skip to Main Content

ইভেন্ট I আরব্য রজনীর স্বাদনামা

পাঁচ তারকা হোটেল র‌্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন ঢাকার আয়োজনে হয়ে গেল অ্যারাবিয়ান ফুড ফেস্টিভ্যাল। উৎসবে পরিবেশিত চৌব্য চোষ্য লেহ্য পেয়- সব ধরনের আরবি-স্বাদ চাখার তৃপ্তি সামিউর রহমানের কলমে হয়ে উঠেছে অনন্য আরব্যরজনী

প্রিয় পত্নীর বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ সুলতান শাহরিয়ার যখন একের পর এক তরুণীকে বিয়ে করে পরদিন মৃত্যুদন্ড দিয়ে ভীতিকর এক পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন রাজ্যজুড়ে, তখন উজিরকন্যা শেহেরজাদ গল্পের ছলে সুলতানকে ভুলিয়ে বাঁচিয়েছেন নিজের প্রাণ। সেই সঙ্গে আরও অনেকের। এক হাজার এক রাত ধরে শেহেরজাদের বয়ান করে যাওয়া সেই গল্পগাথার মালাই হলো ‘আলিফ লায়লা’। সেই গল্পগুলোই আরবি থেকে তর্জমা করে পশ্চিমে পরিবেশন করলেন রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন, নাম দিলেন অ্যারাবিয়ান নাইটস। আলাদিনের চেরাগের দৈত্য, সিন্দাবাদের সপ্ত অভিযান, আলিবাবা চল্লিশ চোর- এমন মজার মজার সব গল্প! এই গল্পগুলোর মতোই মজাদার আরব্য রসনার পসরা সাজানো হয়েছিল রাজধানীর র‌্যাডিসন ব্ল– ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের বুফে রেস্টুরেন্ট ওয়াটার গার্ডেন ব্রেসারিতে। যেখানে পরিবেশিত হয়েছে এক হাজার এক না হলেও এক শ এক পদের জিভে জল আনা সব খাবার।
আলিবাবা চল্লিশ চোর গল্পে ডাকাতদের ধনরত্নের গুহাটা ছিল লোকালয়ের বাইরে। আরব স্বাদের খাবারের মণিমুক্তাগুলো অবশ্য ভোজনরসিকদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়নি, বরং সামনে মেলে ধরা হয়েছে আন্তরিকতা আর হৃদ্যতায়। লিফটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিচিং ফাঁক না বলে বোতামে চাপ দিলেই খুলবে দরজা। দোতলায় নেমে গেলেই ধনভান্ডারে ঢুকে আলিবাবার ভাই কাসিমের যে অবস্থা হয়েছিল, খাদ্যান্বেষণে আসা ভোজনরসিকেরাও পড়তে পারেন সেই একই অবস্থায়! কাসিম লোভ সামলাতে পারেনি চুনি পান্না হীরে জহরত দেখে। এখানে পেট আর জিভের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হতে পারে বেশ কয়েকটা লাইভ কুকিং স্টেশন দেখে, যেখান থেকে ভেসে আসা মৌতাত উসকে দেবে ক্ষুধা। শুরুতে মরোক্কান স্যুপ, ভেড়ার মাংসের সঙ্গে কাবলি ছোলা, শিমের বিচি আর টমেটো দিয়ে বানানো। পাশেই আছে নানান রকম মধ্যপ্রাচ্য রীতির স্যালাড। হামুস, তাহিনি, বাবা গানুশ- এমন সব বাহারি নাম। জলপাই, জলপাইয়ের তেল, ডুমুর, আঙুর, পনির আর কাবলি ছোলা দিয়ে বানানো স্যালাড চেখে দেখার পর নজর দিতে পারেন ‘উজে’র দিকে। শেফ মফিজ উল্লাহর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে উৎসবের ভোজ মানেই উজে। আস্ত খাসির রোস্ট বসানো বাসমতী চালের জমিনে। তাতে মিশেছে হরেক রকম বাদাম আর কিশমিশ। উপরে ছড়িয়ে রাখা সেদ্ধ ডিম আর ফালাফেল। কাবলি ছোলা মিহি করে বেটে, তার সঙ্গে জিরা, গোলমরিচের গুঁড়াসহ আরও অনেক মসলা মিশিয়ে শামি কাবাবের মতো বানিয়ে ভেজে বানানো হয় ফালাফেল। বাংলাদেশি বিয়েতে বরের সামনে যে থালা পরিবেশিত হয়, তার সঙ্গে দেখতে কিছুটা মিল থাকলেও স্বাদে অনেকটাই আলাদা!
পাশেই লাইভ গ্রিল কাউন্টার। যেখানে হালকা মসলায় জারিত মাছ, চিংড়ি, মুরগিসহ অনেক কিছুই গরম গরম সেঁকে তুলে দেওয়া হবে আপনার পাতে। আছে তুর্কি আদানা কাবাব, শীষ কাবাবসহ বাহারি সব কাবাবের আয়োজন। কাবাবের পাশেই রুটির ঝুড়ি। আছে লাইভ শরমা কাউন্টার, চোখের সামনেই ঘুরন্ত গ্রিল থেকে ঝলসানো মাংসের ফালি কেটে পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম, শসা, টমেটো দিয়ে মুড়িয়ে তুলে দেওয়া হবে আপনার প্লেটে।
অ্যারাবিয়ান ফুড ফেস্টিভ্যালের প্রধান শেফ মফিজ উল্লাহ বাংলাদেশি হলেও তার গল্পটা আরব্য রজনীর কোনো গল্পের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়! মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ঘর ছেড়েছিলেন মফিজ, ১৮ বছর কেটেছে বিদেশ-বিভূঁইতে নানান হোটেলের রসুইঘরে। সৌদি আরব, কুয়েত, দুবাই, বাহরাইন, টোকিও ঘুরে ফিরেছেন নিজের দেশে। র‌্যাডিসনের মহাব্যবস্থাপক জানালেন, র‌্যাডিসনের বেশির ভাগ শেফেরই মধ্যপ্রাচ্যের হোটেলে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। তাদের সেই অভিজ্ঞতা থেকে ঢাকাবাসীর পাতে আরব ব্যঞ্জন তুলে দেবার জন্যই রমজান মাসে আয়োজন করা হয়েছিল অ্যারাবিয়ান নাইটসের। সে সময় ভোক্তাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেলেও একটা অনুযোগ ছিল, ইফতারে অচেনা খাবার খুব একটা চেখে দেখার সুযোগ নেই। হোটেলে কর্মরত একজন জানালেন, রমজানে আমরা প্রথমবারের মতো অ্যারাবিয়ান নাইটস থিমটা করার সময় দেখেছি নতুন স্বাদের খাবারগুলো বুফেতে খুব বেশি লোকে নিচ্ছে না। বরং ইফতারের যেসব চেনা খাবার- হালিম, কাবাব, বিরিয়ানি- এসবই সবাই খেয়েছেন। পাশ থেকে আরেকজন বললেন, অনেকটা সময় না খেয়ে থেকে কেউ আসলে অচেনা খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায় না। তাই এবারের আয়োজন। হেমন্তের হালকা শীতের রাতকে আরব্য রজনীর সজ্জায় রাঙাতে ওয়েটারদের গায়ে উঠেছে আরব ঘরানার পোশাক। নেপথ্য সংগীত আর অন্দরসজ্জাতেও উট, খেজুরগাছ- এসবের নকশা।
র‌্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেনের আরব্য রজনীর খাদ্যসম্ভারে সবচেয়ে মূল্যবান যে রত্নরাজি, তা হচ্ছে অ্যারাবিয়ান ডেজার্ট বা আরব কায়দায় বানানো মিষ্টিস্বাদের সব খাবার। বাকলাভা, কুনাফা, তিরামিসু তো আছেই; সঙ্গে আরও অনেক রকম মিষ্টি খাবার, যা মুখে দেওয়া মাত্রই আবেশে মুদে আসবে চোখ। খাঁটি দুধ, নানান ধরনের বাদাম, কিশমিশ, আখরোট, খেজুরসহ হরেক রকমের মিষ্টি ফল দিয়ে বানানো সব খাবারের জন্য পেটের অনেকটা জায়গা খালি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আছে ২০ রকমের খেজুর, যা আনা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের নানান দেশ থেকে। আছে কাতায়েফ, দেখতে একদম আমাদের দেশের চন্দ্রপুলি পিঠার মতো। ভেতরে নারকেল কোরার বদলে পনির। উপরে হালকা চিনির সিরার প্রলেপ। মুচমুচে খাস্তা পুলিপিঠার ভেতরে জমাট ছানার স্বাদ মনে থাকবে অনেক দিন!
বাংলার ঠাকুরমার ঝুলিতে আছে ডালিম কুমার, পঙ্খীরাজ ঘোড়া। সঙ্গে আরব্য রজনীতে আছে প্রদীপের দৈত্য, উড়ন্ত গালিচা। দুটি দুই রকম হলেও শৈশবকে রাঙিয়ে দিতে কোনোটারই অবদান কম নয়। বাঙালি রসনার সঙ্গে আরব ঘরানার তফাতটাও অনেকটা সে রকমই। স্বাদে ভিন্ন হলেও তৃপ্তিতে কম নয় মোটেও। বাঙালি রান্নায় যেমন হলুদ, মরিচ আর পেঁয়াজ রসুনে তেল মসলায় ফোড়ন, আরবি ঘরানায় তেমনি নানান নিজস্ব মসলার হালকা ঝাঁজ সঙ্গে জয়তুন তেল অর্থাৎ অলিভ অয়েল। শেফ মফিজ জানালেন, আরব রসনায় মসলার ব্যবহার পরিমিত। আর মরুর দেশ বলেই বোধ হয় সব খাবারই শুকনো শুকনো, কোনো ঝোলের বালাই নেই। একমাত্র স্যুপ বাদে সব খাবারেই পানি একেবারে অনুপস্থিত। কাবাবগুলো জারিত হয়েছে টক দই, কাফির লেবুর পাতা, জাফরান আর গোলমরিচে। তাতে মসলার আধিক্যে ঢেকে যায়নি প্রকৃত স্বাদ।
ক্রমশ কসমোপলিটান হয়ে ওঠা ঢাকার খাদ্যবিলাসীদের কাছে হয়তো এসব পদের অনেকগুলোই চেনা, চেখে দেখা। তবে হঠাৎ করেই অদ্ভুত ঠেকতে পারে বেগুন দিয়ে রাঁধা ভেড়ার মাংসের পদ মুতাজ্জান। মাংসের সঙ্গে বাঙালি হেঁসেলে আলু, বাঁধাকপি, পেঁপেসহ অনেক সবজিরই সংগত তৈরি হলেও বেগুনের অনুপ্রবেশ ঘটেনি! শুঁটকি আর মাছের সঙ্গেই বেগুনের চিরন্তন মিতালি। আরব কেতায় বেগুন দিয়ে মাংসটা চেখে দেখবেন নাকি এড়িয়ে যাবেন, সেটা না হয় দেখেই ঠিক করে নিন। মধ্যপ্রাচ্যের রসনায় মাছের অভাব থাকাটাই প্রত্যাশিত, আরব্য রজনীর খাদ্যসম্ভারেও সেই একই বৈশিষ্ট্য। মিক্সড গ্রিল প্ল্যাটার বাদে অন্য কোথাও মাছের কোনো পদ নেই। সেটা এক দিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। আরব্য রজনীর গল্পে তো আর পান্তাবুড়িকে পাওয়া যাবে না, তার জায়গা যে বাঙালির হাসির গল্পে!

লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে আর দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top