skip to Main Content

এডিটরস কলাম I সকলের তরে…

মানবিক মানুষ হিসেবে আমরা একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে গেলে জীবনযাত্রা আরও অর্থবহ হয়ে উঠবে

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। অনুন্নত দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া আমাদের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবু করোনা অতিমারির ধকল, শহরজুড়ে যানজট, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগসহ নানা কারণে অর্থনীতির চাকা ক্ষণে ক্ষণে শ্লথ হয়ে ওঠে। বহু মানুষকেই দুবেলা দুমুঠো খাদ্য জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। চলতি পথে দেখা মেলে সাহায্যের জন্য হাত পেতে রাখা অসংখ্য মানুষের। টিসিবির ‘ন্যায্যমূল্যে’র ট্রাকের সামনে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তেরও দীর্ঘ সারি। বাতাসে কেমন এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস! তবু জীবন এগিয়ে চলে জীবনের নিয়মে। এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে আকাশে উঁকি দেয় ঈদের চাঁদ। খুশির ঝিলিক দেখা দেয় আদিগন্ত প্রান্তরে।

দুই
আরবি ‘আওদ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের আবির্ভাব। ‘আওদ’-এর পারিভাষিক অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ঘুরে আসা। তার মানে, প্রতিবছর ঘুরেফিরে আসা বিশেষ একটি দিন বা উৎসবকে ‘ঈদ’ বলি আমরা। অন্যদিকে, ‘ফিতর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ রোজা ভাঙা বা ইফতার করা। তার মানে, ঈদুল ফিতরের সরল বাংলা দাঁড়ায় রোজা ভাঙার উৎসব। পবিত্র রমজান মাসজুড়ে সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রেখে, ইফতারের মাধ্যমে তা ভাঙেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ঈদুল ফিতরের দিন সেই নিয়মিত রোজা ভাঙার উৎসব। এ বড় আনন্দের দিন। সব আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার আয়োজন। তাই শুধু নিজের গণ্ডিতে আনন্দকে আটকে না রেখে, সবার মাঝে তা বিলিয়ে দেওয়ার, ভাগাভাগি করার উপলক্ষ হলো ঈদ। এমন দিনে আমরা যেন অন্যদের দুঃখ-কষ্টের কথা ভুলে না যাই। অন্যথায় ঈদের তাৎপর্য পূর্ণাঙ্গ রূপে ধরা দেবে না আমাদের জীবনে।

তিন
‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’—কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন কবিতায়। ‘বলো কি তোমার ক্ষতি/ জীবনের অথৈ নদী/ পার হয় তোমাকে ধরে/ দুর্বল মানুষ যদি’—জিজ্ঞাসার অন্তরালে মানবিক আবেদন জারি রেখেছেন সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা তার গানে। তারও বহু আগে কবি কামিনী রায় লিখে গেছেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী ’পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ এমন আরও অনেক চেনা-জানা গান-কবিতা-শিল্পকর্ম আমাদের নিত্যদিন মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়, প্রেরণা জোগায়। কিন্তু আমরা সবাই কি সেই আহ্বানে সাড়া দিই? খালি চোখে সমাজের দিকে তাকালেই মিলবে এর নেতিবাচক উত্তর। না, দিই না! বরং একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর একটা পশ্চাৎপদ মানসিকতা রয়েছে অনেকের। রয়েছে একা একা নিজেকে, নিজের পরিমণ্ডল নিয়ে ভালো থাকার প্রবণতা। তাই যখন কোনো দুর্যোগ বা দুঃসময় হানা দেয়, তখন তো বটেই, এমনকি নিত্য জীবনচিত্রেও চারপাশে দেখা মেলে অনেক অনাহারী আর বিপর্যস্ত মুখ। সাধ্যমতো তাদের মুখে হাসি না ফুটিয়ে, তাদেরও উৎসবে অংশীদার না করে কী করে যথাযোগ্যভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারব আমরা? ঈদের প্রকৃত মাহাত্ম্য তাতে তো ধরা দেবে না!

চার
স্বীকার করছি, প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা। রয়েছে সাধ্যের সীমা। চাইলেই একজন ব্যক্তিমানুষ রাতারাতি কোনো সমাজের কোনো নেতিবাচক চিত্র পাল্টে দিতে পারেন না। রূপকথায় থাকলেও বাস্তবে তেমন সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি কারও হাতে নেই। অন্যদিকে, নিজ নিজ অবস্থানকে ক্রমাগত উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিমানুষটির নিজেকেই চালাতে হয় মূল প্রচেষ্টা। সরকার, সমাজ, অন্য মানুষেরা তাকে শুধু সাহায্য করতে পারবে; হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে তাকে টেনে তুলতে; কিন্তু ওঠার দমটা তার নিজের মধ্যেই থাকা চাই। তাই একদিকে যেমন অন্যের প্রতি আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হয়, তেমনি নিজের মধ্যেও থাকা চাই নিজ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার প্রচেষ্টা।

পাঁচ
করোনাভাইরাসের থাবায় জর্জরিত জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে তোলার প্রচেষ্টা চলছে সর্বত্রই। সব ক্ষত এখনো সেরে ওঠেনি। ওঠা সম্ভবও নয় এত দ্রুত। সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে বিবিধ অনিয়ম ও অদূরদর্শিতার বালাই। অনেক দেশেই তা দৃশ্যমান। খুব বেশি দূরে নয়, শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব, কী ভয়াবহভাবে একটি দেশ ও তার জনগণ ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। পণ্যের আকাশচুম্বী দাম, গণরোষ, দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ভয়…। দক্ষিণ এশিয়ান দেশটি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, সময়ই বলে দেবে তা। কিন্তু ওই দেশের মতো এমন সংকটে পড়ার দৃশ্যত আমাদের কোনো আশঙ্কা না থাকলেও, এমন নেতিবাচক উদাহরণ থেকে নিতে পারি শিক্ষা। সম্ভাব্য যেকোনো সংকট প্রতিরোধে আগেভাগেই নিয়ে রাখতে পারি প্রস্তুতি। সেই দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রপরিচালনাকারীদের একার নয়; আপনার, আমার—সবার। সুনাগরিক এবং মানবিক মানুষ হিসেবে আমরা একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে গেলে জীবনযাত্রা আরও অর্থবহ হয়ে উঠবে। ঈদের প্রকৃত বার্তা ছড়িয়ে পড়বে ইথারে ইথারে।

ঈদ আনন্দে কাটুক সবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top