skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I বাদশাহ হুমায়ুনের মসজিদে

এই উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। একসময় প্রার্থনাকারীদের পদচারণে মুখর থাকলেও অনেক দিন ধরে পড়ে রয়েছে শুধু স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য ছড়িয়ে। জানাচ্ছেন ফাতিমা জাহান

ভাবুক কবি বাদশাহ হুমায়ুন। দিল্লির পুরানা কিলা বা পুরোনো কেল্লায় গড়েছিলেন নিজের পাঠাগার। দেশি-বিদেশি নানা ভাষার কত যে কিতাব সেখানে! আছে দুষ্প্রাপ্য সব পুঁথিপত্র। পড়ুয়া বাদশাহ বই পড়তেন। নামাজও পড়তেন নিয়মিত। রাজকার্য ভালো লাগে কি না, তা মুখ ফুটে বলতেন না। শুধু এটুকু প্রকাশ করতেন, সাধারণ মানুষের প্রতি তার অগাধ মোহাব্বত আছে; আছে অন্য রাজ্যের প্রতি শ্রদ্ধা। রাজকার্য পরিচালনা তো বংশপরম্পরায় করতে হয়, তা-ই শিরোধার্য। কিন্তু কিতাব, অনুভূতি, বেদনাবোধ—এসব তো এক সমুদ্র। বলা হয়, এই সমুদ্রে যিনি সাঁতার কাটতে জানেন, তিনি অমর হয়ে যান। অন্য মোগল বাদশাহর মতো তরবারির ঝনঝনানি আর রক্তাক্ত ময়দান থেকে জোরেশোরে অন্য রাজ্য জয়ের অ্যায়লান না দিয়ে হুমায়ুন চলে যেতেন বহু দূরে, কিতাবের জগতে।
দিল্লিতে তখত বসানোর কাজ শুরু করেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন কেল্লা আর পাঠাগার। সেই সঙ্গে ইরাদা ছিল একটি মসজিদ তৈরির। মসজিদের কাজ হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু দিনদুনিয়ার মালিকের ইচ্ছায় আর তখতে থাকতে পারলেন না। মোগল সালতানাত দখল করে নিল শের শাহ সুরি। বাদশাহ হুমায়ুন হলেন পলাতক। মসজিদ খোদার মাকান। মসজিদের কাজ অসমাপ্ত রাখা যায় না। শের শাহ সুরি খুব জলদি সেরে ফেললেন মসজিদের বাকি কাজ। ১৫৪১ সালে ওই মসজিদের নাম হলো কিলা-এ-কুহনা। সেখানে নামাজ পড়তেন শের শাহ সুরি। অবশ্য ক্ষমতার সিক্কা ওল্টাতে সময় লাগে না। পনেরো বছর পর আবার মোগল সালতানাত ফিরে পেলেন বাদশাহ হুমায়ুন। আমাদের নাজুক দিল বাদশাহ এই মসজিদের পাশেই থাকতেন নিজ পাঠাগারে। মসজিদে বাদশাহর নামে পাঠ করা হতো খুতবা। তখতে পুনরায় বসার এক বছরের মাথায় একদিন পাঠাগারের সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ওফাত হলো কাব্যপ্রিয় বাদশাহর। মসজিদে উঠল মাতম। পাঠাগারের প্রতিটি কিতাব ঝরাল অশ্রু!
এমন কাব্যিক বাদশাহর মসজিদ দেখতে গেলাম জোহর ওয়াক্তে। কে জানে শেষ কবে এ মসজিদে গান গেয়ে ফিরে গেছে বুলবুলি। দিল্লিতে এখন বসন্তকাল। চারদিকে লাল টকটকে শিমুল গুল চঞ্চল করে সব পথিককে। কে কবে শহর রাঙানোর অভিলাষে এত এত শিমুলগাছ লাগিয়েছিল, কে জানে! রং ছড়িয়ে উছলে পড়ছে শহর।
পুরানা কিলা নাকি হিন্দু পুরাণের ইন্দ্রপ্রস্থ শহরের একটি জায়গা ছিল একসময়, লোকে বলে। আমি জানি না বিশদ। কিলা নির্মাণের কাজ বাদশাহ হুমায়ুন হাতে নিয়েছিলেন ১৫৩৮ সালে। অন্য মোগল স্থাপনার মতো একই অবয়বের বহিরাংশ এই কিলার। বাইরের দিকে লালচে গোলাপি স্যান্ডস্টোন; ধূসর পাথরের মজবুত দেয়াল। ভারতবর্ষের পুরোনো দুর্গগুলোর অন্যতম এই কিলা। বসন্তকালের কোমল বাতাসের মতো রং দুর্গের অন্দরমহলের। গাছের সবুজ, ঘাসের সবুজ আর বহু দূরে দূরে একেকটি ভবন দাঁড়িয়ে। এই বিশাল চত্বরের চারদিকে চারটি দ্বার বা দরওয়াজা আছে। মূল দরওয়াজা এতই উঁচু, পাঁচতলা ভবনের বরাবরি করতে সক্ষম। দওয়াজার উপরিভাগে আটকে আছে ঝুলবারান্দা। হাতি, ঘোড়া চলে যেতে পারে—এত বিশাল দ্বার; আর সূক্ষ্ম এর বদনের কারুকাজ। শিল্পে খামতি রাখেননি আমাদের কবি দিলের বাদশাহ। মোগল স্থাপত্যশিল্প তখন সবে নকশাদার করা শুরু করেছে ভারতবর্ষকে। সেই মিঠে লগনের অনন্য উদাহরণ এই পুরানা কিলা।
আমি ডানে-বামে কোথাও না তাকিয়ে সোজা চলে গেলাম বাদশাহ হুমায়ুনের পাঠাগারের কাছে। লাল স্যান্ডস্টোন তখন সদ্য দেখে আসা জ্বলজ্বলে শিমুল ফুলের মতো ফুটে রয়েছে সবুজ ঘাসের সিথানে। অষ্টভুজ ভবনের সব পাশে বারান্দা। বারান্দার বাইরে মিহরাব আকার দেওয়া দেয়াল, যেখানে মর্মর পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে ফুলেল নকশা, চাঁদ-তারা। মাথায় গম্বুজ নিয়ে বেশ দোল খাচ্ছে এই রোদে। এই কিতাবখানার ভেতরে এখন প্রবেশ নিষেধ। এ কেমন কথা! আমি কি একটুও দেখতে পাব না সেই সিঁড়ি, যেখান থেকে ভুলোমনা বাদশাহ নামাজ পড়ার ওয়াস্তে জলদি নামতে গিয়ে পড়ে চলে যান খোদার কাছে? এই দুনিয়ার নিয়মকানুন আমাকে সিঁড়ি দেখতে না দিলেও আমি সেই মসজিদ এখান থেকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছি।
মসজিদের দিকে যাই পেছনে ফেলে কিতাবখানা, পেছনে রেখে হুমায়ুন দরওয়াজা। মসজিদের খুব কাছে এখন আমি। আর কয়েক কদম এগোলেই কাছে যেতে পারব সাদা, ফিকে লাল কারুকাজের। কিন্তু তার আগেই একটি লম্বা চকচকে পাথর পার হতে গিয়ে পিছলে পড়লাম। বাদশাহ কি তবে এ-ই চেয়েছিলেন? আমার কি তার মতোই পিছলে পড়া ছিল নসিবে? পিছলে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালাম। দিল্লিবাসী এখনো সদয়। এগিয়ে আসেন। হাল জিজ্ঞেস করেন। আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। আমায় ব্যথা দেবে তেমন যাতনা কি আছে এখানে! দুচোখে আমার খোয়াব, মসজিদে পা বাড়ানোর। মসজিদের সামনে পানির ফোয়ারা। জল কলকল করত কখনো। এখন বিরান। একটি গম্বুজ আর পাঁচ মিহরাব আকার দরজার মসজিদ বাদশাহর। মাঝের দরজায় ঝারোখা খোদাই করা সাদা মর্মর পাথরে। এর উপরিভাগে স্যান্ডস্টোনে আরও লতাপাতার কারুকাজ। ছোট ছোট লাল-নীল পাথর কেটে বসিয়ে ঝারোখা নকশার খুবসুরতি বাড়িয়েছে। ঝারোখা হলো হাজারও ফোকর দেওয়া দেয়াল। ফোকরে করা অনন্য আকার। কোনোটা ফুল, কোনোটা তারা বা অন্য কিছু। গরমকালে হাওয়া যেন এপাশ থেকে ওপাশে ফোকর গলে বইতে পারে, সে কারণে ঝারোখা করে রাখা হতো দেয়ালগুলোতে। নান্দনিকতার জন্যও খ্যাত ছিল ঝারোখা। এখন মসজিদ শুধুই দর্শনার্থীদের। এখানে নামাজ হয় না, দোয়া পড়া হয় না, কারও নামে খুতবা পড়াও হয় না। কে জানে মসজিদের জেহেনে কতই না দুঃখ জমে আছে!
খুব সংশয়ে, মাথা নিচু করে মসজিদের ভেতরে পা বাড়ালাম। মাথা নিচু করেই দেখলাম পায়ের কাছে স্যান্ডস্টোন দেয়ালজুড়ে খোদাই করা নকশা, ফুলের ভেতরে ফুল, তার ভেতরে নিষ্পাপ সুবাস। যেন রঙিন পাথুরে ফুলগুলো আবার দোয়ায় শামিল হতে চায়; চিৎকার করে গাইতে চায় খোদার মহিমা। আমি এখনো মূল দরজায় দাঁড়িয়ে। দোতলায় শ্বেতপাথরের ঝুলবারান্দায় ঝুলছে চন্দনা পাখি। পাখিরা বোধ হয় মানুষের আগে তাবত জগতের মনের খবর পায়। এই যেমন এখন ডেকেই যাচ্ছে, যেন মসজিদকে আর একা থাকতে দেবে না। মসজিদকে একা করে দেন সমস্ত ভুলভাল দর্শনার্থী। গায়ে হাত বোলান, ছবি তোলেন, জোরে জোরে হাঁটেন, অকারণে চেঁচান। বাদশাহ থাকলে ঠিক সাজা পেতে হতো প্রিয় মসজিদকে ব্যথা দেওয়ার দায়ে। এই যে এত নিন্দা করছি সবার, আমি তো এখনো মাথা তুলে তাকাতেই পারিনি মিহরাবের দিকে!
যখন তাকাতেই হবে, চোখ তুলে তখন তাকাই। হে খোদা, আমি কি সত্যি এ দুনিয়ায় আছি? এখনো বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাইনি কেন এই লা-জবাব নকশার সামনে! এখানে ফেরেশতারা যেন খোদাই করেছেন শ্বেতপাথরে গজল। ওপর থেকে নিচ, নিচ থেকে ওপর শুধু খোদার রহমত। আরবি আয়াত, ফুল, লতাপাতা, আবার আরবি আয়াতের বাগিচা দেখলে বুকের রক্ত ছলকে ওঠে। এত সুন্দর মিহরাব আমি ভারতের অন্য কোনো মসজিদে দেখিনি। কেমন করে এত খোদাই খোদার আরশ থেকে মসজিদে নেমে এসেছে? এ তো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়! মনে মনে ভাবি, হয়তো শিল্পী ফেরেশতারা এখনো চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মিটিমিটি হাসছেন আমার দিশেহারা অবস্থা দেখে। এমন সৌন্দর্যের সামনে দিশেহারা না হয়ে কী উপায়? নিজের মানত পূরণ করতে হলেও এই ফেরেশতাদের সান্নিধ্য আমার চাই!
মিহরাবে যে আরবি আয়াত লেখা, তার হরফের ফাঁকে ফাঁকে যেন আমাকে আরও পেরেশান করতেই এঁকে দেওয়া আছে লতাপাতা। মিহরাবের খাঁজে খাঁজে কমল ফুটেছে; উল্টো করে ঝুলে আছে ফুটে ওঠার তাড়নায়। বরফি কাটা নকশার ফাঁকে কালো লাল পাথরের উঁকিঝুঁকি। ওরা হয়তো ভাবছে, এত দিন নিশ্চুপ আছি, এখনো কি সময় হয়নি ফেরেশতাদের সঙ্গে কথা বলবার, রাতে সবাই চলে গেলে চাঁদের নীরবতা ভাঙাবার!
বলা হয়ে থাকে, মিহরাবগুলোর এই সুদক্ষ কারুকাজ করিয়েছিলেন বাদশাহ আকবর তার শাসনামলে। বাদশাহ আকবর কি তবে জড়ো হওয়া শ্বেতপাথরের আরজি শুনেছিলেন? দিয়েছিলেন পিতার প্রিয় জায়গাকে হিন্দুস্তানের শ্রেষ্ঠ জায়গা?
মাঝারি আকারের মসজিদটির শিরায় শিরায় হু হু করে বইছে বসন্ত বাতাস। নিকটেই বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধি। ভাবছি, যে মসজিদে যাওয়ার তাড়নায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, সেই মসজিদের দুঃখবোধ কি পৌঁছায় তার কাছে?
ভাবনার ঘোরে চক্কর খেতে খেতে আমি অন্দর-বাহিরের অজানা খোলা হাওয়ার খেলা দেখছি। দেখছি শ্বেতপাথরের শ্বেতপত্র লেখা। ফিকে লাল পাথরকে হাওয়ায় উড়তেও দেখছি। সঙ্গে দেখছি ভারতবর্ষের সবচেয়ে সুনেহরা মসজিদ, বাদশাহ হুমায়ুনের মসজিদ।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top