skip to Main Content

ফিচার I ব্যাগভর্তি খুশি

নান্দনিক অথচ দরকারি সব পণ্য ভোক্তাকে উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের পরিতৃপ্ত অভিজ্ঞতা দিতেই জন্ম যে ব্র্যান্ডের, তার সাফল্যে মোড়া গল্প শোনাচ্ছেন শেখ সাইফুর রহমান

একটি লাল ব্যাগের ওপর ৬টি অক্ষর সাদা রঙে দুই লাইনে খেলা। প্রথম লাইনে চারটি আর পরের লাইনে দুটি। দ্বিতীয় লাইনে দুটি অক্ষরের পাশে একটি স্মাইলি। এটাই একটা লোগো। একটি প্রতিষ্ঠানের। এর নেপথ্যে রয়েছেন দুজন। জাপানি ডিজাইনার মিয়াকি জুনিয়া এবং তরুণ চৈনিক উদ্যোক্তা ইয়ে গুয়োফো। উভয়ে মিলে এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা শুরু করেন। তা-ও মাত্র ২০১৩ সালে। উদ্দেশ্য ছিল এমনকি কিছু পণ্য বিশ্ববাসীকে উপহার দেওয়া, যা কেবল তাদের যাপনকে মাত্রাময় করবে তা-ই নয়, ছড়িয়ে দেবে তৃপ্তির আনন্দ। এবং অবশ্যই তা হবে সাশ্রয়ী। দুয়ে মিলে সেটা করতে পেরেছেন মাত্র ৫ বছরে। আবিশ্বের অন্তত ৭৯ দেশে সাড়ে তিন হাজারের বেশি আউটলেটের মাধ্যমে উপস্থিতি সগর্বে জানান দিচ্ছে এই জাপানি ব্র্যান্ড। এসব আউটলেটের অন্তত ৯৬ শতাংশ রয়েছে লাভজনক অবস্থানে। ২০২২ সালের মধ্যে সত্তরকে শতকে আর ৩ হাজারকে ১০ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে তারা। এই ক্রমবর্ধমান কাফেলায় যোগ হয়েছে বাংলাদেশও।
ক্রেতারা হলেন বয়সে তরুণ; যারা জীবনের আনন্দে ভরপুর। অথচ অনলাইন শপিংয়ের কোনো ব্যবস্থা তারা রাখেনি কোথাও। বর্তমানে টেকনোলজির জয়জয়কারের জমানায় তারা ক্রেতাকে যে দোকানমুখী করতে চায়। এ ক্ষেত্রে শতভাগ সফলও। তাই তো কেবল ঢাকায় নয়, বিশ্বের যেকোনো শহরে যেকোনো আউটলেটে ক্রেতাদের লেগে থাকা ভিড় দৃষ্টিগোচর হয়। অন্তত এই লেখকের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
এতক্ষণে আপনারা আন্দাজ করতে পেরেছেন, কোন ব্র্যান্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠিকই ধরেছেন। জাপানি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড মিনিসো এই নিবন্ধের বিষয়। নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণকারীদের কাছে মিনিসো অবশ্যই পরিচিত ব্র্যান্ড। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, গেল এক বছরে ঢাকার তরুণদের কাছেও মিনিসো কাঙ্ক্ষিত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে।
নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা হচ্ছিল মিনিসো বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন্স হেড অ্যালেন লিউ আর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট হেড জন ক্লাইভ ফ্রেজার জুনিয়রের সঙ্গে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় তাদের প্রথম আউটলেটের দরজা খুলে দেওয়া হয়। তাই বলতেই হয় সদ্য বর্ষপূর্তি হলো মিনিসো বাংলাদেশ-এর। এক বছর পর তারা এ মাসেই করছে গ্র্যান্ড ওপেনিং। বলে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশে মিনিসোর কার্যক্রম শুরু ২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর। মাত্র ৫ জনকে নিয়ে। এখন সেই সংখ্যা গুণিতক হারে বাড়ছে। ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব ওয়্যারহাউজও হয়েছে টঙ্গীতে। এক বছরে বাংলাদেশে তাদের আউটলেট সংখ্যা ১০। বনানীরটাই কেবল মিনিসোর নিজস্ব। বাকি সব কটিই ফ্র্যাঞ্চাইজি। মিনিসো আসলে সাব-ফ্র্যাঞ্চাইজি কোম্পানি- বললেন জন। যোগ করলেন বিশ্বব্যাপী এভাবেই মিনিসোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে নিয়ন্ত্রণ থাকে মিনিসোর কাছে। বনানীর পর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, যমুনা ফিউচার পার্ক হয়ে উত্তরা। এরপর যোগ হয়েছে বসুন্ধরা সিটি। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় আউটলেট। ৬০০০ বর্গফুটের। জন সগর্বে জানালেন, কেবল বাংলাদেশেই নয়, পরিসরের নিরিখে এশিয়ায় এটাই সবচেয়ে বড়। উত্তরায় এ মুহূর্তে তাদের দুটো আউটলেট। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে মিরপুর, খিলগাঁও ও ওয়ারী। এ বছর আরও অন্তত ১০টি আউটলেট সারা দেশে খোলা হবে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার তালিকায় আছে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা।
কথায় কথায় একটু পিছিয়ে গেলেন জন। বললেন, ২০১৭ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ মিনিসো টিম ঢাকা সফর করে। সেই সময় ৪-৫ মাস ধরে বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ফেরে। যেটা তাদের আগ্রহী করে বাংলাদেশে মিনিসোর তরী ভেড়াতে। এ ক্ষেত্রে তাদের জরিপে উঠে আসে মানুষের রুচি অনুযায়ী সঠিক ও মানসম্পন্ন পণ্যের অভাব। ফলে সম্ভাবনার আলো দেখতে পায় তারা। তাই এই বাজারে নোঙর করতে দ্বিধান্বিত হতে হয়নি।
জন কেবল আত্মবিশ্বাসীই নন, উচ্চাভিলাষীও বলা যায়। কারণ, তিনি চান আগামী তিন বছরের ৫০টা না হোক, অন্তত ৩০টা আউটলেট বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে খুলতে। তবে এ জন্য যথাযথ ক্রেতা থাকতে হবে। সেটা সব শহরে এখনো নেই বলেই মনে করেন অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আমাদের কথোপকথন শুনতে থাকা অ্যালেন। তাই কথার মাঝে যোগ করলেন, আমাদের পণ্য অবশ্যই উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য। সেটা কিনতে পারার সামর্থ্য থাকতে হবে। মিনিসো কম দামে ভালো পণ্য দিলেও বাংলাদেশের বাজারে আমাদের বড় অন্তরায় হলো শুল্ক। ইন্দোনেশিয়ায় যেখানে মাত্র ১০-২০ শতাংশ আমদানি শুল্ক, সেখানে বাংলাদেশে ১১০ শতাংশ।
অ্যালেনের বক্তব্যের যথার্থতা অনুভব করা দুরূহ নয়। কারণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই সেটা বেশ বুঝি। যে ব্যাগ জাকার্তায় ৬০০ টাকায় কেনা সম্ভব। সেটা ঢাকায় বসে দ্বিগুণ দামেও সম্ভব হয় না। এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাজারে যথেষ্ট সাড়া মিনিসো পেয়েছে। এর কারণ অবশ্যই পণ্যের বৈচিত্র্য, নকশার নান্দনিকতা আর অবশ্যই গুণগত মান।
বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করছে মিনিসো। রয়েছে তাদের বিশাল গ্লোবাল ডিজাইন টিম। আর গোটা বিশ্বকে ম্যানেজ করার জন্য তারা গত বছর আইবিএমের কাছ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলারে কিনেছে এসইপি সিস্টেম। কথায় কথায় জানিয়ে দেন অ্যালেন। এতে সুবিধা হলো ২১ দিনের মধ্যে যথাস্থানে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা।
জন যোগ করেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে ২০০০ পণ্য। এ বছর যোগ হবে আরও অন্তত ১২০০। নিজেদের পণ্য ছাড়াও বিখ্যাত সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরাসরি বাজারজাত করে থাকে মিনিসো। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যাপল। নতুন বছরে বাংলাদেশের জন্য চমক যে থাকছে, তা আগেভাগেই জানিয়ে রাখেন জন। এ ছাড়া পিঙ্ক প্যান্থার, বেয়ার বিয়ার, মার্ভল ইত্যাদি কার্টুন ক্যারেক্টারের লাইসেন্সড প্রডাক্ট পাওয়া যাবে এ বছর।
মিনিসোর অন্য নাম বলা যেতে পারে নিউ লাইফস্টাইল। তথাকথিত ফ্যাশন আর পারসোনালিটিতে গুরুত্বারোপের জন্য নয়, বরং ব্র্যান্ড মিনিসোর জন্ম ক্রেতাকে মানসম্পন্ন আর অনুপম পণ্য উপহার দিতে। পাশাপাশি প্রতিটি পণ্যের মাধ্যমে প্রকৃতির কাছে ক্রেতাদের নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর মিনিসো। এর ডিজাইন আর কাঁচামালের ব্যবহারে রয়েছে সেই নিষ্ঠা ও প্রত্যয়। পাশাপাশি ডিজাইনের অনবদ্যতা সমান্তরালের সাধ্যের মধ্যে থাকা দাম ক্রেতার যাপনকে মাত্রাময় করছে। লোগোটাও কিন্তু কম নান্দনিক নয়। যে বিষয়ে শুরুতেই আলোকপাত করা হয়েছে। আসলে কেবল পণ্য নয়, ব্যাগভর্তি খুশিই যেন প্রতিদিন উপহার দিচ্ছে মিনিসো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অগুনতি ক্রেতাকে। আর এই সানন্দসেবার মধ্য দিয়ে প্রসন্নযাপনে ক্রেতাকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে।
নানা কথার মাঝে জন অবশ্য বলেছেন, মিনিসো তো কেবল একটা স্টোর নয়, একজন ক্রেতার কাছে সম্পূর্ণ শপিং এক্সপেরিয়েন্সও বৈকি। এ জন্যই আমরা অনলাইন শপিংকে উৎসাহিত করি না। এমনকি আমাদের ফেসবুকে আমাদের সব পণ্যের ছবি দিলেও মূল্য উল্লেখ করি না। কারণ, আমরা চাই সবাই আমাদের স্টোরে আসুন। দেখুন। না কিনলেও একটা সুখানুভূতি নিয়ে ফিরে যান।
এসব আসলে কথার কথা নয়। যার প্রমাণ প্রতিবছর মিনিসোর পণ্যনকশা; যা স্বীকৃতি পাচ্ছে বোদ্ধাদের। মিলছে অ্যাওয়ার্ড। যেমন রেড ডট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সারএক্সস্কোর (হ্যান্ডফ্যান ও পাওয়ার ব্যাংক টু-ইন-ওয়ান), ওয়েববুক, ইউফ্যান, কলাপসিবল নেকপিলো। অন্যদিকে আইএফ ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে পোর্টেবল স্টিকিং ডিভাইস, ফিল্টার স্টোরেজ বক্স, ওয়েব পেন্সিল বক্স ও ওয়াটার কিউব ওয়াটার বটল। আর পুরস্কার পাবে নাই-বা কেন। মাস তিনেক আগে গ্লোবাল নিউ প্রডাক্টস অর্ডারিং ফেয়ারে তারা প্রদর্শন করেছে ৬০০০ নতুন পণ্য। আর এসব পণ্য আসলেই বর্তমান সময়ের চেয়ে এগিয়ে রাখবে ভোক্তাকে। তাই তো এসব পণ্যকে বলা হচ্ছে বুদ্ধিদীপ্ত ভোগ্যপণ্য। নকশা থেকে উৎপাদন মায় ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সহজ, প্রকৃতিপ্রাণিত আর উচ্চমানের দর্শনে আবর্তিত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। তাই তো কেবল বিক্রি করে নয়, সরাসরি মানুষের পাশেও দাঁড়াতে চায় তারা। অচিরেই হয়তো দেখা যাবে বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কর্মকা-।

ছবি: সৈয়দ অয়ন ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top