skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I গ্লোবাল লেদার মার্কেট

পোশাক থেকে অ্যাকসেসরিজ—ফ্যাশনেবল যেকোনো অনুষঙ্গ তৈরিতে চামড়ার ব্যবহার মান বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি। তবে এ নিয়ে বিতর্কও এখন বিশ্বব্যাপী। টেকসই বিকল্প নিয়েও চলছে নানান নিরীক্ষা। লিখেছেন সারাহ্ রুশমিতা

রিসার্চ সেন্টার গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের মতে যুক্তরাষ্ট্রের লেদার মার্কেটের আকার ২০২০ সালে ছিল ৩৯৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন। ২০২১ সালে তা হয়েছে ৪০৭ দশমিক ৯২ বিলিয়ন। গবেষণা অনুযায়ী এই বাজারের আকার ২০২১ থেকে ২০২৮ সালে বছরে ৫ দশমিক ৯% হারে বাড়ার কথা। বাজার বড় হওয়ার অন্যতম কারণ, বর্তমানে চামড়া দিয়ে তৈরি পণ্য স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসেবে বেশ সমাদৃত হচ্ছে; যা ক্রেতার কেনাকাটার ধরন দেখে ধারণা করা যায়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোতেও বেড়েছে চামড়ার ব্যবহার। জর্জিও আরমানি, বারবেরি, প্রাডা, ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানায় নিয়মিত আসছে চামড়ায় তৈরি পণ্য।
করোনার নেতিবাচকতা এড়াতে পারেনি চামড়াশিল্প। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ খানিকটা। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এই বাজার। ফুটওয়্যারে লো ডিমান্ড এই ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অনেকখানি। সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব দেখতে পায়, মহামারির কঠিন সময়ে প্রচণ্ড উদ্যমে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে চামড়াশিল্প। চীনে বসে লেদার প্রডাক্টসের ফ্যাশন শো। নতুন স্টাইলের জ্যাকেট, ক্রস স্টিচড ট্রেঞ্চ কোট, ট্রাভেল ব্যাগ, লেদারের স্নিকার, ডাফেল ব্যাগ, এনকেল বুটস প্রদর্শিত হয় এই শোতে। এই এক উৎসবে একত্র হন চামড়াশিল্পের হাজারখানেক উদ্যোক্তা।
এরপরে পুনরায় চাহিদার পারদ ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে ক্রেতার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। পণ্য উৎপাদনকারী ব্র্যান্ডগুলো এই চাহিদার জোগান দিতে পণ্য উৎপাদন বাড়ায়।
২০২০ সালে আসল চামড়ায় তৈরি পণ্যের মার্কেট শেয়ার ছিল ৫৫%। জেনুইন লেদারের পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় বাজারে সিনথেটিক লেদারের চাহিদা তৈরি হয়েছে। ডিজাইনের ক্ষেত্রেও এ ধরনের র ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারে নিরীক্ষা করা যায় সবচেয়ে বেশি। আর্টিফিশিয়াল সোর্স থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে এটি। পলিইউরেথিন ও পলিভিনাইল ক্লোরাইড ব্যবহার করা হয়। পলিইউরেথিনকে পলিভিনাইল ক্লোরাইডের চেয়ে খানিকটা বেশি প্রকৃতিবান্ধব মনে করা হয়।
চামড়াপণ্যের বাজারে বিস্তৃত রাজত্ব ফুটওয়্যারের। ৪৭% মার্কেট শেয়ার রয়েছে এটির। এর মাঝে অ্যাথলেটিক ফুটওয়্যারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। নাইকি, নিউব্যালেন্স, পুমা, রিবক, অল বার্ডস, কনভারস চামড়ার জন্য স্বতন্ত্র লাইন নিয়ে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০২১ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে হোম ডেকর এবং হোম ফার্নিশিংয়ের চাহিদা বিশাল আকার ধারণ করবে।
চামড়া সংগ্রহের জন্য প্রতিবছর ১৫৯ মিলিয়ন পশু জবাই করা হয় বলে জানা গেছে। পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব অ্যানিমেলসের (পেটা) তথ্যমতে, চামড়া সংগ্রহের জন্য জবাই করা হয়ে থাকে কুকুরও। কুমির, বাঘ, অ্যালিগেটর, অস্ট্রিচ, টিকটিকি, হাঙরের চামড়াও ব্যবহার করা হয়। যদিও নৈতিকতার দিক থেকে এই প্রাণীর চামড়া সংগ্রহের অনুমতি নেই বেশির ভাগ দেশে।
পৃথিবীর মানুষ এখন পরিবেশবান্ধব ও ফ্যাশনসচেতন। সম্পদের সীমিত ব্যবহারে মনোযোগী তারা। চেষ্টা করছেন দূষণ কমিয়ে শূন্যে আনার। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ধরণীকে সুস্থ রাখার। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। পৃথিবীব্যাপী জনসংখ্যা বাড়ছে। নিয়মমাফিক এরই সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যচাহিদা। নিরামিষের সঙ্গে সঙ্গে আমিষ ভোজও চলছে। পশু জবাই তাই বেড়েছে। চামড়াও সহজে পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে চামড়াশিল্পে নাম লিখিয়েছে নতুন নতুন ব্র্যান্ড। আবার বেশ কিছু ব্র্যান্ড তাদের লাইনে যোগ করেছে লেদার গুডস। নতুন ধরনের পণ্য আসছে নিয়মিত। নকশার ক্ষেত্রেও নান্দনিকতা দেখা যাচ্ছে। ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে মিল রেখে চলতে হলে চামড়াপণ্য সরিয়ে রাখার সুযোগ নেই—এটা বুঝে গেছে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডগুলো।
২০২০ সালের তথ্যমতে নর্থ আমেরিকায় চামড়াশিল্পের প্রসার সবচেয়ে বেশি। পুরো বাজারের ৩৪% এই অঞ্চলে বিকোয়।
ব্রাজিল, রাশিয়া, সাউথ আফ্রিকা, ভারত, চীন—এই দেশগুলোর অর্থনীতির দ্রুতগামিতা প্রভাব তৈরি করেছে চামড়ার বাজারের বিকাশে। এসব দেশে শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম। চামড়ার পণ্য তৈরিতে তাই এসব অঞ্চলে খরচ কম। শ্রমিকের সহজলভ্যতা, পশুর চাহিদা, চামড়ার প্রাপ্যতা—এই তিন মিলে দেশগুলোকে এগিয়ে রেখেছে চামড়াশিল্পে। ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে চামড়াপণ্যের বাজার আরও প্রসারিত হবে ইউরোপ, এশিয়া প্যাসিফিক, সেন্ট্রাল এবং সাউথ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাতে।
বিশ্ব চামড়া বাজারের কয়েকটিতে চামড়ার গুণমান অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই উৎপাদনকারীরা চেষ্টা করছেন উচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ করে পণ্য তৈরি করার। ব্যবহার করছেন কম রাসায়নিক। কিন্তু ক্রেতাদের মাঝে এই সচেতনতাবোধকে সাধুবাদ জানিয়ে ‘গ্রীনার’ পণ্য কিনতে আগ্রহী হওয়ার ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। কেননা, মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এতে। তুলনামূলক বেশি মুদ্রা ব্যবহার করতে হচ্ছে। ডিজাইনার স্টেলা ম্যাককার্টনি এ ধরনের চামড়া ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করেন।
চামড়ায় তৈরি পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে লাগেজের নকশায়। সাউথ আফ্রিকার লুই ভিতোঁ, কোচ, আইএনসি, কেরিং এসএ, প্রাডা এবং এরমেস লাইফস্টাইল লাগেজ ও চামড়াপণ্য তৈরির ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে আছে।
চামড়াপণ্য ব্যবহার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর না হলেও শুরু থেকে শেষ অবধি চামড়াপণ্য তৈরির প্রক্রিয়া বিষাক্ত। এ পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান কারসিনোজেনিক ক্রোমিয়াম।
বিভিন্ন পশুর চামড়া ব্যবহার করা হয় পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে। তবে সব থেকে নরম চামড়া পাওয়া যায় বাছুরের গায়ে। সদ্য জন্ম নেওয়া বাছুরের চামড়ায় তৈরি পণ্যের টেক্সচার হয়ে থাকে কোমল। অনেক সময়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই গাভির পেট কেটে সংগ্রহ করা হয় বাছুরটি। নৃশংস শোনালেও সত্যি এটাই। এ ধরনের কাজ অনৈতিক। কিন্তু নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে, এই ঘটনা চামড়া উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ঘটছে। এর কারণ, স্পর্শে কোমলতার অনুভূতি দেওয়া পশুর চামড়ার চাহিদা রয়েছে বিশ্বের সব প্রান্তের ধনীদের কাছে।
করোনা-পরবর্তীকালে চামড়াশিল্পে প্রভাব পড়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। সমগ্র ভারতবর্ষের ৩০% চামড়াপণ্য সরবরাহ করে কানপুর। আয় করে ৬ হাজার কোটি রুপি। পুরোটাই আসে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আরব ও চীনের বাজার থেকে। বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কানপুরের বাজারকেও ছুঁয়েছে। রোজকার বাজারে খরচ হচ্ছে আগের থেকে অনেক বেশি। ব্যবসার কাঁচামাল কিনতেও প্রয়োজন পড়ছে বেশি পয়সা। তাই ভালো নেই কানপুরের কারিগরেরা।
চামড়াশিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। লাইনিন আমদানি করা হয় তাইওয়ান থেকে, রাসায়নিক এবং র হাইডস আসে ইউরোপ থেকে, অ্যাডহেসিভ আসে ইতালি ও জার্মানি থেকে। চীন থেকে আসে ট্রিমস এবং অলংকরণের সরঞ্জাম। খোদ চীনে বারবার লকডাউন এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধাবস্থা সহজে কোনো প্রয়োজন সম্পন্ন করতে দিচ্ছে না। দরকার হচ্ছে অতিরিক্ত সময় ও খরচ।
চামড়াপণ্য নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত বিশেষজ্ঞরা। দেলাওয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে কাজ চলছে পরিবেশবান্ধব চামড়া তৈরির। কটন ও ফ্লাস্ক ব্যবহার করে তৈরি করা হয় এ ধরনের চামড়া। সঙ্গে থাকে পাম, ভুট্টা, সয়াবিনসহ অনেক কিছু। স্তরে স্তরে তৈরি করা হয় এটি। দেখতে মনে হবে কোনো পশুর দেহ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে উৎপাদন করা হয়েছে। এতে ট্যানিং পদ্ধতি ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে দূষিত হবে না পরিবেশও। ব্রিদেবেল গুণ আছে এটির। অর্থাৎ, বাতাস আটকে রাখে না। চলাচল করতে দেয়। আবার লো কার্বন ফুটপ্রিন্ট হয় এর কারণে। ইকো ফ্রেন্ডলি এই লেদার থেকে পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে প্রথাগত সেলাই ব্যবহার করা হয় না। ফলে লেদার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। আশা করা যাচ্ছে, এটি থেকে তৈরি করা যাবে জুতা, হাতব্যাগসহ নানা পণ্য। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। নাইকি, পুমা, অ্যাডিডাস স্যাম্পল চেয়েছে ইতিমধ্যেই। আগামী দিনে ব্র্যান্ডগুলোর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব চামড়াপণ্য মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে মিশে যাবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top