skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I রামসেস ও নেফারতারি আখ্যান

দ্বিতীয় রামসেস। তিন হাজার বছরের অধিককাল আগের এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফেরাউন বা রাজা। প্রাচীন মিসর শাসন করতেন রূপসী ও বিচক্ষণ স্ত্রী নেফারতারিকে পাশে নিয়ে। কালের ধুলোয় হারিয়ে যায়নি তার স্বাক্ষর; বরং সোনালি রঙে জ্বলজ্বল করছে নানা মিথ হয়ে। এই রাজা ও রানির মন্দির ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

ঘুম থেকে উঠেছি রাত দুটোয়। ঘুমিয়েছি সাকল্যে এক ঘণ্টা। এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে ভীষণ কৌতূহল। এর আগে নাকি এদের বাড়িতে ভারতবর্ষ থেকে আসা কোনো ট্যুরিস্ট আতিথ্য গ্রহণ করেননি। ছেলেমেয়েরা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছয় ভাইবোন এরা। আর যে দ্বীপের আতিথ্য আমি গ্রহণ করেছি, তার নাম এলিফেন্টিন আইল্যান্ড। মিসরের আসওয়ান শহরের বুকের মধ্যিখানজুড়ে নীল নদে পা ভিজিয়ে বসে থাকে এ দ্বীপ। আরও মজার ব্যাপার হলো, মিসরের কয়েকটি বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি নুবিয়ান। তাদের অধ্যুষিত দ্বীপ এটি। এ বাড়িটাও নুবিয়ানদের বলেই আমি এদের এখানে থাকার আগ্রহ বোধ করেছি।
এ বাড়ির নাম বাকার হাউস। ছেলেমেয়েদের বাবার নাম বাকার, মায়ের নাম ফাতিমা। খুব মিষ্টি নারী। এই পরিবারের সঙ্গে থাকতে এসে একটুও মনে হয়নি আমি ভারতবর্ষে নেই। এদের আপ্যায়ন, ভালোবাসা তো আমাদের অঞ্চলের মতোই। এলিফেন্টিন আইল্যান্ড আর আসওয়ান শহর ছাড়াও আশপাশে বেড়াতে যাওয়ার মতো আরও একটি জায়গা রয়েছে, নাম আবু সিম্বেল। এখান থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরে।
এলিফেন্টিন আইল্যান্ড থেকে অপর পাশের আসওয়ান শহরে যেতে হয় নৌকায়, নীল নদ পার হয়ে। এই দ্বীপে কয়েকটি ঘাট আছে। অনেক বাসিন্দার আবার ব্যক্তিগত নৌকাও আছে। বাকার হাউসেরও আছে। রাত দুটোয় বাকার হাউসের সবাই দেখি সজাগ। আমি তৈরি হতেই এদের বড় ছেলে আহমেদ বলল, ‘চলো, তোমাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ ঘাটে এসে দেখি কেউ নেই। মরুভূমির তপ্ত বাতাসও নেই। শীতলতা ছড়াচ্ছে নীল নদ। ঘাটে মাঝি নেই; তাই আহমেদ বলল, ‘তোমাকে নদ পার করে দিয়ে আসি।’ এই পুঁচকে ছেলে নৌকা চালিয়ে আমাকে পার করবে! জানতে চাইলাম, ‘তুমি নৌকা চালাতে জানো?’ বলল, ‘চেষ্টা করে দেখতে পারি!’ এই ছেলে কী বলে! শেষমেশ বেড়াতে এসে ডুবে মরব নাকি! ভয়ে ভয়ে নৌকায় বসলাম। ইঞ্জিনচালিত নৌকা। আহমেদ দেখি ঠিকমতোই চালাচ্ছে। একসময় অপর পাশের ঘাটে এসে ভিড়লাম। আসলে আহমেদ নৌকা ভালোই চালাতে জানে। এলিফেন্টিন দ্বীপের সবাই কম-বেশি নৌকা চালাতে পারেন।
ওপাড়ে অপেক্ষা করছিল ট্যুরিস্ট গাড়ি। আবু সিম্বেল এতই দূরে আর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তেমন নেই, তাই ট্যুরিস্ট গাড়িতে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করতে হয়। এই গাড়িতে আমি ছাড়া আরও এগারোজন যাত্রী রয়েছেন। কেউ উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকার, কেউ ইউরোপের। আমি একা এশিয়ান। এখান থেকে আবু সিম্বেল যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘণ্টা। গাড়ি ছাড়ার আগমুহূর্তে দেখি, আহমেদ দৌড়ে এদিকেই আসছে। আমি কিছু ফেলে আসিনি তো? আহমেদ তো পনেরো মিনিট আগেই বিদায় নিয়েছিল। আমার কাছে এসে সে বলল, ‘মা তোমার জন্য স্ন্যাকস পাঠিয়েছেন। আমি তখন আনতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ অনেকেই আফ্রিকান, নুবিয়ানদের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন; কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। এদের আতিথেয়তায়, ভালোবাসায় প্রতিবারই আমি অভিভূত।
সময়মতো গাড়ি ছাড়ার পর জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। এখনো রাতের অন্ধকার মুছে যায়নি। বাইরের কিছুই স্পষ্ট নয়। ঘণ্টাখানেক বা তার চেয়ে একটু বেশি সময় বোধ হয় ঘুমিয়েছি, হঠাৎ চোখ খুলে গেল। দিনের আলো এখন অল্প অল্প সুবহে সাদিকে ছড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি যেন স্বপ্নের রাজ্যে চলে এসেছি ঘুম থেকে জেগে। চারদিকে সোনালি রঙের জগৎ। যেদিকে তাকাই, স্বর্ণরঙা মরুভূমি, কোথাও পাহাড়। সোনালি রং ঠিকরে যেন আলো বের হচ্ছে। এ এক সোনারঙা দুনিয়া। মনে হলো, আমি জেগে জেগেই হয়তো স্বপ্ন দেখছি। আরেকটু চোখ মুদে থাকি বরং।
মিনিট কয়েক পর চোখ খুলে দেখি, আরও অনেক আজব চিত্র ঝাঁকে ঝাঁকে ছুঁয়ে যাচ্ছে গাড়ির জানালা। আমার ভ্রম হয়নি। ঠিকই দেখেছি। এ যে রাশি রাশি সোনালি বালি দিয়ে তৈরি মরুভূমি। সোনালি প্রান্তর আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু এত নিখাদ, এত নিখুঁত সোনালি মরুর দেশ আগে দেখিনি। সোনার গয়নায় যেন আচ্ছাদিত সমস্ত দিগন্ত। ভোরের সোনালি আলো, সোনালি মরুভূমিতে এক ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে দিয়েছে। যত দেখি, দেখার তেষ্টা বাড়ে তত। কে কার চেয়ে বেশি আভা ছড়াবে, এ যেন তার প্রতিযোগিতা চলছে। পথ চলতে চলতে এই সোনালি সমতল প্রান্তরে হঠাৎ দেখা মিলল এক পিরামিডের। গিজার পিরামিডের চেয়ে আকারে ছোট। তা হলোই বা, পিরামিড তো পিরামিডই। গন্তব্যে পৌঁছলাম সকাল ছয়টায়। মাঝরাতে রওনা হওয়ার কারণ সকাল সকাল আবু সিম্বেলের টেম্পল বা মন্দির দেখে যেন ফিরতে পারি। কারণ, সকাল আটটার পর বাইরে লু হাওয়া এবং গরমে ঘোরাঘুরি করার জন্য যে ধরনের মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা দরকার, তা সবার থাকে না।
আবু সিম্বেল টেম্পল নির্মাণ করেছিলেন সে সময়কার মিসরের সবচেয়ে প্রতাপশালী, পরাক্রমশালী, নির্ভয়, শক্তিশালী ফারাও বা ফেরাউন দ্বিতীয় রামসেস, আনুমানিক ১২৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ফারাও শব্দের অর্থ রাজা। ফারাও দ্বিতীয় রামসেস বিখ্যাত ছিলেন বিভিন্ন রাজ্য জয়, সাহস আর ক্ষমতার জন্য। সেই সঙ্গে সমালোচিত হয়েছিলেন আত্ম-অহমিকার কারণে।
দ্বিতীয় রামসেসের পিতা পূজা করতেন সেথ দেবতার। রামসেস নিজের ক্ষমতাকালে সেথ দেবতার পূজার আয়োজন করেছেন সবচেয়ে বেশি। আর নিজের সৌকর্য ও শৌর্য বজায় রাখার জন্য নির্মাণ করেছেন এই মন্দির। এটি একটি পাহাড়ের সম্মুখভাগ খোদাই করে নির্মিত। সম্মুখভাগে দ্বিতীয় রামসেস ও তার প্রিয়তমা রানি নেফারতারির বিশাল আকারের চারটি মূর্তি রয়েছে। সবই সোনালি স্যান্ডস্টোনে গড়া। মূর্তিগুলোর ঠিক মাঝখানে মন্দিরে প্রবেশের দরজা। দরজার ডান পাশে রামসেস ও নেফারতারি যেভাবে সিংহাসনে বসে আছেন, ঠিক একইভাবে বাঁ পাশেও বসা তারা। তাদের পায়ের কাছে প্রিয় সন্তানদের ছোট ছোট মূর্তি।
দ্বিতীয় রামসেস তার শাসনামলে এতই বিখ্যাত ছিলেন, সমস্ত পৃথিবী তাকে ‘রামসেস দ্য গ্রেট’ নামে জানত। নিজের মন্দির নির্মাণের জন্য তিনি নাসের লেকের নীল জলের তীরে এমন একটি পাহাড় বেছে নিয়েছিলেন, যার অভ্যন্তরে গুহা ছিল। এই মন্দিরের সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই সামনে পড়ে রামসেসেরই আটটি দণ্ডায়মান মূর্তি। এগুলো মুখোমুখি দাঁড়ানো। চারটি সারি সারি ডান পাশে, চারটি বাঁ পাশে। আর ভেতরে, ডানে-বাঁয়ে এই পাহাড়ের গুহায় মোট দশটি কক্ষ রয়েছে। ভেতরে ঘুটঘুটে, গা ছমছমে অন্ধকার। পায়ের কাছে অল্প কয়েকটি হালকা পাওয়ারের লাইট না থাকলে কিছুই চোখে পড়ত না।
প্রথম কক্ষের ওপর, নিচ, সিলিং কিংবা ভেতরের ছাদ—সব জায়গায় হায়ারোগ্লিফিকসে রাজা রামসেসের বীরত্বগাথা আঁকা। একেকটি চিত্র একেক ঘটনা বর্ণনা করে এই বিখ্যাত বীর ফারাওয়ের। কোথাও রামসেস সিংহাসনে উপবিষ্ট, প্রজাদের কাছ থেকে নৈবেদ্য নিচ্ছেন, কোথাও ঘোড়ার গাড়িতে যুদ্ধে যাচ্ছেন, কোথাও শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন, কোথাও নিজের সেনাবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করছেন, কোথাওবা শত্রুকে শাস্তি দিচ্ছেন। প্রতিটি চিত্র রঙিন তুলি দিয়ে নিখুঁতভাবে রং করা। একদম শেষের কক্ষে রাজা রামসেস, রানি নেফারতারি ও দেবতা এক আসনে পাশাপাশি বসে আছেন; মানে সেখানে তাদের মূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে আগাগোড়া খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিকস। কোথাও সামান্য জায়গা ছাড়েনি অপূর্ব এই শিল্প।
পাশের পাহাড়ে নির্মিত হয়েছে সুন্দরী, গুণবতী, বুদ্ধিমতী রানি নেফারতারির মন্দির। নেফারতারি ছিলেন দ্বিতীয় রামসেসের প্রিয়তমা ও প্রধান রানি। ফেরাউনদের মাঝে বিরলতম ইতিহাস গড়েছিলেন রাজা রামসেস। রাজকার্য পরিচালনায় রানিকে পাশে রাখতেন। রাজদরবারে রানির মতকে গুরুত্ব দিতেন। রানির বুদ্ধিমত্তা এতই প্রখর ছিল, রাজার মৃত্যুর পর কিছুদিন তার হাতে ছিল রাজ্যের শাসনভার। তখনো প্রজারা ছিলেন অনুগত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। রানি নেফারতারির সৌন্দর্য নিয়ে দেশে দেশে প্রচলিত আছে অনেক কল্পকাহিনি।
রানির মন্দিরও রাজার মন্দিরের আকারসদৃশ। বহিরাংশে রাজা ও রানির একই আদলের ছয়টি মূর্তি দণ্ডায়মান। চারটি রাজা রামসেসের, দুটি রানি নেফারতারির। রাজা, রানি, রাজা…এরপর সদর দরজা, আবার রাজা, রানি, রাজা…। দণ্ডায়মান রানির দুহাত জড়ো করে বুকের কাছে গোটানো। এই মন্দিরের অন্তঃপুরে এখন কেউ নেই। সামনে লেক নাসেরের হাওয়া গায়ে ঝাপটা দিচ্ছে। সকাল সাতটা বাজে, কিন্তু রোদ ইতিমধ্যেই তাতিয়ে উঠছে। দ্বাররক্ষী খুব শখ করে আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি কি রানির মন্দিরের চাবি দেখতে চাও?’ আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই বের করে দেখালেন। আকারে বিশাল। তামার তৈরি। বললেন, ‘হাতে নিয়ে ছবি তোলো।’ আমার হাতে নেফারতারির ঘরের চাবি, ভাবতেই পারছি না! এই চাবি ঘুরিয়ে রানি নেফারতারি রাজ্য পরিচালনা করেছেন; পেয়েছিলেন ভালোবাসা আর আনুগত্য।
রানির মন্দিরটি আকারে ছোট। প্রথম কক্ষের প্রতি স্তম্ভের উপরাংশে রানির মুখ খোদাই করা; আর দেয়াল, সিলিংয়ে তার মহত্ত্ব হায়ারোগ্লিফিকসে আঁকা। নেফারতারি শব্দের অর্থ সুন্দরী সঙ্গী। বলা হয়ে থাকে, এই অনন্যসুন্দরীর রূপচর্চার উপকরণ আসত দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে।
মন্দিরের ভেতরের দিকে আরও তিনটি কক্ষে একইভাবে হায়ারোগ্লিফিকসের নকশা কাটা। আধো আঁধারের খেলা গুহার ভেতরে। কোথাও রানি সিংহাসনে; কোথাও তিনি রাজার সঙ্গে পানীয় পানে, আনন্দে মত্ত; কোথাও তাকে উপঢৌকনে সমৃদ্ধ করছে প্রজাকুল, ফুল দিয়ে বরণ করছে। এত ঐশ্বর্য, এত রাজকীয়তা দেখে চোখে এক আবেশ তৈরি হয়; সঙ্গে যোগ হয়েছে সোনালি মরু প্রান্তর, যেন পৃথিবীর সব স্বর্ণ জড়ো করে সাজানো হয়েছে এই স্বপ্নসাগর। মরুভূমির বালিকে মনে হয় এক সোনালি সাগর। দূর থেকে দূরে দুলে দুলে ওঠে কেবল!
মিসরকে অনাদিকাল থেকেই বলা হয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সৌন্দর্য, শিল্প, রুচি ও রহস্যে ঘেরা এক দেশ। এই রহস্য উদ্‌ঘাটন করার চেয়ে আরও অনেক রহস্যের মাঝে জড়িয়ে যায় পথিক হৃদয়; জানতে চায় আরও অনেক রহস্যের গল্প। সে কারণেই সব জানা কখনো সম্ভব হয় না। কাটেনা ভ্রমণের রেশ।

ছবি: লেখক

This Post Has One Comment
  1. খুব ভাল লাগল । লেখিকা ভারী সুন্দর করে ধরেছেন রহস্যঘেরা মিসরকে। ছবিদুটোই চমৎকার। কিন্তু চাবিটার ছবি দেখতে পেলাম না।
    আরও লেখা চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top