারের মতো মারাত্মক সমস্যাও অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে পারে।
৩০ মিনিটে সামাজিক
সকালে হাঁটতে বের হলে দেখবেন আপনি একা নন, আরও অনেকেই বেরিয়েছেন বিশুদ্ধ বাতাসে। চলতি পথে নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতার খুব ভালো ক্ষেত্র হতে পারে এই পথটুকু। নানান আলোচনায় ফুরফুরে মেজাজে একসঙ্গে পথ হাঁটুন; দেখবেন জীবনে একাকিত্বের সমস্যা কেটে যাচ্ছে। সকালের ৩০ মিনিটের পথ আপনাকে দৈনন্দিন জীবনেও অনেক বেশি সামাজিক করে তুলবে।
রোগের বাসায় কে দেয় হানা
কে দেয়? নিশ্চয়ই মর্নিং ওয়াক! এটি সতেজতা এনে দেওয়ার পাশাপাশি নানান রোগব্যাধি থেকেও শরীরকে আগলে রাখবে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস আপনাকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি দিতে পারে। হাঁটলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ব্লাড সুগার থেকে সুস্থ থাকার পাশাপাশি শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। পাশ দিয়ে চলমান কিছু দ্রুত বেরিয়ে গেলে রাস্তায় যারা বেসামাল হয়ে যান, কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অথবা ব্রিজে উঠলে যাদের মাথা ঘোরে, তাদের মেরুদণ্ডের অনেকগুলো ব্লক আসলে অকেজো হয়ে আছে, ঠিক মরচে ধরার মতো! নিয়মিত মর্নিং ওয়াক আপনার মেরুদণ্ডের সুস্থতা এনে দিতে পারে। সেই সঙ্গে ভারসাম্য ফেরাবে শরীরের নিম্নভাগেও। আবার ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়তে গিয়ে যারা টের পান পেশি কিংবা গাঁটের যন্ত্রণা, তারা ব্যথার ওষুধে সমাধান না খুঁজে মর্নিং ওয়াককেই দাওয়াই হিসেবে নিন। কেবল বয়স বেড়ে গেলেই নয়, অল্প বয়স থেকেই নিয়মিত হাঁটুন; এতে সব কটি পেশি ও গাঁট সচল থাকবে। হাড়ের ব্যাধিও আপনাকে কষ্ট দেবে না।
ভাবনার যত রং
কথায় আছে, ফুল ভালোবাসার যোগ্যতা যে রাখে না, সে সহজেই মানুষের গলা টিপে কুপোকাত করে দিতে পারে! কেউ কেউ আবার বলেন, যে গান পছন্দ করে না, সে-ও মানুষকে বন্দুকের নল দিয়ে গুলি করে পরপারের টিকিট ধরিয়ে দিতে পারে! আচ্ছা, এতে ফুল বা গানের কোনো সমস্যা হয়? মোটেই না! সমস্যা নেই সকালের নতুন আলো, মুক্ত বাতাস কিংবা সোনা রঙেরও। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে যদি আপনি ওদের আপন করে নেওয়া শিখতে পারেন, তাহলে সবচেয়ে বড় উপকারটা হবে নিজেরই। তাই মন খারাপ আর আলসেমিকে প্যাকেট করে রেখে দিন ডাস্টবিনে। মনটাকে পরিশ্রমী হতে উৎসাহিত করুন। সাগর-নদী-পাহাড়-পার্কসহ প্রকৃতিকে বন্ধু ভাবতে শুরু করুন। দেখবেন, বীরদর্পে ছুঁয়ে আসতে পারছেন ভাবনার সব রং। হেঁটে হেঁটে জয় করতে পারছেন স্বপ্নের সোনালি প্রান্তর।

 আশিক মুস্তাফা
ছবি: হাদী উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top