skip to Main Content

ফিচার I কোরমা-কাহিনি

কোরমার জন্মবৃত্তান্ত জানা মুশকিল। তবে এর ‘পূর্বপুরুষের’ পরিচয় মেলে! একটু কষ্ট করে গুপি-বাঘার মতো ‘দেখো রে নয়ন মেলে’ গেয়ে উঠে ইতিহাসের বইয়ে নজর দিতেই রহস্যের ধোঁয়াশা যেন একট একটুু করে কাটতে শুরু করে; তবে পুরোটা নয়। চলুন, ঘুরে আসা যাক কোরমার প্রাচীনতম হেঁসেল থেকে বাংলার রসবতীতে

তুর্ক বা এশিয়া মাইনর এলাকার যাযাবরদের ‘কাভিরমা’ শব্দটা এখনকার ভৌগোলিক তুরস্কের তুর্কি শব্দ ‘কাভুরমা’র উৎস। কাভুরমা হলো প্রথমে তেলে ভেজে ও পরে ভাপে সেদ্ধ করা মাংসের পদ। অবশ্য এর সঙ্গে আজারবাইজানি মাংসের স্ট্যু ‘কোভুরমা’র সম্পর্ক নেই; যেটা শুকনো ফল ও টক আঙুরের জুস, কখনোবা খানিক সবজি মিলিয়ে রান্না করা হয়। মাংস হতে পারে রোদে শুকানো কিংবা টাটকা। আবার তুর্কি কাভুরমা হতে পারে নানা ধরনের—সবজি দিয়ে কোভুরমা—বিভিন্ন হার্ব ও সবজি দিয়ে ভেড়ার স্ট্যু পারস্য ও তুর্ক ঘরানার রন্ধনপ্রণালির মিশেলে এসেছে। তুরসু কোভুরমায় ভেড়ার সঙ্গে শুকিয়ে রাখা লেবু, শুকনো খুবানি ও হলুদ দেওয়া হয়। আর নূর কোভুরমায় থাকে ভেড়া ও বেদানা। আজারবাইজান, তুর্ক আর তুর্কিতেই শেষ হচ্ছে না; আরও আছে পারসিক ঘরানার খোরেশ/খোরমেহ/ঘোরমেহ—বিভিন্ন সবজি, হার্ব আর রাজমার সাধারণ এক স্ট্যু। এর স্বাদগন্ধ (ফ্লেভার) মৃদু, ঘন, মসৃণ বুনটের (ক্রিমি টেক্সচার) আর এর স্বাদের মূল ভিত্তি এনে দেয় বিভিন্ন হার্ব ও মসলা। সীমান্ত পেরিয়ে আফগান ঘরানার রান্নাতেও মাংসের কারি হিসেবে কোরমেহ রয়েছে, যার স্বাদ খানিকটা টক লিমু ওমানি বা শুকনো লেবুর ব্যবহারের কারণে। ঘটনাক্রমে রামপুরের পুরোনো রন্ধনপ্রণালির পাণ্ডুলিপিতেও পাওয়া যায় লেবুর রসের ব্যবহার। বলে রাখা ভালো, ভারতের উত্তর প্রদেশের রামপুরে এখনো আফগান ঘরানার লোকদের বসবাস রয়েছে, যারা তাদের পুরোনো রীতি-রেওয়াজ খানিকটা ধরে রেখেছেন।
এই খাবার ভারতীয় উপমহাদেশে ঢুকেছে অনেক পরে। অন্তত সুলতানি আমলে তো নয়ই; বাদশা বাবুর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান—এরা সম্ভবত কেউই এই পদের স্বাদ পাননি। কারণ, তাদের সময়ে এই পদের কথা তাদের মীর বাকাওয়াল বা রসুইঘরের তত্ত্বাবধায়কদের রন্ধনতালিকায় পাওয়া যায়নি। ইব্ন্ বাত্তুতার খাবারের বর্ণনায় পশুপাখির রোস্টের কথা, মাংস দিয়ে পোলাও রান্নার কথা, মাংসের কিমা—নানা ধরনের বাদাম, শুকনো ফল, পেঁয়াজ ও মসলা দিয়ে রুটিতে ভরে তিন কোণাকৃতি করে ঘিয়ে ভাজার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোরমা বা কারির উল্লেখ নেই। ব্যাপারটা ভাববার মতো। ভারতের মোগল দিল্লি নিয়ে লেখা বেশ কটি বইয়ের রচয়িতা রানা সাফভি বলেছেন, কোরমা শব্দটা প্রথম পাওয়া গেছে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সময়ে। তিনি অনেক বাক্য ব্যয় করে বুঝিয়েছেন, সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে গুরকানি (মোগলরা নিজেদের এই নামেই পরিচয় দিতেন) রন্ধনশালায় পারস্যের মাংসের স্ট্যু মিশে গিয়েছিল মসলা, দই, কাঠবাদাম, রসুন আর অন্য সব উপকরণের সঙ্গে। এর ফল হিসেবে বেরিয়ে এসেছিল ঘন, ঝাঁজালো কারি; যার ওপরে পেঁয়াজের বেরেস্তা অতুলনীয় সুবাস ছড়াত। এমনকি এখনো ভাজা ও গুঁড়া করা বা পিষে ফেলা পেঁয়াজ, আস্ত সব মসলার সঙ্গে মিলে ভারতীয় কোরমার মূল ফ্লেভার তৈরি করে। কয়েকজন খাদ্যবিশারদ দাবি করেছেন, পারসিক মাংসের কারি (সম্ভবত খোরমেহ) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় মসলায় জারিত করে রাজপুত বাবুর্চি আর মোগল রন্ধনশালার তত্ত্বাবধায়ক মীর বাকাওয়ালের যৌথ প্রযোজনা এই কোরমা। এই দাবিকে মোটামুটি বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। কিন্তু আরেকটি দাবি—রাজপুত গোত্র ‘কুরমা’ থেকে এই নাম এসেছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়; কারণ, কোরমার কোনো উল্লেখ আমরা মোগল সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে লেখা বই—আইন-ই-আকবারি বা নুকশা-ই-শাহজাহানিতে পাই না।
যাহোক, মধ্য এশিয়ায় রান্নার প্রক্রিয়ার নামে খাবারের নাম হয়ে যায় কোরমা, যাতে প্রথমে উচ্চ তাপে মাংসকে ভাপে সেদ্ধ করে পরে লম্বা সময় ধরে আলতো আঁচে রান্না করা হতো। আর ভারতে ঢুকে তা বিভিন্ন বর্ণে, মসলায় তার রূপ বদলে ফেলতে থাকে। তবে খাবারের ইতিহাস খুঁজে বেড়ানো নেহা ভারমানি লিখেছেন, ‘মোগল প্রেক্ষাপটে, আমার জানামতে কোরমার প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় শাহ আলমের শাসনামলের অভিজাত রন্ধনপ্রণালির বইয়ে।’ সম্ভবত কালিয়া ও দো-পেঁয়াজা মোগল রন্ধনশালায় বছরের পর বছর থেকে বিবর্তিত হয়েছে ভারতীয় কোরমায়।
এখানে বলা ভালো, ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন, তার সঙ্গে আসা অনেক কিযিলবাশ সৈন্যদের মতো আরও অনেক পারসিকই ভারতে রয়ে গিয়েছিলেন, সে সময়কার একটা প্রভাব সম্ভবত পড়েছিল খাদ্যসংস্কৃতিতে। যদিও এর আগেও পারসিকরা ছিলেন ভারতে, বেশ বড় একটা পারসিক ও পশ্চিম এশীয়দের আগমনের ঘটনা দেখি ১৬১১ সালের দিকে, জাহাঙ্গীরের শাসনামলে। মোগল সম্রাজ্ঞীদের অনেকে ছিলেন পারসিক। আর দ্বিতীয় শাহ আলমের সময়কাল ছিল ১৭৬০ সালের অক্টোবর থেকে ১৮০৬ সালের নভেম্বর অব্দি, মাঝে ১৭৮৮ সালে আড়াই মাসের সিংহাসন হারানো বাদ দিলে। অর্থাৎ আগে থেকে আসা পারসিক বা পশ্চিম এশীয়রা মোগল হেঁসেল আর অন্দরে যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তার ফসল হিসেবে কোরমাকে দেখলেও অত্যুক্তি হবে না বোধ হয়। তাই ইতিহাসের বিকৃতি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ধারণা করে নেওয়া যেতে পারে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে কোরমা রাজকীয় খাবারের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। আর যখন মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছিল, তখন এটা উপমহাদেশের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেও ছড়িয়ে যায়। এই খাবার শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দস্তরখানেও জায়গা করে নিয়েছিল। তার প্রমাণ মেলে মুনশি ফাইযুদ্দিন দেহলভির বই বায্ম-ই আখিরে।
ভারতে সব এলাকায় কোরমার নিজস্ব রূপ আছে, আবার কোথাও নতুন পদেরও সৃষ্টি ঘটেছে আগের কোরমাকে অক্ষুণ্ন রেখে। যেমন কাশ্মীরের কোরমা তো আছেই, যেটা মৌরি, হলুদ, তেঁতুল আর শুকনো মোরগঝুঁটি ফুল দিয়ে তৈরি করা হয়; পাশাপাশি তৈরি হয় কোরমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আসা খাবার রোগান জোশ। আবার দক্ষিণ ভারতে গিয়ে নারকেলের দুধ পড়বে না কোরমায়, তা কি হয়? আবার উত্তর ভারতেই কোরমা ভাগ হয়েছে তিন ভাগে—মোগলাই, আফগানি বা রামপুরি আর লখনৌয়ি। লিজি কলিংহ্যাম কারি: আ টেল অব কুকস অ্যান্ড কনকুয়ারার বইয়ে বলেছেন, ‘মোগলাই কোরমায় আওয়াধি বাবুর্চিরা ক্রিম ঢেলে সেটাকে শাহি কোরমায় পরিণত করেছিলেন।’ আবার রামপুরি কোরমায় শুকনো লেবু ব্যবহার করা হয়। তবে সব কোরমায় যে জিনিসটা লাগে সেটা হলো—দই; অবশ্য পরে দুধের ব্যবহারও হয়েছে।
রামপুরি কোরমায় আফগান তরিকার নিয়ম মেনেই মাংসের স্বাদকে প্রাধান্য দেওয়া হতো, আর মসলার পরিমাণ হতো কম; কখনো ক্রিম দেওয়া হতো, কখনোবা ক্রিম ছাড়াই রান্না হতো। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ থেকে রক্ষা পাওয়া রামপুর, পতন হওয়া দিল্লি আর আওধ থেকে রান্নার কারিগর ও শিল্পীদের স্বাগত জানায়। রামপুরে নানা ধরনের কালিয়া প্রচলিত থাকলেও দিল্লি আর আওধ থেকে সেখানে বসতি গড়া রন্ধনশিল্পীরা মিলে রামপুরের এক আলাদা কোরমার জন্ম দেন—রামপুরি কোরমা। রামপুরের নবাবের বিশেষজ্ঞ খানসামাই থাকতে শুরু করেন যারা কেবল কোরমা রান্না করতেন। নওয়াব কালবে আলী খানের পাণ্ডুলিপিতে কোরমা মুর্গের বর্ণনা পাওয়া যায়। দই আর বিভিন্ন মসলায় জারিত, পেঁয়াজের বাদামি-সোনালি রঙের বেরেস্তায় জাফরান মেশানো পানি দিয়ে রান্না হতো এই কোরমা মুর্গ। গুঁড়া করা কাঠবাদাম একে হলুদ, মাঝেমধ্যে সবজি মেশানো কালিয়ার থেকে আলাদা পরিচয় দিত। তবে রামপুরিরা হলুদের তীক্ষè স্বাদ আর সিঁদুরের রং ভালোবাসেন বলে এটা ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লিতেও।
ক্ল্যাসিক কুজিন অব লখনৌ: আ ফুড মেমোইর অব নওয়াব জাফর হুসাইন বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, অভিজাত খানাপাকানেওয়ালা পরিবার থেকে আগত মুহাম্মাদ হুসাইন নামের এক খানসামাকে নওয়াব জাফর হুসাইন নিয়োজিত করেছিলেন ১৯২৫ সালে। নওয়াব যখন হুসাইনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কী কী রাঁধতে পারেন, তার উত্তর ছিল ‘কোরমা ও চাপাতি। আমি কেবল এটাই আপনাকে খাওয়াতে পারি। এ ছাড়া আর কোনো পদ আমার জানা নেই।’ নওয়াব তাকে চাকরি দিয়েছিলেন আর পরের ছয় বছর মুহাম্মাদ হুসাইন তার খানসামা হিসেবে ছিলেন। প্রায় পাঁচ বছরে তিনি প্রতিদিন দুই বেলা নওয়াবের জন্য কোরমা রেঁধেছেন আর নওয়াবের নিজের ভাষ্যে, ‘আমি বিন্দুমাত্র একঘেয়েমিতে ভুগিনি।’ লখনৌয়ে এখন মুর্গ কোরমা জনপ্রিয় হলেও ইতিহাস বলে, মুরগি সব সময় পছন্দসই মাংস ছিল না। কারণ, একটা সময়ে মুরগিও বেশ দামি ছিল, যদি অন্য লাল মাংসের সঙ্গে তুলনায় যেতে হয়, তাই এভাবেই সেটাকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হতো। মুরগির কোরমা বরাদ্দ রাখা হতো উৎসবে বা মেহমানদারির জন্য। এটা অবশ্য পোলট্রিশিল্পের বিপ্লবের আগেকার গল্প, ১৯৭১ সালের আগের। এখনো অনেকেই মুরগির কোরমাকে উৎসবের রান্না হিসেবে বিবেচনায় রাখেন, আর ফার্মে পালিত মুরগিকে উপেক্ষা করে যান দেশি মুরগির স্বাদের কাছে। আওধের রুচিশীলদের কাছেও মুরগি ব্যাপারটা পানশে ছিল, তার প্রমাণ মেলে আবদুল হালিম শারারের গুযিশ্তা লখনৌ বইয়ে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, মুরগিকে কস্তুরী আর জাফরানের বড়ি খাইয়ে মোটাতাজা করা হতো, যতক্ষণ না ওগুলোর শরীরের রন্ধ্রে এই দুই উপাদানের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।
সবাই যেহেতু কস্তুরী আর জাফরান খাওয়ানো মুরগির ব্যয় বহনে সক্ষম ছিলেন না, তাই মাংসের পানসে স্বাদ দূর করতে রসুন, লবণ আর দইয়ের মিশ্রণে কয়েক ঘণ্টা জারিত করে মসলা দিয়ে ভেজে নিতেন, কারির জন্য পানি দেওয়ার খানিক আগে, যেন মসলা ভালোমতো মাংসের ভেতরে ঢুকে যায়। কেবল মুরগিই ব্যবহার হতো আওয়াধি কোরমায়, এমন নয়; শিকার করা হরিণ, তিতির, বটেরও বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। কারণ, বিধিনিষেধ আরোপের আগে শিকার ছিল বেশ জনপ্রিয় অবসর কাটানোর উপায়। এখন আওধে অর্থাৎ লখনৌয়ে বটেরের কোরমা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে খামারে বড় হওয়া তিতির-বটেরের কল্যাণে।
এবারে ছোট্ট করে বলি বাংলার কোরমার গল্প। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতায় বসলে খাবারেও এর প্রভাব পড়ে। তবে সুবাহ বাংলায় ব্রিটিশদের আনাগোনা আরও অনেক আগে থেকেই চলছিল, ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম ভারতে পা রাখে মসলার ব্যবসা করতে। বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের আগে কোরমা কেমন ছিল, তার বর্ণনা না পেলেও ব্রিটিশ আমলের কোরমার বর্ণনার অভাব নেই। বাংলার কোরমার এখনকার যে রূপ আমরা দেখি, তার অবদানও এই ব্রিটিশদের। তাদের হাতে পড়েই বাংলার কোরমার স্বাদ খানিক মিষ্টি, যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা সেই তুর্ক বা তুর্কির আদি খাবার বলি, স্বাদ খানিক ঝালের দিকে, এমনকি উত্তর ভারতেও তাই। ব্রিটিশরা এ দেশে এলে তাদের খানসামারা ঝালে অনভ্যস্ত জিহ্বায় খানিক শান্তির পরশ দিতেই এই কোরমার প্রবর্তন করেন। ১৮৮০ সালে প্রকাশিত, অনামা লেখকের দ্য ইন্ডিয়ান কুকারি বুক: প্র্যাকটিক্যাল হ্যান্ডবুক টু দ্য কিচেন ইন ইন্ডিয়া বইয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া, হিন্দুস্তানি এই কারি সবচেয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ [সম্ভবত মসলার ব্যবহার বুঝিয়েছেন], কিন্তু ইউরোপীয়দের জন্য অনুপযুক্ত, যদি আসল রন্ধনপ্রণালি অনুসরণ করে রান্না করা হয়…।’ এরপর তিনি আসল রন্ধনপ্রণালি বর্ণনা করেছেন। তিনি তিন রকমের কোরমার উল্লেখ করেছেন, প্লেইন কোরমা কারি (যেটায় তিনি খাসির মাংস রান্নার প্রক্রিয়া বলেছেন); আরেকটি কিড, অর্থাৎ কচি পাঁঠার আর শেষটি হলো ফাউল কোরমা, সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কচি মুরগি দিয়ে। তিনি আবার বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লিখেছেন, ইউরোপীয়রা মুরগির কোরমা পছন্দ করতেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল কুকারি বইয়ে মিসেস গ্রেস জনসন দুটো কুরমাহ্র উল্লেখ করেছেন, একটি ঘি ও ক্রিম দিয়ে আর অন্যটা মাখন ও দই দিয়ে ছাগ মাংসের। আ বেঙ্গল কারি নামে একটা রেসিপি পাওয়া যায় ১৮৭০ সালে বের হওয়া দ্য নাবোব’স কুকারি বুক নামের বইয়ে, যেটার রন্ধনপ্রণালি ব্যাপারটাকে কোরমার দিকে ইঙ্গিত করে।
এখন পর্যন্ত পাওয়া বাংলার প্রথম রন্ধনপ্রণালির বই বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার বিরচিত পাক রাজেশ্বর: বেরিয়েছিল ১৮৩১ সালের আগস্টে ও দ্বিতীয় বই ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত ব্যঞ্জন রত্নাকরে ২০টির বেশি প্রলেহ তথা কোরমার পদের খোঁজ মেলে, যার ভেতরে কেবল মাংস নয়, বরং বিভিন্ন সবজি আর মাছও রয়েছে। ১২৯৬ বঙ্গাব্দে শৌখিন খাদ্য পাক এবং তারও আগে অন্তত ছয়টি খণ্ডে পাকপ্রণালি বইয়ের সম্পাদক শ্রীবিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের বইগুলোতেও বেশ কয়েক পদের কোরমার খোঁজ পাওয়া যায়—মাংস, সবজি আর মাছের এবং বলা বাহুল্য, তার সব কটির স্বাদই মিষ্টি। ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত দিঘাপতিয়ার অকালপ্রয়াত রানি কিরণলেখা রায়ের বরেন্দ্র রন্ধন বইয়েও রয়েছে কোরমার বর্ণনা। তবে তার ‘কোর্ম্মা’র সংজ্ঞাটা দেওয়া জরুরি, যা পশ্চিম এশিয়া থেকে বাংলা—সব জায়গার জন্যই অভিন্ন—‘অধিক ঘৃতে জল সংস্পর্শ না করিয়া কেবল অম্ল রস (দধির) দ্বারা মৃদু আঁচে পক্ব অপেক্ষাকৃত বৃহৎ মাংসখণ্ডকে “কোর্ম্মা” বলে।’ পাকপ্রণালিতে রয়েছে শুষ্ক প্রলেহ, যার সংজ্ঞা দিয়েছেন লেখক—‘ঝোল না রাখিয়া পানক সহিত মাংস পাক করিলে তাহাকে শুষ্ক প্রলেহ কহিয়া থাকে।’ পাক রাজেশ্বর: ও ব্যঞ্জন রত্নাকরে প্রলেহ বলে উল্লেখ করা হলেও পরের বইগুলোতে আর ইংরেজি বইগুলোতে এগুলো কোরমা নাম নিয়েই রয়েছে।
বৃহত্তর ঢাকার কোরমা কেমন ছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় হাকিম হাবিবুর রহমানের বইয়ে। তবে তারও আগে একবার উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৮৬০ সালে মৃত্যুবরণ করা বেগম বাজারের মির্জা গোলাম পীর রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম ১২ দিন ঈদ-ই-মিলাদ-উন-নবী উপলক্ষে বড় বড় ডেগে করে নিজ তত্ত্বাবধানে পোলাও আর কোর্মা রান্না করে বিভিন্ন মহল্লায় পাঠাতেন বলে উল্লেখ করেছেন সৈয়দ মুহাম্মাদ তাইফুর তার ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা বইয়ে। হাকিম সাহেব কোরমাকে রুটি ও ভাত দুটোর সঙ্গে খাওয়ার উপযোগী বলে উল্লেখ করলেও শেষে বলেছেন, এটা রুটি-খাদ্যের বাদশা। ঢাকার কোরমায় মাঝেমধ্যে গোলমরিচের ব্যবহার হলেও কাঁচা মরিচের ব্যবহার হতো না একেবারেই, বরং তিনি কাঁচা মরিচের বীজ ফেলে দুধে ভিজিয়ে রেখে যে কোরমাসদৃশ খাবার তৈরি হয়, তাকে বলেছেন, ঢাকার বাবুর্চিদের মুনশিয়ানার ফসল—রেজালা। এটাও একধরনের কোরমা, যা শুরুতে কেবল মোরগের হতো, পরে খাসির হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরে দুধে ভেজানো কাঁচা মরিচ বা গোটা কাঁচা মরিচের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। তিনি আরও উল্লেখ করেন মালাইয়ের ও বাদামের কোরমার। ঢাকার দম পোখতও কোরমার অন্তর্গত ছিল, লখনৌয়ের মতোই, আর সেটা হতো মোরগ ও বাঁধাকপির, আলুরও। ঢাকার বিক্রমপুরের দিকে দুধ দেওয়া কোরমার চল রয়েছে। সেখানে কাঁচা মরিচের পাশাপাশি বিশেষভাবে প্রক্রিয়া করা ধনিয়াও ব্যবহার করা হয়।
ঢাকা থেকে বা বাংলা থেকে প্রলেহ রান্না উঠে গেছে, কোরমাও চিনিসর্বস্ব, পুরোনো খাবারগুলো আর আগেকার স্বাদ নিয়ে ফিরে আসছে না আমাদের কাছে। থ্যাংকস গিভিং ডে বা ডেজ অব স্যাক্রিফাইসের সময় পুরোনো খাবারের যে চর্চা ও আলোচনা হয় পশ্চিমে, আমাদের এলাকার খাবার নিয়ে তার সিকিভাগও হয় না। আর এভাবেই হারিয়ে যাবে আমাদের প্রলেহ, রেজালা ইত্যাদি সব খাবার।

i আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top