skip to Main Content

কভারস্টোরি I মমত্বের মাধুর্য

এ এক সুনির্মল অনুভূতি। মনুষ্যত্বের এক নিগূঢ় বার্তাবাহী। অন্তস্তলের শৈল্পিক সুধা। লিখেছেন রুদ্র আরিফ

ধরা যাক শ্রাবণের ঘোর বর্ষণমুখর দিনে নাগরিক ব্যালকনিতে আশ্রয় নিয়েছে কোনো ভেজা চড়–ই। তার চোখে মায়া। সেই মায়া মন গলিয়ে দিয়ে পারে এমনকি পাষাণ হৃদয়ের মানুষেরও। ছোট্ট ওই পাখির প্রতি নিরন্তর মমত্ববোধ জেগে উঠতে পারে তার মনে। জেগে ওঠেও। কেন ওঠে? কারণ, মানুষ এ কারণেই মানুষ। তার ভেতর থাকা অসংখ্য মানবিক গুণের মধ্যে মমত্বও একটি। কখনো এটি সুপ্ত থাকে; কখনো হয়ে ওঠে প্রকাশিত। আর প্রকাশিত হয়ে ওঠে বলেই আশ্রয়সন্ধানী ছোট্ট চড়–ই পাখির প্রতিই শুধু নয়, জগতের সবকিছুর প্রতি মমতাভরা দৃষ্টি মেলে দেয় সে। এটাই মনুষ্য স্বভাব।
উনিশ শতকের জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার বলেছেন, ‘মমত্ব হলো নৈতিকতার ভিত্তি।’ মহাবিশ্বের বাকি সবকিছু থেকে মানুষ নিজেদের আলাদা করে তুলতে পেরেছে যেসব মনুষ্য গুণের কারণে, মায়া বা মমত্ববোধ তার অন্যতম। তবে মমত্ববোধ যে কেবলই কোমল কোনো অনুভূতি, তা নয়; কখনো কখনো এটি হয়ে উঠতে পারে বিধ্বংসীও। ভারতের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত লিখেছেন, ‘সব জিনিসকে মানুষ মমতা দিয়ে আবৃত করতে চায়। বাইরের জিনিসকে সে জয় করে, মমত্বের পরিধির মধ্যে তাকে টেনে আনে। এ যদি সে না পারে, তবে তাকে ধ্বংস করতে চায়—কখনো উপেক্ষায়, কখনো হিংসায়। অতএব মমত্ববোধ একটি স্থাণু অবিকার ভাব নয়, বরং সচল শক্তির উৎস। এতে একদিকে আছে আত্মরক্ষার শক্তি, অন্যদিকে আত্মসাৎ অথবা নস্যাৎ করবার শক্তি। আমরা যাকে সচরাচর ইচ্ছাশক্তি বলি, তারও মূলে আছে একটি আত্মরক্ষাধর্মী ও আগ্রাসী মমতা অথবা সম্প্রসারণশীল অহংবোধ।’
মনন-সঙ্গ
মানুষ মননশীল প্রাণী। তার চিন্তা-চেতনা নিরন্তর সক্রিয়। বাহ্যিক মানুষটির ভেতরের একান্ত যে সত্তা, সেটিকে ঋদ্ধ করে তোলে এ প্রক্রিয়া। ফরাসি দার্শনিক পাসকাল বলে গেছেন, ‘মানুষ সামান্য তৃণমাত্র, প্রকৃতির দুর্বলতম বস্তু। তবে সে এক মননশীল তৃণ। তাকে ধ্বংস করবার জন্য প্রকৃতিকে রণসজ্জায় সজ্জিত হতে হয় না, এক ফুৎকারেই তাকে বিনাশ করা যায়। তবু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও মানুষ প্রকৃতির চেয়ে মহৎ। কারণ, মৃত্যুকে মানুষ চেতনার মাধ্যমে চিনে নেয়, অথচ ঘাতক প্রকৃতি অচেতন। মননেই মানুষের মহত্ত্ব।’
পাসকালের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন অম্লান দত্তও। বলেছেন, ‘মমত্ব এবং মনন অথবা দর্শন—এই দুটিকে বিপরীত মেরু হিসেবে কল্পনা করা যথেষ্ট নয়। তা যদি করি, তবে এদের পারস্পরিক সম্পর্ক, পরিপূরকতা ও ঘাত-প্রতিঘাত উপলব্ধি করা কঠিন হয়। যে ভাবটি জীবন্ত অন্তর্দৃষ্টির সহায়ক হতে পারত, অবশেষে তা একটি নিশ্চল চিত্রকল্পে পরিণত হয়। ইতিহাসের সঙ্গে দর্শনের যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়।’ তাই উন্নত মননের অধিকারী হয়ে ওঠার পথে মানুষকে এক নিরন্তর সঙ্গ দেয় তার মমত্ববোধ।
সমবেদনার দোলা
মমত্ব ও সমবেদনা পাশাপাশি হাত ধরে চলা দুই মানবিক বোধ। ব্রিটিশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট পল গিলবার্ট বলেন, মমত্ব ও সমবেদনাকে বহুভাবেই নিরূপণ করা সম্ভব। তবে এর মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে উদারতা। এ হলো নিজের ও অপরের জীবনের ভোগান্তিগুলোর প্রতি দরদি নজর দিয়ে, জীবনকে অপেক্ষাকৃত সহজ ও সাবলীল করে তোলার আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা। ইতিহাসে চোখ রেখে তিনি জানান, সৃষ্টির শুরু থেকে, প্রায় ৩ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ লিপ্ত ছিল সুতীব্র নিষ্ঠুরতা ও নির্মম আচার-আচরণে। তারপর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় মমত্ববোধ। আর সেই বোধ মানবসভ্যতাকে অন্য সব প্রাণিকুল থেকে আলাদা ও সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এটি শুধু মানুষকে আত্মিক ও নৈতিক জীবনযাত্রার দিকেই চালিত হওয়ার প্রেরণা দেয়নি, বরং অশান্ত মন ও বিক্ষুব্ধ সম্পর্কগুলো সারিয়ে তুলতেও দেখিয়েছে পথ।
তবে মমত্ব ও সমবেদনার মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মমত্ববোধ হচ্ছে প্রেরণাদায়ক আবেগের অনুভব, অন্যদিকে সমবেদনা হচ্ছে ইচ্ছাকৃত অনুভূতি প্রকাশ। আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ-কেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয় ও আত্মবাচক অংশ হিসেবে জন্ম ঘটে সমবেদনার। তা কোনো অনুভূতি, ভাবনা ও সিদ্ধান্ত তৈরির ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখে, সে ব্যাপারে আমরা থাকি কম অবগত ও কম স্বতঃস্ফূর্ত। অন্যদিকে আমাদের মস্তিষ্কের জ্ঞান-কেন্দ্র থেকে উৎসারিত হয়ে মনোজগতের চিন্তাশীল ও সুস্থির অংশ হিসেবে কাজ করে মমত্ববোধ। তাই মমত্ববোধে ছড়িয়ে পড়া অনুভূতি, ভাবনা ও সিদ্ধান্তের বেলায় আমাদের চৈতন্যের ভেতর দিয়ে একটা ফিল্টারিং হয়ে যায় বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের মনোবিকাশ ঘটাতে পারি। তাই বলা যেতে পারে, মমত্ববোধ নিগূঢ় হলে সমবেদনা আপনা-আপনিই জেগে উঠবে। অন্যদিকে, সমবেদনা জেগে উঠলেই মমত্ববোধ কাজ করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
জাগরণের গান
জানি, চাইলেও সারাক্ষণ অন্তস্তল থেকে মমত্বের সবটুকু উজাড় করে দেওয়া সম্ভব হয় না। মানুষের ভেতরে শুধু ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক কিছু বোধও থাকে। সেগুলো বাধা দেয়। যদি আপনি মমত্ববোধের স্তরটি আরও পুরো, আরও নিবিড় করে তুলতে পারেন, তাহলে সেই সব নেতিবাচকতা পারবে না খুব একটা কাবু করতে। কীভাবে সম্ভব? ‘স্টার্ট হয়্যার ইউ আর: আ গাইড টু কমপ্যাশনেট লিভিং’ শিরোনামের এক দীর্ঘ বইয়ে তার বিশদ উপায় হাজির করেছেন আমেরিকান নান ও লেখিকা পেমা চোড্রন। এর শুরুতেই গুরুত্ব দিয়েছেন পলায়নপর প্রবৃত্তির ওপর। তিনি বলেন, আমরা যদি সামনে পড়া যেকোনো বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিই, যদি যেকোনো সমস্যা ও সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস রাখি, তাহলে তা ধীরে ধীরে আমাদের মনে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলবে অন্তরের গহিন থেকে। তিলে তিলে জমে থাকা ক্রোধ আর বাড়তে না দিয়ে, সব নেতিবাচকতাকে এক কৌটায় বন্দি করে, ইতিবাচকতার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
পেমা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘যেখানেই থাকি না কেন, কী করে আমরা একটি সুবিবেচনাপূর্ণ পৃথিবী, পারিবারিক অবস্থা অথবা কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারব? আমরা আমাদের কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা ও চিন্তা-চেতনাকে বন্দি না করে বরং উন্মোচন করতে সক্ষম হব? অন্যভাবে বললে, কী করে আমরা অন্য মানুষদের জন্য জায়গা করে দিতে পারব এবং নিজেদের বিচক্ষণতার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারব? আমরা যে দুনিয়ায় রয়েছি, সেটির কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন না করে, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয় না পেয়ে বরং কী করে সেই দুনিয়ার অংশ হয়ে উঠতে পারব?’ জবাবে তিনি নিজেই জানান, ‘এ সবকিছুরই সূচনা ঘটে নিজেকে ভালোবাসার ভেতর দিয়ে। আর তা পরিণত হয় অপরকে ভালোবাসায়। নিজেদের অন্তরে বসত গড়া দেয়ালগুলো যত ভেঙে পড়তে থাকে, অপরের প্রতি ভয় তত কাটতে থাকে আমাদের। আর আমরা ততই নিজেদের অন্তরকে বলতে পারি, দেখো, আমাদের চোখের সামনে কী রয়েছে। আর সেসবের সঙ্গে লড়াইয়ের বদলে সেগুলোকে আপন করে নিতে শিখি।’ পরস্পরের সঙ্গে এমন বিনিময়ের মধ্য দিয়েই গাঢ় হয়ে ওঠে মমত্ববোধ।
নিজের প্রতি
শুধু অন্যের প্রতিই নয়, নিজের প্রতিও মমত্ব দেখানোর দরকার পড়ে মানুষের। জানা কথা, নিজেকে ভালোবাসতে না জানলে অপরকে ভালোবাসা দুরূহ শুধু নয়, অসম্ভবও। আমেরিকান ওয়েলনেস অ্যাডভাইজার ও বেস্টসেলিং লেখিকা জেনিফার লাউডেন যথার্থই বলেছেন, ‘নিজের যত্ন নেওয়া স্বার্থপর কিংবা আত্মকেন্দ্রিকতার ব্যাপার নয়। কোনো শুষ্ক আধার থেকে আমরা অন্যদের পুষ্টি দিতে পারব না। তাই প্রথমেই নিজের যত্ন নেওয়া উচিত, যেন আমাদের উদ্বৃত্ত থেকে, প্রাচুর্য থেকে অন্যদের কিছুটা দিতে পারি। যখন নিজেদের পূর্ণতার জায়গা থেকে অন্যদের পুষ্টি জোগাতে পারব, আমাদের মনে তখন সেটির সুবিধা নেওয়ার বদলে বরং নিজেকেই নবায়ন করার অনুভূতি জাগ্রত হবে।’
অনেক সময় দেখা যায়, নিজের অন্তরের কোনো ক্ষতের যত্ন আমরা নিই না। টের পাই কিংবা না পাই, তা নিরন্তর ভোগাতে থাকে আমাদের। আর একসময় ঠেলে দিতে পারে মাদকাসক্তি, আত্মনিগ্রহ, আত্মবিশ্বাসহীনতা, আর্থিক সংকট, উৎকণ্ঠা, ব্যাধিসহ বৈষয়িক ও মানসিক নানা সমস্যায়। আমরা অনেকেই নিজেদের যন্ত্রণাকে গোপন রেখে অভিনয়ের আশ্রয় নিয়ে এমনভাবে দিনাতিপাত করতে থাকি, যেন কিচ্ছু হয়নি! একটা খোলসের আড়ালে অন্তরের ক্ষত ও বেদনাবোধগুলো লুকিয়ে রাখি। তার চারপাশে মনে মনে গড়ে তুলি এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। অথচ তাতে আমাদের ক্ষত-বিক্ষত সত্তা আরও বেশি ভীতসন্ত্রস্ত, আরও বেশি ক্রুদ্ধ কিংবা ক্ষণে ক্ষণে আরও বেশি লজ্জিত হয়ে ওঠে। এদিকে আমাদের অহংবাদী সত্তা বারবার নিজেকেই ভুলিয়ে দিতে চায় নিজের সেই অন্তস্তলের রক্তাক্ত অনুভূতির কথা। আর তা একসময় বেরিয়ে আসতে বাধ্য। বেরিয়ে এলে ঘটে যায় ভয়াবহ বিপর্যয়—এটা বুঝতে খুব বেশি ভাবনার দরকার পড়ে না!
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখিকা, স্পিকার ও হিলার সিন্ডি ডেল এক লেখায় জানিয়েছেন, নিজেদের অন্তরের ক্ষত-বিক্ষত অংশগুলোতে গড়ে ওঠা প্রাচীরগুলো বছরের পর বছর ধরে থেরাপির মাধ্যমে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে যাওয়া নিজের বেশ কয়েকজন ক্লায়েন্টকে নিয়ে তিনি গভীরভাবে কাজ করেছেন। তাতে দেখেছেন, ওই মানুষগুলোর প্রাত্যহিক জীবনচরিতের কারণে তাদের ওই সব ক্ষত সেরে ওঠা মুশকিল। কেননা, তারা অজান্তেই থামাননি আত্মনিগ্রহ। নিজেকে ভালোবাসা পাওয়ার, ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার, ভালো কিছু করার যোগ্য মনে করেন না তারা। ওই লেখিকা জোর দিয়ে বলেন, কোনো কোনো শিশু যেমন লুকোচুরি খেলা খুবই ভালোবাসে, তেমনিভাবে কেউ নিজের আহত সত্তাকে অজান্তেই নিরন্তর লুকিয়ে রাখতে চাইলে তার পক্ষে এর প্রতিকার করা মুশকিল। তাহলে উপায়? তারা আসলে থেরাপি নিতে এসে নিজেদের ‘আজকের দিনের’ সত্তাকে নিয়েই কাজ করছে; ‘গতকালের’ সত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে আশু সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামালেও, দীর্ঘকাল লুকিয়ে থাকা ক্ষতগুলো আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। নিজেকে ভালো না বাসলে, নিজের অন্তরের গোপন ক্ষতগুলো সারিয়ে না তুললে, নিজের প্রতি মমত্ব না দেখালে সেরে ওঠা দুরূহ।
সুজনে সৃজনে
কালে কালে মমত্ব ও সমবেদনার দারুণ সব উদাহরণ হয়ে উঠেছেন অনেকেই। মানবসেবায় নিজেদের আজীবন নিয়োজিত রেখেছেন কেউ কেউ। ব্রিটিশ সোশ্যাল রিফর্মার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাদেরই একজন। আধুনিক নার্সিং ট্রেনিং ও থিওরির প্রতিষ্ঠা তার হাতেই। ক্রিমিয়ান যুদ্ধে [১৮৫৩—১৮৫৬] আহত সৈন্যদের গভীর মমতা দিয়ে সেবা করে ‘দ্য লেডি উইথ ল্যাম্প’ উপাধি পেয়েছেন তিনি। ভারতবর্ষে অনাথ শিশুদের কোলে তুলে নেওয়া মাদার তেরেসার গল্প আমরা কম-বেশি সবাই জানি। নিজ দেশ ছেড়ে, দূরদেশের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এমন মানবিক কর্মকাণ্ডে জড়ানো মানুষের তালিকা বেশ দীর্ঘ। বাংলাদেশেও এসেছেন এমন অনেকে; তাদেরই একজন আমেরিকান মানবসেবী জন ন্যাপিয়ার অ্যাডামস। দুর্ঘটনায় নিহত গাড়িচালকের সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখে বড় করে মমত্বের যে মহান উদাহরণ তিনি দেখিয়েছেন, সেটি ঘিরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ বানিয়েছেন ‘দ্য ফাদার’ [১৯৭৯] চলচ্চিত্র। দেশে-বিদেশে আরও অনেক চলচ্চিত্র, সাহিত্য, চিত্রকলায় ছড়িয়ে রয়েছে মমত্বের জয়গান।
এমন কিছু চলচ্চিত্রের আরও উদাহরণ টানা যাক। আমেরিকান চলচ্চিত্রকার স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ই.টি.’ [১৯৮২] নানান কারণেই চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এক মাইলফলক হয়ে রয়েছে। এই সাই-ফাই সিনেমার নির্যাসেও রয়েছে মমত্বের বারতা। আউটার স্পেস থেকে আসা একটি অ্যালিয়েন ও এই পৃথিবীর একজন বালকের বন্ধুত্বের গল্প এটি। পৃথিবীতে পথ হারিয়ে আটকা পড়া ই.টি.-র দিকে নিবিড় মমত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় এলিয়ট নামের বালকটি। অন্যরা যখন ই.টি.-কে নিয়ে বিভ্রান্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত, তখন ওকে নিজ গ্রহে ফেরার উপায় খুঁজে পেতেও সাহায্য করে এলিয়ট। আমরা যে যেখান থেকেই আসি না কেন, অপরের পাশে মমত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারলে শেষ পর্যন্ত মানবতারই জয় হয়, সেই শিক্ষা ছড়িয়ে রেখেছে সিনেমাটি। এমন আরও উদাহরণ মেলে ‘আ বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড’, ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’, ‘ফ্রিকি ফ্রাইডে’, ‘ফিডলার অব দ্য রুফ’, ‘নেপোলিয়ন ডিনামাইট’, ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’, ‘দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া’, ‘ডেড ম্যান ওয়াকিং’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে।
পাখি, গাছ, মানুষ…সবার
কিছু শুশ্রূষার জন্য খুব বেশি কসরতের দরকার পড়ে না। ওষুধ-পথ্যেরও না। কখনো ভেবে দেখেছেন কি, আপনার এতটুকু মায়াভরা চাহনি হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে ফুটপাতে ধুঁকতে থাকা শিশুর মুখে? আপনার একটু আদুরে পরশ চাঙা করে তুলতে পারে হাসপাতালের বিছানায় থাকা বৃদ্ধের মনোবল? কিন্তু সে জন্য আপনার মনোজগতেও তো থাকা চাই সুশৃঙ্খলা, তাই না?
‘আমরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল—এ কথা ভুলে গেলে আমাদের মনে শান্তি থাকবে না,’ বলে গেছেন মাদার তেরেসা। বড় হতে হতে আমাদের ভেতর গড়ে উঠতে থাকে মমত্ব ও সমবেদনার বোধ। সেই সব বোধ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় অন্য মানুষের কাছে। যারা কোনো কারণে ভোগান্তিতে রয়েছে, যারা পীড়িত, তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মানবিক সত্তা জাগ্রত থাকে আমাদের। তা থাকা উচিতও। এ কথা পৃথিবীর আদিকাল থেকে যেমন সত্য, বর্তমান কালে আরও বেশি সত্যে উপনীত। গত শতকে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে আসা মানুষ হয়তো ভেবেছিল, শিগগিরই চরম কোনো সংকটে পড়তে হবে না। অথচ, ইতিহাস থেকে ঠিক শিক্ষাটা নিতে অনেক সময়ই ভুলে যাই আমরা। তার পরিণাম হয় ভয়াবহ। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে অসন্তুষ্টি। যুদ্ধ লেগে আছে কোনো কোনো দেশে। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল ভোগ করতে হচ্ছে শুধু মানুষ নয়, এই পৃথিবীর সব সত্তারই। তাই এ সময়ে আমাদের আরও বেশি সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার; প্রয়োজন আরও বেশি মমতা দেখানো—অন্য মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, পৃথিবীর প্রতি। কবীর সুমনের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে ওঠা দরকার, ‘পৃথিবীটা পাখি, গাছ, মানুষ…সবার।’

গ্রন্থসূত্র
১. অম্লান দত্ত, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’, ২০০৫
২. সিন্ডি ডেল, ‘দ্য স্পিরিচুয়াল পাওয়ার অব এমপ্যাথি: ডেভেলপ ইউর ইনটিউটিভ গিফটস ফর কমপ্যাশনেট কানেকশন’, ২০১৪
৩. পেমা চোড্রন, ‘স্টার্ট হয়্যার ইউ আর: আ গাইড টু কমপ্যাশনেট লিভিং’, ১৯৯৪
৪. পল গিলবার্ট, ‘দ্য কমপ্যাশনেট মাইন্ড’, ২০০৯
৫. জ্যাকলিন কার্টার ও র‌্যাসমাস হগার্ড; ‘কমপ্যাশনেট লিডারশিপ: হাউ টু ডু হার্ড থিংস ইন আ হিউম্যান ওয়ে’; ২০২২

মডেল: অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কিয়ারা
জুয়েলারি: স্পার্কলি ক্লোজেট
স্টাইলিং: ফয়সাল তুষার
ছবি: হাদী উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top