skip to Main Content

যাপনচিত্র I ‘আমার কাছে আমিই স্টাইল’

জন কবির। তুখোড় রকস্টার। ‘ব্ল্যাক’ ব্যান্ড দিয়ে শুরু করেছিলেন আলো ছড়ানো। বর্তমান ব্যান্ড ‘ইন্দালো’ দিয়ে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নিজেকে

‘দেয়ালে সময়ের ছায়া/ ছায়া বেয়ে নেমে আসে/ অলীক হরিণ—/ চোখ পড়তেই পালায়/ উঁকি দেয় একটা সাপ/ পুরনো চেনা অন্ধকারে…’ নিজের গাওয়া এমন ঘোরগ্রস্ত অন্ধকারের দেয়াল চিরে বাস্তব পৃথিবীতে যখন দিনের শুরু, আকাশে সূর্য উঁকি দিক কিংবা না দিক, সকাল সাড়ে পাঁচটা-ছয়টার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন জন কবির। তারপর কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকেন জানালার বাইরে। আপনমনে দেখেন সবুজের সতেজতা। বললেন, ‘জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে খুব বেশি কিছু যে ভাবি, তা কিন্তু নয়। আসলে স্ক্রিন দেখার কারণে চোখের ওপর যথেষ্ট প্রেসার পড়ে আমাদের। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেকের চোখের সমস্যা শুরু হয়। আমারও হয়েছে। তবে আমি ওষুধের ওপর খুব একটা নির্ভর করতে চাই না। ছোটবেলা থেকেই জানতাম, আর্লি মর্নিংয়ে যদি সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়, কিছুটা হলেও চোখকে সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে প্রাকৃতিকভাবে। এ জন্যই ঘুম থেকে উঠে ফোন না দেখার চেষ্টা করি। সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল্লাগে।’
সবুজের দৃষ্টিসঙ্গ শেষে সময় হয় ওয়ার্কআউটের। জিমে সাধারণত ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ব্যয় করেন জন। বললেন, ‘প্যানডেমিকে সবার মতো আমারও একটু ওলটপালট হয়ে গেছে। ওখান থেকে বের হয়ে আগের মতো জিম করা টাফ। তবু চেষ্টা করি, প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে অন্তত চারবার সকাল সকাল জিমে যাওয়ার। সে ক্ষেত্রে চেষ্টা করি কার্ডিওভাসকুলার এক্সারসাইজগুলো ফলো করার। একটু জগিং, একটু রানিং…এগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি আপাতত। জিমের যে ওয়েট ট্রেনিং, তা সপ্তাহে ম্যাক্সিমাম এক থেকে দুদিন করি।’
জানা কথা, জন কবির বেশ স্বাস্থ্যসচেতন। তার খাদ্যতালিকাও দেয় সেই সাক্ষ্য। জিম থেকে ফিরে, সকাল নয়টার দিকেই ব্রেকফাস্ট সারেন। বললেন, ‘ব্রেকফাস্টে সপ্তাহে পাঁচ দিন আমি একটা স্মোদি বানাই। স্মোদিতে থাকে কলা, ওটস, চিয়া সিড, টক দই, দারুচিনির গুঁড়া, প্রোটিন পাউডার ও বরফ। দুপুরের খাবার খাই প্রায় একটার দিকে। তাতে থাকে দুটি ডিম আর একেক ধরনের ভেজিটেবলস: ফুলকপি, গাজর, পেঁপে, আলু…ইত্যাদি। ডিমের মধ্যে সব ধরনের ভেজিটেবল দিয়ে একটা লাঞ্চ বানিয়ে নিই।’ আরও জানা গেল, তার রাতের খাবারের মেনুতে থাকে মূলত চিকেন স্যান্ডউইচ। সেটাও নিজে বানান।
জানা কথা, ব্যস্ত জীবনে মহাব্যস্ত জন কবিরের জীবনে অখণ্ড অবসর বলে কিছু নেই। ব্রেকফাস্টের পরই দিনের কাজ শুরু হয় তার। কাজ বলতে, শুরুতেই ব্রেন স্টর্মিং। জন বললেন, ‘কী করলাম আর কী করা বাকি, এর মাঝখানে আমি কোথায় আছি—এটাই আমার প্রতিদিনের বেসিক চিন্তা। যা করা হয়ে গেছে, ওগুলো নিয়ে আর চিন্তা না করে, ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।’
সাধারণত স্টুডিওতেই সময় কাটে জনের। এ ছাড়া ইন্দালোর প্র্যাকটিস প্যাডে সপ্তাহে চার দিন একদম নিয়ম করে বেলা তিনটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকেন। যেদিন প্র্যাকটিস থাকে না, সেদিন নিজের অফিসের সহকর্মীদের সময় দেন। ‘আমি যেহেতু এখন ইউটিউবের অনেক কনটেন্ট নিয়ে ব্যস্ত, অফিসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পডকাস্ট নিয়ে, কনটেন্ট নিয়ে মিটিং করি। ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট নিয়েই বাকি তিন দিন কেটে যায় আমার,’ বললেন তিনি। তবু নিজের মতো একান্ত সময় কাটানোর এতটুকু সুযোগ পেলে কী করেন—এমন জিজ্ঞাসার জবাবে বললেন, ‘প্রতিদিনই আমার পোষা কুকুরটির সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসি। ওকে আমি আমার মেয়ে বলি। যদি কোনো দিন প্র্যাকটিস না থাকে, অফিসের ব্যস্ততাও না থাকে, সেদিনটি ওর সঙ্গেই কাটাই। চেষ্টা করি মানুষের ইন্টার‌্যাকশন এড়িয়ে যেতে। কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বের হই, বাসার মধ্যেও ওকে নিয়ে খেলাধুলা করি, ওর সঙ্গে গল্প করি: ওর অনেক কথা থাকে, কমপ্লেন থাকে লাইফে—ওগুলো নিয়ে ডিসকাস করি।’
‘সমস্যা হচ্ছে, ক্রিয়েটিভ মানুষের অবসর বলে কিছু নেই। আমি যদি নেটফ্লিক্সে মুভি কিংবা শো দেখি, সামহাউ এটাও ব্রেনে একধরনের সিগন্যাল দেয়, এ আমার কাজেরই অংশ,’ যোগ করলেন তিনি।
আরও জানা গেল, জনের কাছে সন্ধ্যা বলতে কিছু নেই। বললেন, ‘আমার আছে রাত! আমি খুবই আর্লি ডিনার করি। সাড়ে সাতটা-আটটার মধ্যে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এ সময়টা সাধারণত সন্ধ্যা। আমার বাবা মারা গেছেন ২০১৯ সালে। কোনো কাজ না থাকলে সন্ধ্যাটা মাকে সময় দিই, নিজের ডিনারের প্রস্তুতি নিই।’ ঘুমান কখন? বললেন, ‘ইদানীং সাড়ে দশটার মধ্যে মনে হয় শরীরের চার্জ শেষ, ঘুমিয়ে পড়তে হবে! এগারটা-সাড়ে এগারটার মধ্যে আমি পুরোপুরি ঘুমে।’
অনেকের কাছেই জন একজন স্টাইল আইকন। অথচ কথা বলে জানা গেল, দিনের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কোনো পোশাক পরার প্রতি তার ঝোঁক নেই। বললেন, ‘আমার কাছে পোশাক হচ্ছে পোশাক! গায়ে বস্ত্র থাকলেই হলো। কমফোর্ট ব্যাপারটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। এমনও হয়েছে, একই পোশাকে তিন-চার দিন পার করে দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমি নোংরা! যা হয় আরকি: আবার বের করব কাপড়চোপড়…!’ রঙের প্রশ্নে? বললেন, ‘আমার খুব প্রিয় রং হলুদ। কালো সব সময়ই ভালো লাগে; আর নেভি ব্লু।’
‘আসলে আমার কাছে আমিই স্টাইল! আমি মানে, আপনার যা নিজস্বতা—ওটাই স্টাইল। আপনার ওখান থেকে বের হয়ে অন্য কোনো স্টাইল করার দরকার নেই, যদি না পেশা আপনাকে বাধ্য করে। আমার কাছে নিজেকে নিজের মতো রাখাটাই স্টাইল,’ বললেন তিনি। অ্যাকসেসরিজের প্রশ্নে এই রকস্টার বললেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাকসেসরিজ হয়ে গেছে চশমা। এটা ছাড়া কাছের জিনিস দেখতে কষ্ট হয়। আমাদের এখানে পছন্দের ফ্রেম খুবই কমই পাওয়া যায়; চেষ্টা করি কালেক্ট করার। আর চেষ্টা করি নোজপিনটা চেঞ্জ করার। যদিও সেটা হ্যাসেল। একবার পরার পর দু-তিন বছরে সাধারণত চেঞ্জ করা হয় না। আরেকটা শখ হচ্ছে ট্যাটু। এটা অ্যাকসেসরিজ নয়, বরং আমারই অংশ। নিডলিংয়ের সেনসেশনটা আমার কাছে অ্যাডিকটিভ লাগে। ওখান থেকেই বেসিক্যালি ট্যাটু করা।’ ‘আমার বিনি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করে, “কেন পরছেন, কোত্থেকে পেয়েছেন?” বিনি পরার একমাত্র কারণ, ওটা আমি শুধু উইন্টারে আর শুটের সময় পরি। জানি না, হাউ উইয়ার্ডলি ইট বিকেম আ স্টাইল…। আমাকে অনেকে এভাবেই চেনে, বিনিটা দেখে। ইংল্যান্ডে যখন ছিলাম, খুবই ঠান্ডা ছিল, তাই বিনি কিনে পরা শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশে এসে উইন্টার এল, তখন পরলাম…এভাবে হয়ে গেছে,’ যোগ করলেন জন।
রকস্টারদের সাধারণত তরুণ প্রজন্ম অনুসরণ করে। তাতে অভিভাবক প্রজন্মের সঙ্গে একটা দ্বন্দ্ব লেগে যাওয়ার ঝুঁকি থাকেই। রকস্টার হিসেবে এতে কোনো ধরনের চাপ কি অনুভব করেন জন? বললেন, ‘যখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, তখন আপনার কোনো অ্যাকসেসরিজ অভিভাবকের পছন্দ না হলে হয়তো বলতেন, “এটা কী পরেছ?” আপনি খুব সুন্দরভাবে সেটা বাইপাস করতে পারতেন। অথবা, তাদের বোঝাতে পারতেন, “এটা আমার ভাল্লাগে।” তারা হয়তো বুঝতেন। এখন যে প্রবলেম মানুষ ফেস করে, ইনস্টাগ্রামে সব মানুষ আস্তে আস্তে দেখতে এক রকম লাগে। মানুষ কী ভাবছে, এটা ফলো করতে করতে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে আজকের প্রজন্ম: গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে—এমন একই অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা, একই মেকআপ করা…। “ও এটা করে অনেকগুলা লাইক পাইছে, আমিও করি!” এই মানসিক চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে, ট্রেন্ডের সঙ্গে চলতে গিয়ে আপনি যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন, এই চাপ এই প্রজন্মের ওপর মারাত্মকভাবে পড়েছে। স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে দেখতে তাই একই রকম লাগে। এটাকে প্যানডেমিক না বললেও বড় ধরনের এপিডেমিক বলব আমি। থ্যাংক গড, এমন টাইমে আমার বেড়ে ওঠা—আমি দেখেছি, রক ব্যান্ড তখন ছিল র‌্যাবল। একধরনের প্রটেস্ট। এভাবে বড় হওয়ায় আমার স্টাইল নিয়ে কেউ সমালোচনা করলে গায়ে লাগে না। কিন্তু আমি যদি বর্তমান প্রজন্মের মানুষ হতাম, তাহলে অবশ্যই গায়ে লাগত; কেননা, ফোনে দেখতাম সারাক্ষণ আমাকে কটু কথা বলছে কেউ না কেউ।’
জনের গানে ফুটে ওঠে বেদনাবোধ ও আর্তনাদের একেকটি ধারালো দৃশ্যকল্প। এমন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত জানিয়ে তিনি বললেন, ‘বেদনা ও আর্তনাদের জায়গাটাই আমার মতে কোনো সৃষ্টির মেইন সোর্স। আপনি যখন অনেক হ্যাপি, আপনার পর্যাপ্ত রিসোর্স আছে, তখন বুঝবেন স্ট্রাগল কাকে বলে। যখন আপনার খিদে থাকবে না, তখন ওই আর্টে একধরনের খুঁত থাকে বলে আমার বিশ্বাস। আমার গানে তাই বেদনা ও আর্তনাদ একধরনের ইচ্ছে করেই ক্রিয়েট করা।’ আরও বললেন, ‘যদি কোনো সামাজিক গণ্ডিতে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলি, তাহলে আমার আসল ভালোবাসার কাজটিতে সময় দিতে পারব না, তার মানে পরিবারকেও সময় দিতে পারব না, আলটিমেটলি টোটালি সুপার আনহ্যাপি হয়ে যাব। তাই বরং ভালো এম্পটিনেসকে গ্রহণ করে সেই এম্পটিনেসের ভেতর দিয়ে শিল্প বানিয়ে তোলা। এ কারণে আমার জন্য এই বেদনা ও শূন্যতাবোধ অনেক বড় সোর্স।’
এ তো গেল সৃষ্টির প্রসঙ্গ। জীবনকে কীভাবে দেখেন জন? বললেন, ‘ফোকাস করার চেষ্টা করি পজিটিভ জিনিসগুলোতে। মাথার পেছনে নেগেটিভ জিনিসগুলো থাকবেই। নেগেটিভ জিনিসগুলো না থাকলে, সেগুলো কখনো আপনার সামনে এসে পড়লে পার হয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে। আমার কাছে জীবন একটা বিটারসুইট ব্যাপার। চেষ্টা করি অনেক এনজয় করার। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই ইন্ট্রোভার্ট মানুষ। খুবই অপছন্দ করি ক্রাউড। এখানে ফানি ব্যাপার হচ্ছে, আমার মেইন কাজটা ক্রাউড নিয়ে। কিন্তু এখন যেটা হয়, আমি মধ্য চল্লিশে, কনসার্ট পর্যন্ত থাকি, পারফর্ম করি; কিন্তু এরপর সেলফি তোলা…একটা উইয়ার্ড ফিলিং হয়, এটা আমার জন্য না। জীবনটা আমার কাছে হচ্ছে, আমার ফ্যামিলি, আমার মা, আমার ভাই, ভাইয়ের বউ-বাচ্চা, আমার কুকুর। এর বাইরে সেকেন্ড ফ্যামিলি আমার ব্যান্ড—ইন্দালো। এই কয়টা মানুষ যদি আমাকে নিয়ে হ্যাপি থাকে, তাহলেই আমি ফাইন।’

 রুদ্র আরিফ
ছবি: রনি বাউল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top