skip to Main Content

ফিচার I মিষ্টিমুখর দুর্গাপূজা

দুর্গাপূজার পুরোটা জুড়ে মিষ্টান্নের ছড়াছড়ি। বাঙালি হিন্দুরা সেসবে ধরে রাখতে চান আদি বাঙালিয়ানা। অবশ্য প্রযুক্তির বদৌলতে নতুন নতুন মিষ্টিও যুক্ত হচ্ছে পূজার উৎসবে। তবে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিগুলোই রাঙিয়ে তোলে পুরো সময়টা

বাঙালি যেখানে আছে, মিষ্টি থাকবেই। উৎসব-পার্বণে সেই মিষ্টির ফর্দ আরেকটু বড় হয়। বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মমতা নিয়ে মা ঠাঁই নেন তার সন্তানদের অন্তরে। তাই ছেলেমেয়েদের মনে আনন্দ। ফ্যাশন হাউস থেকে মিষ্টির দোকান—সবেতেই সেই উৎসবের রেশ। এত বড় একটা আনন্দজুড়ে মিষ্টি থাকবে না, তা কি হয়? তাই তো মায়ের আগমন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত মিষ্টির ছড়াছড়ি।
পূজার উৎসবের শুরুতেই দেখা যায়, মা-মাসিরা বাড়ির অন্দরে লেগে পড়েছেন নাড়ু তৈরির কাজে। কোরানো নারকেল, দুধ ও মসলার সুবাস বাড়িজুড়ে ভিন্ন এক আবহ নিয়ে আসে। উপকরণ মিশিয়ে চুলায় চড়ালে সে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কখনো কখনো এ-বাড়ি ও-বাড়ির কোনো পার্থক্য থাকে না। সবাই মিলে হাত লাগান নাড়ু তৈরিতে। সঙ্গে বাড়ির শিশুরাও। কারও কারও তো তর সয় না। নাড়ু ঠান্ডা হওয়ার আগেই মুখে পুরে জিভ পোড়ায়! তবে নাড়ু বানাতে বসলে ভিন্ন একটা সুবাস মেলে। সেটা ঘিয়ের ঘ্রাণ। বাড়তি মসলাপাতি ফেলে দিয়ে হাতে ঘি মেখে নাড়ু গোল করা হয়। এভাবেই শুরু হয় দুর্গা মায়ের আগমনী আনন্দ।
তারপর আসে সপ্তমী। দুর্গা মাকে বরণ করে নিতে লাগে নানা ধরনের মিষ্টি। এর মধ্যে মুখ্য হলো রসগোল্লা ও সন্দেশ। এ ক্ষেত্রে নলেন গুড়ের সন্দেশ যেন একটু বেশিই প্রাধান্য পায়। তবে পূজায় এই সন্দেশ লাগবেই, তা নয়। মূলত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে এটি। শীতকালে খেজুরগাছ থেকে পাওয়া রস দিয়ে বানানো হয় নলেন গুড়। এই গুড়ের আলাদা সুবাস রয়েছে। ফলে এটি দিয়ে তৈরি সন্দেশের সুবাস অন্য কোনোটিতে মেলে না। তা ছাড়া কিছু ময়রা আছেন, যারা নলেন গুড়ের সন্দেশ তৈরিতে বিশেষ দক্ষ। অন্যরাও পারেন, তবে দক্ষদের হাতে এর স্বাদ একটু বেশি খোলতাই। তারা দুধের ছানাযোগে এই সন্দেশ তৈরি করেন। কিছু স্থানে দুর্গাপূজায় এ গুড়ের পায়েসও রান্না করা হয়। এখন অবশ্য যুগ বদলেছে। মানুষ হয়েছে আরও আধুনিক। তাই পূজার সন্দেশেও এসেছে বৈচিত্র্য। এখন গাজরের সন্দেশও তৈরি হয় পূজা-পার্বণে। তবে নলেন গুড়ের পরে যেটির বেশি কদর, সেটি হলো ক্ষীরের সন্দেশ।
আরও আছে রসগোল্লা। এটি বাঙালিদের একেবারে নিজস্ব মিষ্টি। ফলে অন্যান্য মিষ্টির চেয়ে এর সম্মান একটু বাড়তি। মা দুর্গাকে বরণ করতে এই দেশি পদই চাহিদার শীর্ষে। বাড়িতে রসগোল্লা তৈরির চল অবশ্য অনেকটাই উঠে গেছে। সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মিষ্টির দোকানিরা। তাই এই উৎসবজুড়ে ময়রাদের মুখে থাকে আনন্দের হাসি। মায়ের আগমনে তাদের ভাগ্যও যেন ফুলে-ফেঁপে ওঠে। অবশ্য এ কদিন তাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। তা ছাড়া অন্য সময়ের চেয়ে দুর্গোৎসবের মিষ্টিগুলো তারা একটু আলাদা আবেগ নিয়েই তৈরি করেন। মায়ের মিষ্টি বলে কথা। তবে মাকে বরণ করতে যারা দোকানের রসগোল্লায় ভরসা পান না, তারা ঘরেই তা তৈরি করতে পারেন। ছানা, ময়দা, সুজি ও মসলা মিশিয়ে মুখরোচক রসগোল্লা তৈরির রেসিপি সহজেই মিলবে অন্তর্জালে।
এরপর অষ্টমী। সেদিনও আছে সন্দেশের উপস্থিতি। ঐতিহ্য ধরে রাখতে অনেক বাড়িতে সেদিন জলভরা সন্দেশ তৈরি করা হয়। দেখতে অনেকটা তালশাঁসের মতো। এ ধরনের সন্দেশ তৈরি শুরু হয়েছিল ১৮১৮ সালে। যদিও জামাইষষ্ঠীতে জামাইকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেটিও এখন দুর্গোৎসবের অংশ হয়ে গেছে। এর ভেতরে গোলাপজল দিয়ে বড় করে সন্দেশটি তৈরি করা হয়। কামড় দিলে ভেতর থেকে গোলাপজল ছিটকে বেরিয়ে জামাকাপড় ভিজে যায়! এটি তৈরিতেও লাগে নলেন গুড়। এ ছাড়া অষ্টমীতে কালাকান্দ মিষ্টি তৈরি হয় বাড়িতে। কিছু স্থানে একে কালাকাঁদ নামেও ডাকে। লেবুর রস দিয়ে দুধ কেটে তাতে ঘি ও এলাচিগুঁড়া মিশিয়ে তৈরি হয় এ ধরনের মিষ্টি।
অষ্টমী ও নবমীর পর দশমী। মায়ের বিদায়ের সুর বেজে ওঠে। উৎসব শেষে মন হয়ে ওঠে বিষণ্ন। তাই বলে মাকে তো আর খালি মুখে বিদায় দেওয়া চলে না। মিষ্টিমুখ করিয়েই বিদায় দেওয়া হয়। বিজয়া দশমীতে একে-অপরের কুশল বিনিময় হয়। এ সময়ে বাঙালির মিষ্টির পাতে থাকে পানতোয়া, সীতাভোগ, মিহিদানা কিংবা বাড়িতে বানানো নাড়ু ও গজা।
যুগ বদলেছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে পৃথিবী এখন যেন হাতের মুঠোয়। তাই খাদ্যসংস্কৃতির অদলবদল খুবই সাধারণ। সংস্কৃতির লেনদেন খুব সহজ হয়ে যাওয়ায় দ্রুতই বদলে যাচ্ছে উৎসব-পার্বণের মিষ্টান্নগুলো। তবু বড় বড় উৎসবে নিজেদের মিষ্টান্নগুলো ধরে রাখতে চান অনেকে। ফলে পূজার দিনগুলোতে দাদাঠাকুরদের আমলের মিষ্টান্ন ফিরিয়ে আনতে চান এ যুগের ঘরনীরা। পূজায় অতিথি আপ্যায়নে তারা তৈরি করেন ছানার পায়েস, মিষ্টি দই, রাজভোগ, পানতোয়া, ল্যাংচা, চমচম, ক্ষীর কদম, কাঁচাগোল্লা ও মিহিদানার মতো একান্ত বাঙালি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিগুলো।
যদিও পায়েসকে অনেকে মোগল আমলের খাবার মনে করেন, তবে ধর্মবর্ণ ভেদ করে এটি এখন সর্বজনীন উৎসবের খাদ্য হয়ে উঠেছে। তাই তো দুর্গাপূজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি থেকে ভেসে আসে পায়েস ও ক্ষীরের মনমাতানো সুবাস। পূজার আরও একটি মিষ্টি অনুষঙ্গ হলো দই। ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের উৎসবে এটির কদর বেশি। একটা সময় এ ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করতেন শুধু ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা। দুর্গাপূজা এলে তাদের বাড়িতে কাজের ধুম পড়ে যেত। ভিড় জমত মানুষের। এখন অবশ্য কিনে কিংবা বাড়িতে তৈরি করে দুর্গাপূজার উৎসব রাঙিয়ে তোলেন অনেকে। পূজার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পানতোয়া। পশ্চিমবঙ্গের কালনা, কাটোয়ার ও রানাঘাটে পূজার সময় এই মিষ্টির উপস্থিতি থাকে বেশি। কেউ কেউ দুর্গোৎসবে বাড়িতে তৈরি করেন ক্ষীরের পানতোয়া।
যুগ যুগ ধরে এ ধরনের মিষ্টি সমৃদ্ধ করেছে দুর্গাপূজার উৎসবকে। মিষ্টান্নে ধরে রেখেছে বাঙালিয়ানা। উৎসব-উপাসনায় প্রাণসঞ্চার করেছে বাঙালির এই মিষ্টান্ন। দুর্গাপূজায় ফিরে ফিরে আসে। ফলে এই মিষ্টির রেসিপিগুলো এগোতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে।

 আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top