skip to Main Content

মনোযতন I বদ্ধ-বদ্ধ-ভয়!

ক্লাস্ট্রোফোবিয়া। আক্ষরিক অর্থে, সীমাবদ্ধ স্থানের ভয়। সহজ কথায়, আবদ্ধতাভীতি। চেনা মনোরোগ। অচেনা বিপদ! আশিক মুস্তাফার লেখায় বিস্তারিত

ঘরের ভেন্টিলেটরের ফুটোতে বাসা বাঁধা এইটুকুন চড়–ইপাখি দিব্যি সাঁতার কেটে সাগর পাড়ি দিতে পারে আত্মবিশ্বাসের বলে। ভাবতে পারেন অতি পরিচিত প্রাণী শামুকের কথাও। ওদের হাবভাব দেখলে মনে হয়, এই বুঝি দুই গজও আগাতে পারবে না। অথচ এই শামুকেরাই টানা মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। এটাও শামুকের আত্মবিশ্বাসের ফল। অথচ এর অভাবে আপনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকেন ঘরের কোণে। হয়তো বলবেন, পৃথিবীর কোন প্রাণী ভয় পায় না, শুনি!
হুম্, ঠিকই; ভয় সবাই পায়। ভীতি নামের বৃক্ষ সবার মনেই মাথাচাড়া দিয়ে থাকে! তাই তো কারও ভয় তেলাপোকায়, কারও মাকড়সায়। কেউ আবার উঁচু থেকে নিচুতে তাকানোর ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই যে নানান মানুষের নানান ঠুনকো ভয়, একটু চেষ্টা করলে এবং আত্মবিশ্বাস রাখলে এগুলো থেকে মুক্তি মেলে অনায়াসে। এমনতর ভয় যদি নিজের ভেতর থেকে তাড়াতে না পারেন, তাহলে ক্লাস্ট্রোফোবিয়া নামক একচোখা এক দানব ধীরে ধীরে আপনাকে নিয়ে যাবে অতল গহ্বরে!
হে ক্লাস্ট্রোফোবিয়ান!
অযৌক্তিক ভয়, মানে যার মাধ্যমে মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়, আপাতদৃষ্টে তা আসলে মোটেই ভয় পাওয়ার কিছু নয়; এমন ভয় আপনার ভেতর কাজ করলে বুঝতে হবে, আপনি ক্লাস্ট্রোফোবিয়ায় ভুগছেন। ধরুন, ছোট রুম দেখলে, লিফটে উঠলে কিংবা গাড়ির গ্লাস বন্ধ থাকলে যদি ভয় পান, তাহলে ধরে নিতে পারেন, আপনি একজন ক্লাস্ট্রোফোবিয়ান! অনেকে অবশ্য আরও এক ধাপ এগিয়ে। মানে কেউ কেউ স্যালনে গিয়ে চুল কাটার চেয়ার দেখলে ভয় পান; বাস কিংবা ট্রেনের টিকিটের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে ঘাবড়ে যান কিংবা এটিএম বুথের সামনের লাইনটা একটু দীর্ঘ দেখলে ওপথে আর পা মাড়ান না ভয়ে!
এ ছাড়া যদি ক্লাস্ট্রোফোবিয়া থাকে, তাহলে আপনি বিমানে বসে উদ্বিগ্ন হতে পারেন এই ভেবে যে, এই বুঝি আপনাকে পালাতে হবে; অথবা ভাবতে থাকেন, একটু পরেই যদি অক্সিজেন ফুরিয়ে যায়, নিশ্বাস নেবেন কেমন করে! এসব ভাবতে ভাবতে যদি আতঙ্ক আপনাকে গ্রাস করে নেয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের মুখোমুখি হয়ে সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি।
ভয়ের আহ্বান
হুটহুাট এসব ভয় আপনার ভেতর উঁকি দিতে পারে। আবার চলেও যেতে পারে। তবে এমনটা খুব কমই ঘটে। তাই ছয় মাস নিজেকে পর্যবেক্ষণ করুন। যদি এ সময়কালের ভেতর কোনো সীমাবদ্ধ স্থান কিংবা জনাকীর্ণ জায়গায় থাকার বিষয়ে নিরন্তর উৎকণ্ঠা অনুভব করেন, তাহলে ধরে নিতে পারেন আপনি ক্লাস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত। তবু বলি, যেসব সীমাবদ্ধ স্থানে থাকলে ক্লাস্ট্রোফোবিয়া আপনাকে ‘আয়-আয়…’ ডাকতে পারে, সেগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য কয়েকটি হলো লিফট, গণশৌচাগার, বিমান, উঁচু দালান, সিল করা জানালাওয়ালা হোটেল কক্ষ, সুড়ঙ্গ, সেন্ট্রাল লকিং কার, টিউব ট্রেন, ঘূর্ণায়মান দরজা প্রভৃতি।
কারণ সন্ধান
গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি এক শ জনের মধ্যে পাঁচজনই এই মনোরোগে ভোগেন। বয়স্কদের চেয়ে টিনএজার ও তরুণেরাই ঝুঁকিতে বেশি। সবার ক্ষেত্রে প্রভাব এক রকম না হলেও, কারও মধ্যে একবার এই রোগ বাসা বাঁধলে তা দীর্ঘদিন ভোগাতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ক্লাস্ট্রোফোবিয়া মূলত শৈশবে পাওয়া বড় ধরনের কোনো আঘাত থেকে তৈরি হতে পারে। টিনএজার ও তরুণদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্করাও এতে ভুগতে পারেন। কেন? এর কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে একাধিক বিষয়। যেমন শৈশবে যদি কেউ কোথাও আটকা পড়েন কিংবা কোনো কোটর অথবা সীমাবদ্ধ জায়গায় আটকে রেখে তাকে উৎপীড়ন বা নির্যাতন করা হয়, তবে বয়স বাড়লেও তিনি ক্লাস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তা ছাড়া বাবা-মায়ের ক্লাস্ট্রোফোবিয়া থাকলে তা সন্তানকেও আক্রান্ত করতে পারে।
লক্ষণ পাঠ
আপনার মনে উৎকণ্ঠা যখন চরমে ওঠে, তখন কি নিজের ভেতর এই লক্ষণগুলো খুঁজে পানÑ
 শ্বাসকষ্ট অনুভব করা;
 হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত হওয়া;
 ঘাম দেওয়া;
 কাঁপুনি ওঠা;
 বমি বমি ভাব হওয়া;
 মাথা ঘোরা;
 মুখ শুকিয়ে আসা;
 হাইপারভেন্টিলেশন;
 বুকে টান লাগা বা ব্যথা করা;
 বিভ্রান্তিতে ভোগা;
 মাথাব্যথায় ভোগা;
 আচমকা অস্বাভাবিক গরম কিংবা ঠান্ডা লাগা;
 মানসিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় কাজ করা;
 জ্ঞান হারানোর শঙ্কায় ভোগা প্রভৃতি।
এ ছাড়া শরীরে অসারতা, শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি কিংবা আচমকা বাথরুমে যাওয়ার অস্বাভাবিক তাগিদ অনুভব করাও এই মনোরোগের লক্ষণ হতে পারে।
সমাধানের পথ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘ভয় শুধু আমাদের মস্তিষ্কেই নয়, শরীরেও বাস করে। আমাদের শরীর বিপদ অনুভব করার জন্য এবং হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে মস্তিষ্কে বিপৎসংকেত পাঠায়। তাই যেসব স্থানে আপনার ভেতর ক্লাস্ট্রোফোবিয়া উসকে ওঠে, সেই স্থানগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন। যদিও এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, আচরণগত থেরাপিতে দক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শে এ থেকে স্থায়ী মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’
ডা. হিমুর মতে, এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পরামর্শও কাজে লাগাতে পারেন। এ ছাড়া নিজেকে বোঝানো দরকার, ‘আজ থেকে আমি আর এই অমূলক ভয় পেতে চাই না।’ নিজেকে বলুন, ‘ক্লাস্ট্রোফোবিয়া একটি অহেতুক ভয়। এই ফোবিয়ায় আমার কিছুই যায়-আসে না!’ যুক্তি দিয়ে ভাবুন। কারণ, যুক্তিতেই দুনিয়া চলে। কাজেই, যুক্তি দিয়ে বিচার করে নিজের ভয় নিজেই দূর করতে পারেন।
লিফটে আয়না রাখা হয় কেন, নিশ্চয় জানেন। আয়নায় নিজেকে দেখে নেওয়ার সুযোগ থাকে। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। আয়নায় ভাবনা আসে। লিফটের সময়টাও তখন আর একঘেয়ে লাগে না। সব সমস্যারই সমাধান আছে। ভয় তাড়াতে লিফটে আয়না লাগানোর মতো সমাধান খুঁজে নিতে পারেন আপনিও।
ফোবিয়া বা আতঙ্ককে প্রশ্রয় দিলে কিংবা লালন করলে তা ক্রমেই গ্রাস করে নেয় ব্যক্তিজীবন। এই আগ্রাসনের কারণ খুঁজতে গেলে নিজের মধ্যে, আশপাশের পরিবেশের মধ্যেই মিলবে জবাব; মিলবে সমাধানও। মনে রাখা চাই, ভয় পাওয়ার অর্থ এই নয়, আপনি বিপদে পড়েছেন। আপনাকে ভয় দেখানোর মাধ্যমে রক্ষা করার জন্য এটি শুধুই শরীরের একটি প্রচেষ্টা। ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই মনোব্যাধি কাটিয়ে ওঠা এবং এর অন্তর্নিহিত কারণের সমাধান ঘটানো নির্ভর করছে একান্তই আপনার ওপর। অবশ্য আপনার যদি ক্লাস্ট্রোফোবিয়া থাকে এবং এর সমাধান নিজে খুঁজে বের করতে না পারেন, তাহলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। যথাযোগ্য চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের মুখোমুখি হোন। খুব সহজে পেয়ে যাবেন পথ। তা ছাড়া একটু সময় করতে পারলে দেখে নিতে পারেন ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া অ্যাডাম শিন্ডলারের চলচ্চিত্র ‘ইনট্রুডারস’। এতে গতি বাড়বে আপনার চলার পথের!

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top