skip to Main Content

যাপনচিত্র I শিশিরে শিল্পে

সামিরা জুবেরী হিমিকা। প্রযুক্তি খাতের প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোক্তা ও সংগঠক। কেমন তার একান্ত জীবন?

হিমিকার ক্যারিয়ারের বাঁকবদল বেশ ইন্টারেস্টিং। ২০০৫ সালে ইউএনডিপিতে কর্মজীবন শুরু। সেখানে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ২০০৭-১১ সময়কালে কাজ করেছেন বিবিসিতে, ডেপুটি হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন হিসেবে। তার মেজাজেই রয়েছে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের স্পৃহা। সময়ের সঙ্গে নিজেকে আবির্ভূত করেছেন উদ্যোক্তা ও সংগঠক রূপে। বর্তমানে বেসিসের (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। তার প্রতিটি কাজের পেছনে রয়েছে দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করার তাড়না। প্রথম কর্মক্ষেত্র হিসেবে ইউএনডিপিকে বেছে নেওয়া মূলত সে কারণেই। এরপর উপলব্ধি করেছিলেন, কাজ যতটা হয়, ততটা প্রকাশ করা যায় না। এই প্রতিবন্ধকতা নিরসনে যোগ দেন বিবিসিতে, গল্পের আকারে সবকিছু সুন্দরভাবে প্রকাশ করার স্বপ্নে। সেই সঙ্গে সেখানে নিজ উদ্ভাবনী প্রতিভা কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল তার। ইংরেজি ভাষাকে সবার কাছে সহজ করে তোলার জন্য চালু করা হয় বিবিসি জানালা, বিবিসি বাজ-এর মতো বেশ কিছু অনুষ্ঠান। তাতে প্রযুক্তি যোগ করে মানুষের কাছে পৌঁছানোর কাজটা সহজ করে তোলা হয়। প্রযুক্তি টিম, রিসার্চ টিম, কমিউনিকেশন টিমের সমন্বয়ে ও পরিশ্রমে যোগ করা হয়েছিলেন আইভিআর, যেখানে লিসেনাররা ৩৩৩-এ কল করে ১ মিনিট কথা বলতে পারতেন। প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২ কোটি সাবস্ক্রিপশন পেতে সক্ষম হয় সেই উদ্যোগ। তাতে হিমিকা দেখেছেন, প্রযুক্তির সাহায্যে কত দ্রুত সময়ে অধিক সাড়া পাওয়া সম্ভব।
হিমিকার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বিষয় প্রযুক্তি না হলেও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেন এর গুরুত্ব। নিজেকে উদ্যোক্তা ও সংগঠক হিসেবে গড়ে তোলার পথে বেছে নেন এই খাত। কর্মজীবনে তার পদচারণ ছিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টর, ইন্টারন্যাশনাল সেক্টর, প্রাইভেট সেক্টর, গভর্নমেন্ট সেক্টরের ট্রেডবডিতে। এসব ক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে তিনি বুঝতে পারেন দৃষ্টিকোণের ভিন্নতা।
ব্যক্তিজীবনে হিমিকার দিন শুরু হয় সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে। ঘুম থেকে আগে ওঠার এই অভ্যাস চর্চা করছেন দুই বছর ধরে। কেননা, তিনি বুঝতে পেরেছেন, যতটা সকালে ওঠা যায়, দিনটি ততই দীর্ঘ হয়; সেই সঙ্গে প্রথম দুই ঘণ্টা একান্তই নিজেকে সময় দেওয়া যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে গাছে পানি দেন, পোষা পাখিগুলোর সঙ্গ উপভোগ করেন। ফিটনেসের জন্য বাসাতেই করেন ইয়োগা ও স্ট্রেচিং। হিমিকা বলেন, ‘ব্যস্ত জীবনে হুট করে জিমে যাব বললেই যাওয়া হয় না। তবে আমি এখন একটা ওয়ার্মআপ সেশনে আছি। শিগগির জিমে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।’
ব্রেকফাস্ট সারেন সকাল ৯-১০টার মধ্যে। মেনুতে থাকে গ্লুটেন ফ্রি খাবার। থাকে চালের রুটি, ফ্রুটস, অ্যালোভেরা জুস প্রভৃতি। ব্রেকফাস্টকে অবশ্য ‘ব্রাঞ্চ’ বলতে চান তিনি। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাঞ্চ করা হয় না তার। দুপুরে খাবারের পর আলস্যবোধ অন্যতম কারণ। এ ছাড়া শরীরের ভাষা বুঝে খাওয়ার সময় নির্ধারণের পক্ষপাতী তিনি। বাইরের খাবারে একেবারেই অভ্যস্ত নন। এড়িয়ে চলেন যেকোনো ধরনের প্রসেসড ফুড।
এরপর শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। ই-মেইল করা, ফোন কলে অ্যাটেন্ড করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ সামলানো। অফিসের বাইরেও বেসিসের মতো সাংগঠনিক অনেক কাজ সামলাতে হয়। তার নিজেরই রয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গিগাটেক লিমিটেড। অন্যগুলো হলো ইনস্পায়রা অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড কনসাল্টিং লিমিটেড, টিম প্ল্যাটফর্ম এবং টিম ইঞ্জিন। সব প্রতিষ্ঠানকে সময় দেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তার মূল কাজ ভেবেচিন্তে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা। সেই সঙ্গে পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ধারণ, কোয়ালিটি মেইনটেইন, সেলফ সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিত করা তার অন্যতম দায়িত্ব। হিমিকার মতে, বড় কিছু কোম্পানি ও হাউসের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশে বেশির ভাগ কোম্পানিতে প্রতিষ্ঠাতাদের নিজেরই সংযুক্ত থাকার প্রবণতা রয়েছে, যা দিনশেষে সার্বিকভাবে ক্ষতিকর। তাই গিগাটেকে নিয়মিত সময় দিয়ে, নিজের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তুলনামূলক কম সময় দেন হিমিকা। এর কারণ, সেসব প্রতিষ্ঠান সেলফ সাসটেইন্ড এবং সেগুলো নিজেদের মতোই পরিচালিত হয়ে থাকে।
অনেকের হয়তো জানা নেই, হিমিকা গানেরও মানুষ। ২১ বছর গান শিখেছেন। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্ল্যাসিক্যাল, নজরুলগীতি ও দেশাত্মবোধক গানের দীক্ষা নিয়েছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। বরেণ্য শিল্পীদের কাছ থেকেও নিয়েছেন দীক্ষা। খেয়াল, ঠুমরি, গজলের মতো ক্ল্যাসিক্যাল গানও রপ্ত করেছেন। মাঝখানে গানে বিরতি নিলেও সুরের জগতে ফিরতে চান শিগগির। অন্যদিকে, শ্রোতা হিসেবে তিনি ভার্সাটাইল। গুলাম আলী, মেহেদী হাসান, জগজিৎ সিং, অ্যাডেল, হুইটনি হিউস্টন, ওয়ারফেজ, তুহিন (আভাস), আইয়ুব বাচ্চু, মানাম আহমেদ, সামিনা চৌধুরী, শাহনাজ রহমতুল্লাহ প্রমুখের গানে বুঁদ হয়ে থাকেন। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, আরবি, স্প্যানিশ, জাপানিজ—যেকোনো ভাষার গানই তার ভালো লাগে। অসম্ভব পছন্দের গান ওয়ারফেজের ‘অবাক ভালোবাসা’।
হিমিকা বলেন, ‘অন্তর থেকে আমি একজন আর্টিস্ট। তাড়না ও অনুরাগের জায়গা থেকে একজন উদ্যোক্তা। তাই আশপাশে আর্ট না থাকলে ভালো লাগে না।’ তার ঘরের দেয়ালজুড়ে সাজানো রয়েছে আঁকা পেইন্টিং; আর নানা ধরনের বই ও বাদ্যযন্ত্র। আলোকসজ্জায় তার পছন্দ ওয়ার্মলাইট। হিমিকা একজন মেমোরি কালেক্টর। তার কালেকশনে যা-ই থাকুক না কেন, এর পেছনে জমে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। ছোটবেলার খেলার মার্বেল, হাতে লেখা চিঠি, ডাকটিকিট থেকে শুরু করে কী নেই তার সংগ্রহে!
পোশাকের ক্ষেত্রে দেশীয় শাড়ি, ওয়েস্টার্ন, ফিউশন—সবই পছন্দ হিমিকার। শাড়িকে তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর পোশাক মনে হলেও খুব একটা স্বস্তিবোধ করেন না এই পোশাকে। ‘ড্রেস বেছে নিতে গুরুত্ব দিই কমফোর্ট উইদ স্টাইলকে,’ বলেন তিনি। সাটেলনেস পছন্দ; মাল্টিকালার বা প্যাটার্ন পছন্দ করেন না। ফ্যাশন ব্যাপারটি তার কাছে স্টেটমেন্ট ও আইডেন্টিটি। স্টাইলের ক্ষেত্রে নিজেকে গ্লোবাল পারসন মনে করেন; তবে বাংলাদেশের শিকড়ের কথাও মাথায় রাখেন। সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, এমন জুয়েলারি পরতে পছন্দ করেন। তার সংগ্রহে রয়েছে আফ্রিকান জুয়েলারি, ইরানি কানের দুল, ভারতীয় নূপুর থেকে শুরু করে নানান দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পারফিউম পছন্দ করেন বেশ; সবচেয়ে পছন্দের ব্র্যান্ড হোয়াইট ক্রিড।
হিমিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রায় ৩০টি দেশে। যেখানেই গেছেন, সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বশীল জিনিসপত্র। ভ্রমণে সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ভুটান, যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহর, উজবেকিস্তান, তানজানিয়া ও আফ্রিকা। ২০১৮ সালের ইউরো ট্রিপ তার কাছে অবিস্মরণীয়। সেবার ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের নানা দেশ ঘুরেছেন। বলিউড সিনেমা ‘জিন্দগি না মিলেগি দোবারা’তে দেখা স্পেনের বার্সেলোনা শহরের সৌন্দর্য, লা টমাটিনা ফেস্টিভ্যাল তার কাছে দারুণ স্মৃতি হয়ে রয়েছে।
ব্যস্ততার কারণে বই পড়ার সুযোগ পান না খুব একটা। তবে তার আড্ডার সার্কেলে রয়েছে পাঠকের প্রাধান্য। পছন্দের লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী, বাণী বসু, আবুল বাশার প্রমুখ। হিমিকা নামটি তার বাবার রাখা, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাস থেকে। শবনম ও হিমিকা—দুটি শব্দেরই অর্থ শিশির। শুধু তা-ই নয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর সার্বিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করতে পারেন—এমনটাই দাবি হিমিকার।
প্রকৃতিপ্রেমী হিমিকার ইচ্ছে আছে গ্রিনহাউস করার—শুধু নিজের জন্য। প্রকৃতিতে একধরনের আত্মিক সংযোগ খুঁজে পান তিনি। পশু-প্রাণীর প্রতি রয়েছে গভীর মমত্ববোধ। রেসকিউ মিশনের অংশ হিসেবে নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন অনেকগুলো কুকুর। সংকটকাল কেটে গেলে সেগুলোকে অ্যাডপটেশনে দিয়ে দিয়েছেন। পোষা পাখি আছে চারটি; ওদের নাম রেখেছেন জোজো, পাপাই, কোকো ও সুপার।
সময় পেলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুভি কিংবা টিভি সিরিজ দেখেন। ইনভেস্টিগেটিভ স্টোরি তার পছন্দ, সেটা শার্লক হোমস থেকে শুরু করে ফেলুদা—যা-ই হোক। শেফ টেবিলসের মতো ফুড, ট্রাভেল রিলেটেড কনটেন্ট দেখেন বেশ। পছন্দের সিনেমা ইনভিকটাস, রাং দে বাসান্তি, রেহানা মরিয়ম নূর প্রভৃতি। এ ছাড়া জাপানিজ মাস্টার ফিল্মমেকার ও অ্যানিমেটর হায়াও মিয়াজাকির যেকোনো কনটেন্ট, হলিউড ফিল্মমেকার কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর যেকোনো সিনেমা এবং ইরানি সিনেমাও তার বিশেষ পছন্দ।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: রনি বাউল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top