skip to Main Content

টেকসহি I পরিবেশ পরিচর্যা

২৬ সেপ্টেম্বর। ওয়ার্ল্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ ডে। কেমন আছে পরিবেশ? আমরা সবাই কম-বেশি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তবু আরেকটু গভীরে ঘেঁটে দেখা যাক। লিখেছেন সাদিয়া আফরিন শায়লা

মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি নতুন বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের কারণে প্রাণ হারিয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার জন। এত বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণকেই প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ওই গবেষণায়। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০২০’ নামক মার্কিন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওই একই বছর এ দেশে ১ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে মূলত বায়ুদূষণজনিত রোগে। ২০১৭ সালের তুলনায় বায়ুদূষণে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে ৫০ হাজারের বেশি। কিন্তু পরিবেশদূষণ মানে কি শুধুই বায়ুদূষণ? ল্যানসেটের গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে পানিদূষণের কারণে অকালমৃত্যু ঘটেছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষের। দক্ষিণ এশিয়ার এই বদ্বীপরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যার এই হার বাড়া বেশ উদ্বেগজনক। এর চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, পরিবেশগত সুস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের দেশে নেওয়া হয় না তেমন কোনো জোরালো উদ্যোগ।
মানুষের সুস্থতার সঙ্গে পরিবেশের যে সম্পর্ক, তা নিয়ে কাজ করে ‘এনভায়রনমেন্টাল হেলথ’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, পরিবেশগত যেসব বাহ্যিক কারণ মানুষকে শারীরিকভাবে প্রভাবিত করে, সেগুলো নিয়েই কাজ করা হয় এনভায়রনমেন্টাল হেলথের অধীনে। এ ছাড়া সেসব পরিবেশগত বিষয়ের মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কাজ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই শাখা। এনভায়রনমেন্টাল হেলথের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশগত স্বাস্থ্যসমস্যার নির্দিষ্ট কারণ তালিকাবদ্ধ করা। আমরা যে বায়ুতে শ্বাস নিই, যে পানি পান করি, যে খাবার খাই, যে গাড়ি চালাই, যে বাড়িতে থাকি—সবই পরিবেশগত স্বাস্থ্যসমস্যার কারণ হতে পারে। এনভায়রনমেন্টাল হেলথ যেসব পরিবেশগত বিষয় নিয়ে কাজ করে, সেগুলোর মধ্যে স্যানিটেশন ও পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
বর্তমানে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পরিবেশগত ঘাতক হিসেবে অভিহিত করা বায়ুদূষণে দুনিয়াজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৯১ শতাংশই এমন সব এলাকায় বাস করে, যেখানে বায়ুর গুণমান নিম্ন পর্যায়ের। গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ডেটা প্ল্যাটফর্ম—আইকিউ এয়ারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বায়ুর মান ছিল সবচেয়ে খারাপ। একই তালিকায় রাজধানী ঢাকা জায়গা করে নেয় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত শহর হিসেবে। রান্নার চুলার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া, কারখানার ধোঁয়া, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ইত্যাদি নানা কারণে বাতাসে ক্ষতিকর পার্টিকেলের মাত্রা বেড়ে যায়। এসব উৎস থেকে উদ্ভূত পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) বা সূক্ষ্ম কণা, কার্বন মনোক্সাইড, পলিঅ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন এবং উদ্বায়ী জৈব যৌগ আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। উল্লিখিত গ্যাসগুলোর কণার ব্যাস অপেক্ষাকৃত ছোট হওয়ায় তা সহজেই আমাদের শ্বাসনালির ক্ষতি করতে পারে। এমনকি রক্তের সঙ্গে মিশে এসব কণা দেহে অক্সিজেনের চলাচল ব্যাহত করতে পারে। এসব কণা নিউমোনিয়া, স্ট্রোক, ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার থেকে শুরু করে যক্ষ্মা, ছানি, নাসোফ্যারিঞ্জিয়াল ও ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসারের জন্যও দায়ী। বায়ুদূষণের প্রভাব কমাতে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা কয়লা পোড়ানোর হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তা কতটা সুফল বয়ে আনবে, সেটি এখনো ভাবার বিষয়।
ভারতের ন্যাশনাল ডেইরি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষ মলমূত্রমিশ্রিত পানি পান করে। এ ছাড়া দূষিত পানি পান করে বছরে প্রাণ হারায় এক মিলিয়ন মানুষ। পানিদূষণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত উপাদানটি হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে, ৫ মিলিমিটারের কম আকৃতির প্লাস্টিক মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত। আকারে বেশ ছোট হওয়ায় এগুলো সহজেই আমাদের টিস্যুতে প্রবেশ করতে পারে। টুথপেস্ট, প্রসাধনী, রং, নাইলন বা পলিয়েস্টারের সিনথেটিক ফাইবারে থাকে এ দ্রব্য। নদী-নালা, খাল-বিলের পানিকে দূষিত করে পরিশেষে সমুদ্রের পানিতে গিয়ে মেশে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক। স্বাভাবিকভাবেই, এসব প্লাস্টিক বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে, যা পরবর্তীকালে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুতন্ত্রে সরাসরি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার কলের পানির ৯৪ শতাংশেই রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এমনকি বিশ্বের ১১টি জনপ্রিয় পানির বোতল উৎপাদনকারী দেশের বোতলজাত পানির ৯৩ শতাংশেই এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই দূষণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে বেশ কিছু বৈশ্বিক সংস্থা। সম্প্রতি ভারতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বা একবার ব্যবহার করা যায় এমন প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শাকসবজি, পানির উৎস মাটির নিচ থেকে আসে বলে মানুষের স্বাস্থ্য মাটির গুণমানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। মাটির দূষণ ঘটলে প্রাথমিকভাবে তা শোষণ করে নেয় উদ্ভিদ। পরবর্তীকালে সেই উদ্ভিদ মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী গ্রহণের মাধ্যমে মাটির দূষিত পদার্থ প্রবেশ করে খাদ্যশৃঙ্খলে। মূলত রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটায় মাটির ব্যবহার, শিল্পদূষণ, বন উজাড়, পেট্রোলিয়ামজনিত বায়ুদূষণ এবং মাটিতে ইলেকট্রনিক ও চিকিৎসাবর্জ্য জমা হয়ে মাটির গুণমান নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা অত্যাবশ্যক হলেও অন্তত ২ শতাংশ থাকা চাই-ই চাই। অথচ বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২ শতাংশের কম। রাজধানী ঢাকার আশপাশের পানির উৎসগুলো এতই দূষিত যে, তা আর বিশুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি গবেষণা করে দেশের মাটিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩৮ গুণ বেশি কোবাল্ট এবং ১১২ গুণ বেশি ক্রোমিয়ামের সন্ধান পেয়েছে। নিকেল, কোবাল্ট, ক্রোমিয়াম ও কপারের মতো ভারী ধাতুগুলো উদ্ভিদের জন্য বিষতুল্য এবং আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও পারদ প্রাণীদের পক্ষে বিষাক্ত। এসব পদার্থ প্রাণীর স্নায়বিক ক্ষতির পাশাপাশি কিডনির স্বাভাবিক কাজও ব্যাহত করে। পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন এবং মাটিতে যাতে রাসায়নিক বর্জ্য না মেশে, সে লক্ষ্যে কাজ করছে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো।
পানি-মাটি-বায়ুদূষণ ছাড়াও এনভায়রনমেন্টাল হেলথ জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রভাব নিয়েও কাজ করে। ব্যাপকভাবে বন্য প্রাণী হত্যা, চাষের জন্য বন্য জমি অধিগ্রহণ, আবাসিক এলাকা নির্মাণ এবং গভীর বনাঞ্চলে খনি উত্তোলনের মাধ্যমে মানুষ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে থাকে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডব্লিউএফ) প্রকাশিত ২০২০ সালের লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্টে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সাল থেকে তাদের নিরীক্ষণ করা বিভিন্ন জীবের বৈচিত্র্য গড়ে ৬৮ শতাংশ কমেছে। এমনকি কয়েকজন বিজ্ঞানীর মতে, আমরা বর্তমানে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। গবেষণায় দেখা গেছে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্টের ফলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী। জীববৈচিত্র্য কমতে থাকায় তার প্রভাব পড়েছে বাস্তুসংস্থান ও খাদ্যশৃঙ্খলেও। বর্তমান বিশ্বে ৪৭ মিলিয়ন শিশু (৫ বছরের কম বয়সী) এবং ১৪ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অপুষ্টির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না।
এনভায়রনমেন্টাল হেলথের অধীনে মানব স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব নিয়েও আলোচনা করা হয়। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুতর যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তা হলো তাপমাত্রার অতিরিক্ত বৃদ্ধি। সম্প্রতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন ও গ্রিসের বিভিন্ন বনে মারাত্মক দাবানলের সৃষ্টি হয়। প্রাণ বাঁচাতে এসব দেশের হাজার হাজার নাগরিককে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। মাটি-পানি-বায়ু এসবের সম্মিলিত দূষণই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। এ পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে তাপমাত্রা, অন্যদিকে গলছে বহু বছর ধরে জমে থাকা হিমবাহ। বিশ্বের বেশির ভাগ স্বাদুপানি উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বরফ আকারে জমা আছে। জমে থাকা এসব হিমবাহ পুরোপুরি গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৭০ মিটার বাড়বে। যদিও এটি আমাদের জীবদ্দশায় হওয়ার শঙ্কা নেই বললেই চলে; কিন্তু এই শতাব্দীর শেষভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে ১ থেকে ২ মিটার বাড়তে পারে, তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। পরিমাণে তেমন বেশি না হলেও এই এক-দুই মিটার বৃদ্ধিতেই সংকটে পড়বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ। এমনকি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে অনেক দেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বড় অংশও। নেচার জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২ মিটার বাড়লে বাস্তুচ্যুত হবে প্রায় ৬৮০ মিলিয়ন মানুষ।
এশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত জনবহুল আমাদের এই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা, খুন কিংবা অপঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা কিন্তু কম নয়। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ হাজার ২৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশদূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হলেও তা এখনো নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়নি তেমন কোনো বিশেষ পদক্ষেপ। ক্রমশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো উদ্যোগ নেবে কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top