skip to Main Content

স্মরণ I সময়ের চিহ্ন হয়ে ওঠা

মানুষের একাধিক জীবন থাকে। বাইরের ও ঘরের। মানুষের অনেক পরিচয় থাকে। বিভিন্ন কাজের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়। মুহম্মদ খসরুর জীবন একটাই ছিল। তা চলচ্চিত্রে সমর্পিত। তিনি জীবনকে চলচ্চিত্রে অর্পণ করে নিজেই হয়ে উঠেছেন চলচ্চিত্র। মুহম্মদ খসরুর ঘরও চলচ্চিত্র, বাহিরও চলচ্চিত্র ছিল। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সময়কালে, তা কেবল চলচ্চিত্রকে ভালোবাসবার এবং এই দেশের মানুষকে ভালোবাসাবার জন্য নিবেদিত ছিল। তিনি সংগঠক ছিলেন, ছিলেন লেখক এবং বাংলা ভাষার প্রধান একটি চলচ্চিত্র পত্রিকার সম্পাদক। আর এ সব কাজই তিনি করেছেন চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির জন্য। চলচ্চিত্রকে আমাদের দেশে সংস্কৃতি করে তুলবার যে লড়াই, তা মূলত কিছু মানুষের জীবনব্যাপী কাজের ফল। সেই গুটিকয় মানুষের মধ্যে মুহম্মদ খসরু হলেন প্রধান একজন দিকপাল।
মুহম্মদ খসরু গত শতাব্দীর উত্তাল ষাটের দশকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরু করেন। পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন বা ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট শুরু করার বিষয়ে যাঁরা উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন চলচ্চিত্রপ্রেমী ব্যস্ত মানুষ। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩-এর মধ্যে ঢাকায় বেশ কিছু উদ্যোগের খতিয়ান আমাদের সামনে হাজির করেছেন চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ। তাতে যাঁদের নাম আমরা দেখি, তাঁরা আর যা-ই হোন চলচ্চিত্র আন্দোলন করবার অভিপ্রায়ে তৎপর ছিলেন না। তাঁরা সুস্থ চলচ্চিত্র দেখতে ও দেখাতে তৎপরতার জন্য চলচ্চিত্র সংসদ করবার চিন্তা করেছিলেন। সেই সব উদ্যোগের বেশির ভাগই স্বল্পায়ু ছিল। মাত্র একটি উদ্যোগ পরবর্তীকালে দানা বেঁধে উঠেছিল। আর তা হলো পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ । ১৯৬৩ সালের ২৫ অক্টোবর এ সংসদ গঠিত হয়। গঠনকালে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা সেইকালের প্রতিষ্ঠিত সব মানুষ। যাঁদের কেউই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করবার সময় ও শ্রম দেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না। এই সব প্রতিষ্ঠিত ও ব্যস্ত মানুষ প্রতিটি সংগঠনেই থাকেন। তাঁরা মূলত সেই সব সংগঠনের শোভা ও আর্থিক সহযোগিতার কেন্দ্ররূপে বিবেচিত হন। কিন্তু কাজ করেন অন্য মানুষেরা। সেই অন্য মানুষ হলেন মুহম্মদ খসরু।
বয়সে তখন অনেক তরুণ মুহম্মদ খসরু। ১৯৪৬ কে মুহম্মদ খসরুর জন্মসাল ধরলে ১৯৬৩ সালে মুহম্মদ খসরুর বয়স দাঁড়ায় ১৭ বছর। চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক অনুপম হায়াতের মতে, মুহম্মদ খসরু পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদে সক্রিয় হন আরও বছর দুই পরে। ১৯৬৫ বা ৬৬ সালে। মূলত তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ। ১৯৬৮ সালে মুহম্মদ খসরুর চলচ্চিত্র পত্রিকা ধ্রুপদী র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। যখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র দুটি চলচ্চিত্র সংসদ সক্রিয় ছিল- পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি ও ঢাকা সিনে ক্লাব। একটির নেতৃত্বে ছিলেন মুহম্মদ খসরু, অন্যটির নেতৃত্বে আলমগীর কবির। মূলত পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন সত্যিকারের আন্দোলনে রূপ নেয় মুক্তিযুদ্ধের পর। সদ্য স্বাধীন দেশে তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীদের উদ্যোগে ও তৎপরতায় চিন্তা ও মননশীলতার সর্বাধুনিক মাধ্যমরূপে চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। প্রক্রিয়াটি রাতারাতি হয়নি। কিছু মানুষের জীবন নিঃশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি রূপে কিছুটা স্থান করে নিতে পেরেছে আজকের বাংলাদেশে। এই প্রয়াসের অগ্রগণ্য দিকপাল মুহম্মদ খসরু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কাট বলে তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্রযাপনের ইতি টেনেছেন।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫৬ বছর চলছে। আমরা এই দীর্ঘ যাত্রাপথের উত্তরাধিকারমাত্র। এ দেশে চলচ্চিত্র শিক্ষা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ বহুকাল ভাড়া বাড়ির যাত্রা শেষ করে আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুকালের চাওয়া চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট । আজকের বাংলাদেশে বহু মানুষের জন্য এই সব অগ্রগতি র প্রকৃত যোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিলের বটে। কারণ, যোদ্ধাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ করে না। প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পর তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। আর যোদ্ধারা একটু আবেগী ও অভিমানপ্রবণ হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
চলচ্চিত্র পত্রিকা সম্পাদনায় মুহম্মদ খসরু কিংবদন্তিতুল্য। ধ্রুপদী ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন সাময়িকী চলচ্চিত্রপত্র । চলচ্চিত্রপত্রের ক্যামেরা যখন রাইফেল , সূর্য দীঘল বাড়ী সংখ্যা মুহম্মদ খসরুর বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র সাময়িকীর সম্পাদনার আলোচিত মাইলফলক।
মানুষ কি মনে রাখে? দেশের গণমাধ্যম কীভাবে একজন মানুষের মূল্যায়ন করে? এসব বিবেচনায় নিলে মুহম্মদ খসরু আদতে একজন অপ্রাতিষ্ঠানিক মানুষ। কারণ, মানুষের মনে রাখবার বাসনাকে তিনি যেমন স্বয়ং চুরমার করতে ভালোবাসতেন, তেমনি নিজস্ব পরিসরের ভেতর তৎপর থাকতেও। খোঁজ রাখতেন দুনিয়ার সর্বশেষ জ্ঞানকান্ডের। পড়তেন খুব। মুহম্মদ খসরুর পাঠাভ্যাস তুলনারহিত। সবাই তাঁর রাগের কথা জানেন। বহু মানুষ তাঁর ভেতরকার শিশুসুলভ কোমল মানুষটার খবরও জানেন। তবু দুনিয়া জানে তাঁর খিস্তিখেউরের কথা। খুব শ্লীল ভাষায় তিনি আক্রমণ করে আরাম পেতেন না। তিনি স্বভাবসুলভ কটুভাষী ছিলেন। তাঁর কাছে শব্দ আণবিক বোমাস্বরূপ। যা তিনি ক্ষণে ক্ষণে নিক্ষেপ করতেন নিজস্ব আক্রমণের ছন্দে!
মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদের ধারণাকে আন্দোলনে বিবর্তিত করেছেন। তিনি একা করেছেন এমন দাবি করবো না। কোনো আন্দোলন কেউ একা করেন না। তবে একা কোনো মানুষকে বইতে হয় সময়ের চাপ, তাপ ও ভারের বোঝা। মুহম্মদ খসরু একা একা বহুকাল বয়েছেন সেই বোঝা। তিনি এবং তাঁরাই বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে বিনোদন থেকে শিল্পে উন্নীত করার পথপ্রদর্শক। যদিও সেই শিল্পময় পথে জাতি হিসেবে আমরা এখনো অপরিণত আছি বলে মনে করি। তবে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল যাঁদের নিষ্ঠায়, সাধনায়, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য মুহম্মদ খসরুর প্রয়াণ আমাদের জন্য গভীর শোক ও দুঃখ বয়ে এনেছে। তিনি অকৃতদার ছিলেন। ছিলেন একাকী জেনারেল। বহুকাল আগে যিনি যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে এসেছেন বলে মানুষ মনে করতো। কিন্তু আমি দেখেছি, মুহম্মদ খসরু নিজের মতো করে নিজের যুদ্ধ লড়ে গেছেন প্রতিটি ক্ষণে। তিনি বিরামহীনভাবে ভেবেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ। বর্তমান নিয়ে তিনি চিরকাল অসন্তুষ্ট মানুষ। অতীত নিয়ে তাঁর ছিল ব্যক্তিগত সন্তোষ। চারপাশকে সার্বক্ষণিক বিচার ও বিশ্লেষণে তিনি ক্লান্তিহীন ছিলেন। পৈতৃক ভিটা কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে একা এই মানুষের সহচর ছিল প্রচুর বই আর টেলিভিশন। মাঝেমধ্যে তিনি তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করতেন অথবা শব্দবোমা নিক্ষেপ করতেন পছন্দ ও অপছন্দের প্রিয়জনদের কর্ণকুহরে। যা তাৎক্ষণিকভাবে হৃদয়ে চাপ তৈরি করতে সক্ষম ছিল।
তাঁর মুঠোফোন আর কাউকে খুঁজবে না, করবে না কোনো শব্দবোমার বিস্তার। বিদায় প্রিয় যোদ্ধা মুহম্মদ খসরু। আপনাকে প্রথম স্যালুট, শেষ তর্কের আরম্ভে!

I বেলায়াত হোসেন মামুন
চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক
সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ
সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি
bhmamun@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top