skip to Main Content

যাপনচিত্র I ‘যদিও মডেল নই’

জাহানারা আলম। জাতীয় দলের তুখোড় ক্রিকেটার। শৃঙ্খলাবদ্ধতায় কাটে সময়। এর ফাঁকেও এতটুকু অবসর মিললে, কেমন কাটে তার একান্ত জীবন?

স্বভাবতই ব্যস্ত শিডিউলে দিন কাটে। ফজরের নামাজের পরে আর বিছানায় যান না। মিরপুরে স্টেডিয়ামের পাশেই আবাস। কাকডাকা ভোরে চলে যান স্টেডিয়ামে, ফিটনেস ট্রেনিংয়ের জন্য; বিশেষ করে, রানিং অ্যান্ড জিম সেশন সারতে। তবে কালেভদ্রে অবসর মিললে একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন; অবশ্য সাড়ে আটটার পরে নয়। তারপর বিরিয়ানি রান্নার প্রক্রিয়া শুরু করে সারেন মর্জিমতো ব্রেকফাস্ট। সাধারণত নিজেই রান্না করেন। সুযোগমতো প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো কিনে রাখেন আগে থেকেই। নিজে বাজার করেন। সুপারশপ থেকে; লোকাল মার্কেট থেকেও।
তুখোড় বোলার জাহানারা আলম বললেন, ‘ছুটির দিন মানে আমার কাছে প্রথমত নিজের জন্য সময় বের করা।’ সেটি কেমন হতে পারে? প্রথমেই খাবারের কথা মাথায় আসে: ‘মনের মতো, নিজে রান্না করে নেব।’ তারপর আসে দিনটি কীভাবে কাটানো যায়? কী কী কেনাকাটা বাকি? ‘আমি আসলে কাইন্ড অব শপাহলিক! যেটা পছন্দ হয়, কিনে ফেলি। তবে বাজে কিছু নয়।’ তাই ছুটির দিনে সময় রাখেন শপিং এবং বন্ধুদের সময় দেওয়া ও আড্ডাবাজির জন্য। বই পড়া যেহেতু ট্রেনিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে হয়ে যায়; তাই এদিন একটু বেশি সময় নিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন। এর মধ্যে কোনো স্পেসিফিক প্রোগ্রাম পড়লে দেন গর্জাস সাজ! ‘সাজুগুজু করতে অনেক ভালো লাগে আমার,’ বললেন মুচকি হেসে।
রান্না করতে ভীষণ ভালোবাসেন। বাংলাদেশি সব ধরনের পদই তার নখদর্পণে। কিছু কিছু থাই, ইন্ডিয়ান ও চায়নিজ আইটেমও রাঁধতে জানেন। বললেন, ‘তাড়াহুড়ো নয়, প্রচুর সময় নিয়ে রাঁধতে পছন্দ করি। কারণ, ভুলে যাওয়ার বাতিক আছে আমার! নিজের পুরো সময়টা থাকে ক্রিকেটের মধ্যে। তাই যখন কুকিংয়ে যাই, মনে করি পারফেক্ট করা চাই। এ কারণে বিরিয়ানি রান্নার পেছনে মিনিমাম তিন ঘণ্টা আমাকে রাখতেই হয়।’
এমন দিনে দুপুরে একঝাঁক নারী ক্রিকেটার চলে আসে তার বাসায়। জাতীয় দলের পাশাপাশি আবাহনীর খেলোয়াড়েরা। তাদের সঙ্গে চলে খাওয়াদাওয়া। বলে রাখা ভালো, ২০০৯ সাল থেকে আবাহনীতে খেলছেন জাহানারা। বললেন, ‘আগের দিনই ওরা ফোন করে, “জাহানারা আপু, আমরা কালকে চলে আসছি তোমার বাসায়। তোমার কাল ছুটি আছে জানি; দুপুরে খাব।” ওরা দুপুরে খাবে, বিকেলে খাবে, রাতে খেয়ে তারপর যাবে—এমনও ছুটির দিন কাটে আমার। কখনো কখনো বাড়তি খাবার থাকলে যাওয়ার সময় জোর করে, প্যাক করে দিই ওদের। কারণ, ওরা আমার হাতের রান্না খেতে খুব পছন্দ করে। হয়তো বাড়িয়ে বলে। তবে আমার ভালোই লাগে!’
সন্ধ্যায় চলে আড্ডাবাজি। বললেন, ‘আমার রেডি হতে এক ঘণ্টা লাগে। যেদিন গর্জাস মেকআপ নিই; মেকআপ, হেয়ার, ফেস, ড্রেস…যদি শাড়ি পরি, শাড়ির জন্য আধঘণ্টা।’ এসব চিন্তা করে আসরের নামাজ পড়ে মেকআপ করতে বসেন। তারপর চলে যান আড্ডাস্থলে; সেটি হতে পারে ধানমন্ডিতে, কিংবা মিরপুরে। এর বাইরে আড্ডা দেওয়া হয় না। আউটডোরে আড্ডাবাজি করতে সমস্যা নেই। তবে রেস্তোরাঁতেই স্বস্তি।
পরিচিত মহলে জাহানারা বেশ স্বাস্থ্যসচেতন হিসেবেই খ্যাত। তবে ছুটির দিনে কী খেতে হবে, কী খাওয়া যাবে না—এসব মাথায় রাখেন না। ফলে সেদিন হতে পারে পিৎজা-বার্গার, কিংবা ফুচকা…। ঈদের সময়ে হলে আইসক্রিম মিস যায় না। কারণ, ঈদ ছাড়া এর স্বাদ তিনি নেন না। মাঝেমধ্যে ফটো আপলোড করলেও কারও আইসক্রিম নিয়ে পোজ দিয়ে দেন!
আড্ডা শেষে বাসায় ফিরে নামাজ পড়ে, ফ্রেশ হয়ে, রাতের স্কিন কেয়ার রুটিন শেষ করে তবেই যান বিছানায়। সেদিন রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে ১০টা-১১টা বেজে যায়। রাতের স্কিন কেয়ার রুটিন সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘আরে বাপস!’ বলে হেসে উঠলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘যদিও মডেল নই, তবু মনে করি, প্রত্যেক নারীরই স্কিন কেয়ার, হেয়ার কেয়ার করা, নিজের যত্ন নেওয়া উচিত। আমি চেষ্টা করি রাতে স্কিন কেয়ার করে ঘুমোতে, যেন পরের দিন সকালে ত্বক প্রস্তুত থাকে। কারণ, আমরা যারা স্পোর্টস পারসন, আমাদের প্রতিদিন সাধারণত আট থেকে নয় ঘণ্টা রোদে থাকতে হয়, সানলাইটের আন্ডারে; ধুলোবালি তো আছেই। সেদিক থেকে, খুব ভালোভাবে ফেসওয়াশ দিয়ে স্কিন ক্লিন করে, দুটো ক্রিম অ্যাপ্লাই করি। একটি সেরামের পর একটি সফটেনিং ক্রিম। অবশ্যই চেষ্টা করি কাজল খুব ভালোভাবে ওঠানোর। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো ভেসলিন ইউজ করেন। এটি আমার জন্য ভালো হয়; যেন চোখ সেফ থাকে। কখনো কখনো দুই-তিন দিন পরপর কোনো একটা ফেস মাস্ক ইউজের চেষ্টা করি, যেটি ডার্ক সার্কেল বা ধুলোর প্রলেপ ত্বক থেকে সরাবে।’ ফিক করে হেসে ফেলে যোগ করলেন, ‘অবশ্য যতই সানব্লক ইউজ করি, কাজ হয় না; সানলাইটের কারণে ন্যাচারাল স্কিন থেকে আরও ডার্ক হতে থাকি আমরা!’ তবু স্কিনের কেয়ারের চেষ্টায় ত্রুটি থাকে না তার।
এই বিধ্বংসী পেসারের রাতের পাতে কী থাকে? বললেন, ‘ন্যাশনাল ক্যাম্প কিংবা কোনো টুর্নামেন্টের আন্ডারে না থাকলে আমাকে স্বভাবতই টিম শিডিউল ফলো করতে হয়। রাত আটটা-সাড়ে আটটায় ডিনার টাইম। তবে বাসায় থাকলে, অথবা নিজের শিডিউল মেইনটেইন করার সময়ে চেষ্টা করি সন্ধ্যা ছয়টার পর কোনো হেভি মিল গ্রহণ না করার।’ হেভি মিল বলতে রুটি বা সেদ্ধ ডিম থাকে ম্যাক্সিমাম। কিন্তু ক্ষুধা তো লাগেই কখনো কখনো। সে ক্ষেত্রে কালেভদ্রে তরল দুধে মধু মিশিয়ে খেয়ে নেন। তার চেয়েও বেশি ক্ষুধা লাগলে সেদ্ধ ডিমের শুধু সাদা অংশটি খান। বিশেষ কাজ না থাকলে সন্ধ্যার পর এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা থাকে তার।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নারীদের টি-২০ বিশ্বকাপে জাহানারার পারফরম্যান্সের পাশাপাশি চোখের কাজল নিয়ে বিশ্বব্যাপী বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। খুলনার পশ্চিম টুটপাড়ায় জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা এই তারকা জানালেন, খেলাধুলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা একদম ছোটবেলা থেকেই। জাতীয় দলে ডাক পড়ে ২০০৮ সালে। তবে এর দুই বছর পর ওপেনিং বোলার হিসেবে নিয়মিত একাদশে খেলা শুরু, চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস থেকে। সেটিকেই ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট মনে করেন জাতীয় দলের এই সাবেক অধিনায়ক। কেননা, ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নিতে পারার সিদ্ধান্তে তখনই পৌঁছতে পেরেছিলেন।
পাঁচটি টি-২০ ও একটি ওডিআই—এ পর্যন্ত ছয়টি বিশ্বকাপ খেলা এই তারকা ক্রিকেটারের ব্যক্তিজীবনে পছন্দের রং কালো। পছন্দের পোশাক শাড়ি। কালেকশনে অনেক শাড়ি আছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরার চেষ্টা করেন। এরপর পছন্দের পোশাক সালোয়ার-কামিজ। তবে সব ধরনের পোশাকই পরেন এবং তাতে স্বস্তিবোধ করেন।
পরিবারের বড় সন্তান তিনি। রয়েছে আরও দুই ভাই ও দুই বোন। বাবা-মায়ের উৎসাহ ও আশীর্বাদ তার নিত্যসঙ্গী। খেলাধুলার শুরু থেকেই নানি ছিলেন তার জীবনের আইডল। ইনস্পিরেশন। জাহানারার কাছে জীবন হচ্ছে এককথায়, ফুল অব এক্সপেরিয়েন্স। অর্থাৎ, জীবনকে কীভাবে অতিবাহিত ও পরিচালনা করা চাই—তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে প্রথমত অভিজ্ঞতা লাভের এবং সেইমতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর। বললেন, ‘আমার জীবন ছোট ছোট অনেক গল্পে ভরা। কিন্তু এখনই তা প্রকাশ করব না! ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর হয়তো বলব।’
সব ধরনের মিউজিক শুনতে পছন্দ করেন। তবে মেজাজের ওপর নির্ভর করে। বললেন, ‘আমারও মুড সুইং হয়। মন ভীষণ খারাপ থাকলে স্যাড মিউজিক শুনি; তখন রোমান্টিক মিউজিক একদম সহ্য হয় না। মুড ঠিক হয়ে গেলে স্যাড মিউজিক সহ্য করতে পারি না।’ নিজেকে ‘বাথরুম সিঙ্গার’ বলে টিপ্পনী কেটে আরও বললেন, ‘তবে গাইতে পছন্দ করি। কবিতা লিখতে পছন্দ করি। বাচ্চামো কবিতা যদিও! আমার আরেকটি প্রতিভা হচ্ছে আঁকাআঁকি করা।’
অ্যানিমেশন মুভি খুব পছন্দ জাহানারার। স্পোর্টস মোটিভেশনের মুভিও। ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ শতাধিকবার দেখেছেন। বই পড়তে ভালোবাসেন। হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে অনেকের বই পড়েছেন। গত সাত-আট বছর বুঁদ হয়ে আছেন একটি সিরিজে। কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’। প্রতিদিন এক-দুই পৃষ্ঠা হলেও পড়তেই হবে তাকে। নয়তো মনে হয়, কী যেন করেননি! ‘ফেলুদা’, ‘জেমস বন্ড’, ‘শার্লক হোমস’ সিরিজও পড়েছেন দেদার। পাশাপাশি, লেজেন্ডারি স্পোর্টস পারসনদের বায়োগ্রাফি।
সামগ্রিকভাবে ক্রীড়াজগতে তার আইডল মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। বললেন, ‘মেসি আমার ক্র্যাশ ও ফেভারিট প্লেয়ার। তার জন্য আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করি। শুধু তার খেলা দেখি। অনেকের মতো রাত জেগে খেলা দেখা আমার হয় না; সে ক্ষেত্রে হাইলাইটস দেখি।’
শুধু ক্রিকেটের জন্য অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ ও সেক্রিফাইস করেছেন এই তারকা। উদাহরণ দিতে গিয়ে বললেন, ‘বৃষ্টিতে ভেজা খুব পছন্দ, সেটা কম্প্রোমাইজ করেছি। ফ্যামিলির সঙ্গে সময় কাটানো খুব পছন্দ, সেটা সেক্রিফাইস করেছি। ফ্যামিলি খুলনায় থাকে, আমি ঢাকায়। ফ্যামিলি ফাংশন, ফ্রেন্ডস সার্কেল আমার নেই বললেই চলে। ছাত্রজীবনের বন্ধুরা খুব অভিমান করে সময় দিই না বলে। আইসক্রিম, চকলেট পছন্দ হলেও খাওয়া হয় না।’ এই তালিকার যেন অন্ত নেই। তবু ক্রিকেটই ধ্যানজ্ঞান বলে তিনি বেজায় খুশি। নতুনদের জন্য তার পরামর্শ—ইচ্ছাশক্তি থাকা এবং প্রপার হার্ডওয়ার্ক করা চাই।

 রুদ্র আরিফ
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top