skip to Main Content

কভারস্টোরি I ফ্রেমবন্দি

বিয়েতে ছবি তোলা হবেই। বিশেষ মুহূর্তগুলোকে স্মৃতির রসদে পরিণত করার জন্য। সে দায়িত্ব বর্তায় আলোকচিত্রীর ওপর। তাকে জানতে হয় হালের ফটোগ্রাফির ট্রেন্ড, বুঝতে হয় প্রতিটি মুহূর্তের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য

বিয়েতে ছবি তোলার অন্য নাম ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। কিন্তু উৎসবে তোলা ছবিমাত্রই ওয়েডিং ফটোগ্রাফি নয়। এর জন্য থাকে পৃথক বন্দোবস্ত, পরিকল্পিত আয়োজন। আগে থেকেই এটি নির্ধারিত হয়। ওয়েডিং ফটোগ্রাফির শুরু ক্যামেরা আবিষ্কারের সময় থেকেই। ১৮২৬ সালে জোসেফ নিস্ফোর নিপ্স-এর হাত ধরে। এর ১৪ বছর পর ১৮৪০ সালে প্রিন্স আলবার্টের সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়ার বিয়ের আয়োজনে এটি যুক্ত করা হয়। ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্রচলন অনেক পুরোনো হলেও আগেকার দিনে ফটোগ্রাফার ভাড়া করে ছবি তোলার প্রচলন ছিল না। অনেকের মতে ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিয়েতে পোজ দিয়ে ছবি তোলা হতো না। তবে বিয়ের আগে বা পরে বর-কনে ভালো পোশাকে একসঙ্গে কিছু ছবি তুলতেন।

ছবি: ড্রিম ওয়েভার

রঙিন ফটোগ্রাফির সূচনা বিশ শতকে। কিন্তু সেই সময়ে এটি এতটাই ব্যয়বহুল ছিল যে বিয়ের ছবি তখনো সাদা-কালোই থেকে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয় ইভেন্টের ছবি তোলা। যদিও তখন ফটোগ্রাফির মান ততটা ভালো ছিল না। তবু বিভিন্ন জায়গায় ওয়েডিং ফটোগ্রাফি একধরনের প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ফটোগ্রাফারদের মধ্যে। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে এটি আধুনিক হতে শুরু করে এবং সম্পূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানের স্মৃতিই পুরোপুরি ছবির মাধ্যমে সংরক্ষণ করার চল আসে।
ছবি তোলার প্রযুক্তি পরিবর্তনশীলতার পথ ধরেই এগিয়েছে। যখন ফিল্মের যুগ ছিল, তখন ফটোগ্রাফাররা রঙিন নেগেটিভ ফিল্ম এবং মিডিয়াম ফরম্যাটের ক্যামেরা ব্যবহার পছন্দ করতেন। এখন প্রায় সব ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। এখানে ব্রাইডাল ফটো অ্যালবাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফি ট্রেন্ড সম্পর্কে ফটোগ্রাফার যোবায়ের হোসেন শুভ যা বলেন-

ছবি: ড্রিম ওয়েভার

ফ্রেমবন্দি প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি স্মৃতি বহন করে। বিয়ের যত বিশদ আয়োজনই থাকুক না কেন, দিন শেষে তা অতীত। সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকে শুধু ছবি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফির চাহিদা তাই দিন দিন বাড়ছে। ভালো ছবির জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। যেখান থেকে ফটোগ্রাফার বুকিং দিয়ে অনেকেই পড়েন বিড়ম্বনায়। ফেসবুকে দু-চারটি ছবি দেখে ভালো ফটোগ্রাফার বাছাই করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বিয়ের ছবি তোলার ক্ষেত্রে বাজেট নির্ধারণে সবাই কমবেশি দ্বিধায় ভোগেন। আবার ছবি কেমন হবে, তা শুধু বাজেটের ওপর নির্ভর করে না। লোকেশন, ভেন্যু, ডেকোরেশন, আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা, ক্লায়েন্টের চাহিদার সঙ্গে ফটোগ্রাফারের দক্ষতার সমন্বয়ে ভালো ছবি ফ্রেমবন্দি হয়। বর-কনের সঙ্গে স্বল্প সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠা জরুরি। এ ছাড়া ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে এখন যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের ট্রেন্ড। সব মিলিয়ে বিয়ে মানে একটি গল্প। ভালো ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের কাজ এই গল্পকে ক্যামেরার মাধ্যমে তুলে ধরা।

ছবি: রেমিনেসেন্স ফটোগ্রাফি

কয়েক বছর ধরে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ট্রেন্ডে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে যার উপস্থিতি খুব বেশি না থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজার এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশে পরিবর্তনশীলতার এই চর্চা ব্যাপক।
গেটিং রেডি: বর ও কনে বিয়ের মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন। আর সেই মুহূর্তগুলোকে ধারণ করা হচ্ছে গেটিং রেডি। এখন এটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড।
ক্যানডিড: ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার চল এখন নেই বলেই চলে। তাই বিয়ের দিন বর-কনের নানা কর্মকান্ড থেকে সুন্দর মুহূর্তের ছবি নেওয়াই হচ্ছে ক্যানডিড।
প্রি-ওয়েডিং: এটি বর্তমান বিয়ের ফটোগ্রাফিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেন্ড। বিয়ের আগে মূলত কাপলরা শুধু ছবি তোলার জন্য এই প্রি-ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করে থাকেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফাররা ছবি তোলার জন্য খুব কম সময় পান। কোনো কোনো মুহূর্ত চাইলেও ফিরে পাওয়া যায় না। তাই বর-কনে ও ফটোগ্রাফারের প্র্যাকটিস আর এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য প্রি-ওয়েডিং খুব জরুরি।
ডিজিটাল এনহ্যান্সমেন্ট: এই ট্রেন্ড নিয়ে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। তারা ভাবেন, ছবির দুর্বলতা ঢাকতে ডিজিটাল এনহ্যান্সমেন্ট ব্যবহার করা হয়। মূলত সব ছবির সারসংক্ষেপ হচ্ছে এটি।

ছবি: আতা মোহাম্মদ আদনান

এন্ট্রি শট: বিয়ের ভেন্যুতে বর ও কনের হাজির হওয়ার আয়োজনই এন্ট্রি শট। এখানে বর ও কনে কীভাবে ভেন্যুতে প্রবেশ করে, সেটা তুলে ধরা হয়। যারা একটু ড্রামাটিক, তাদের কাছে এন্ট্রি শট গুরুত্বপূর্ণ।
ডিটেইলস: পোশাক বা অলংকারকে প্রাধান্য দিয়ে তোলা ছবিই ওয়েডিং ডিটেইলস।
ডেকরের ছবি: বিয়ের অনুষ্ঠান কোনোভাবেই ডেকরের ছবি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। ভেন্যুকে কীভাবে সাজানো হলো, সেটা বিয়ের অ্যালবামে তুলে ধরা জরুরি।
ব্রাইড সিঙ্গেল: বিয়ের সাজে নিজেকে কেমন লাগছে, তা দেখতে কনেরা বেশি পছন্দ করেন। ব্রাইড সিঙ্গেলে তার মেকওভার, গয়না, আভিজাত্য- এসব তুলে ধরা হয়। বলা হয় ব্রাইডদের সবচেয়ে আগ্রহের ট্রেন্ড এটি। কেননা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি এই ছবি ব্যবহার করেন কনেরা।

ছবি: ড্রিম ওয়েভার

গ্রুম সিঙ্গেল: বিয়ে তো শুধু কনের একার নয়, বরেরও। নিজের ছবি তোলার পেছনে অনীহা প্রায় সব ছেলেরই থাকে। তবু নিজেদের কিছু সিঙ্গেল পোর্ট্রেট বিয়ের অ্যালবামে খুবই জরুরি।
ব্রাইড-গ্রুম টুগেদার: একসময় বিয়ের ছবি বলতে শুধু যুগল ছবিকেই বোঝানো হতো। বর-কনের পাশাপাশি একটি ছবি- এটিই ছিল বিয়ের একমাত্র ছবি। এখনকার বর-কনে এ বিষয়ে খুব সচেতন। তারা যুগল ছবি নিয়েই করতে চান আলাদা অ্যালবাম।
মোমেন্টস: বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ছোট ছোট অনেক মুহূর্ত আছে। এগুলো ফিরে পাওয়া যায় না। সেসব মুহূর্তের ছবি তুলতে সর্বক্ষণ ফটোগ্রাফারকে প্রস্তুত থাকতে হয়।
পোস্ট-ওয়েডিং: এই শুটেই থাকে তাদের ভালোবাসার গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবিগুলো। বিয়ের অ্যালবামে এসব না হলেই নয়।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফির হালচাল নিয়ে ফটোগ্রাফার প্রীত রেজার কথা-
বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তোলা আজকাল আর বিলাসিতার মধ্যে পড়ে না। আমাদের দেশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এখন অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সবাই চান তাদের জীবনের স্মরণীয় এই দিন স্মৃতিতে ধরে রাখতে। ফটোগ্রাফারই সে দায়িত্ব নেন। এই ছবিই অনেক বছর পর চোখের সামনে তুলে ধরে মধুর স্মৃতি, খুনসুটিমাখা মুহূর্তগুলো। তাই বলা যায়, এসব দুর্লভ মুহূর্তের স্মৃতি ধরে রাখার কারিগর ওয়েডিং ফটোগ্রাফাররা।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে বিয়ের মুহূর্তকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে তরুণ ফটোগ্রাফারদের। ফটোশপ এক্সপার্ট না হয়ে মনোযোগ দিতে হবে ফটোগ্রাফির দিকেও।
অনেক ফটোগ্রাফারই নানা ধরনের কোর্স করান। যারা আসলেই এ বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তারা এসব জায়গায় গিয়ে শিখতে পারে। এসব কথা বলছি কারণ, ভালো একটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন পজিটিভ প্রতিযোগিতা। খেয়াল রাখতে হবে, কে কত ভালো কাজ করছে। প্রতিযোগিতা হবে কাজে, অর্থ উপার্জনে নয়। পেশাটিকে সম্মান দিতে হবে। কেননা এটা একটা আর্টওয়ার্ক। প্রতিটি পেশাতেই কিছু নবাগত থাকে, যাদের কোনো লক্ষ্য থাকে না। ফটোগ্রাফিতেও প্রায়ই এমন কিছু তরুণকে দেখি, যারা কিছু না শিখেই একটি ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তোলা শুরু করে। তারা কেন ফটোগ্রাফি করে, সেটাই জানে না। এরা আসে কিছু টাকা কামাতে। দুদিন পর অন্য কাজ শুরু করে। বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগ সদস্য ছবি তোলাকে তাদের একটি শখের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে।
তারপরও বলতে চাই, ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে আমাদের অর্জন অনেক। নতুনেরা এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সুনামও কুড়িয়েছে তারা। তবে, একা সব বদলে ফেলা সম্ভব নয়। টিম হয়ে কাজ করলে আরও ভালো কাজ করা যায়। আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে কাজ করলে সাফল্য অবশ্যই পাওয়া যাবে।
শেষ কথা
ছবি তোলায় হাত ভালো, তেমন জানাশোনা মানুষ থেকে থাকলে তাকে আগেভাগেই বাগিয়ে রাখুন। স্বস্তি আর সুবিধা- সবটাই বেশি পাবেন। আবার ডিএসএলআর থাকা মানেই কেউ একজন যে ফটোগ্রাফার হয়ে গেল, তা-ও তো নয়, খেয়াল রাখুন সেদিকে। আপনি ফটোগ্রাফার চাচ্ছেন, ক্যামেরাওয়ালা কোনো লোককে নয়!

ছবি: ড্রিম ওয়েভার

আমাদের দেশে বিয়েতে সাধারণত তিনটা ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গায়েহলুদ, বিয়ের মূল পর্ব আর সবার শেষ দিনে বউভাত। প্রতিটি দিনের জন্যই প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার চাই, নাকি কেবল বিয়ের দিন, সেই সিদ্ধান্ত নিন আগে। যাকে ঠিক করতে যাচ্ছেন ফটোগ্রাফার হিসেবে, তার কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন। ফেসবুক পেজে ফটোগ্রাফারদের অন্যান্য কাজের নমুনা থাকে, সেগুলোয় ঢুঁ মারুন। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম জেনে তাদের কাজ দিলেও ওখানকার যে ফটোগ্রাফার আপনার অনুষ্ঠানে ছবি তুলবে, তার সঙ্গে কথা বলে নিন।
শুধু প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের জন্যই রেডি থাকবেন, পোজ দেবেন, সেটা কিন্তু একদম ভুল হবে। বিয়ের পুরোটা সময় কাছের-দূরের বন্ধুবান্ধব আর অন্যান্য মানুষের হাতে বহু ছবি উঠবে, তার মাঝেই অসাধারণ কিছু ছবি পাবেন। তাই ক্যামেরা হাতে যে কাউকেই হেলাফেলার নজরে দেখবেন না যেন!
নিপুণ নির্দেশনায় তোলা হাজার ছবির ভিড়ে হুট করে তোলা অপ্রস্তুত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত কিছু ছবি বেরিয়ে আসবে, যা আরও অনেক দামি হয়ে থাকবে। বিয়ের অনেক এমন ন্যাচারাল মোমেন্টের খোঁজ মিলবে অপেশাদার আলোকচিত্রীদের সংগ্রহেই। কাজেই তাদের সুযোগ করে দিন ছবি তোলার জন্য।
বিয়ের মুহূর্তগুলোর কোনোটিই যেন বাদ না যায় ক্যামেরার ফ্রেম থেকে। বেশি রংঢং অপছন্দ হলে খুব জেনেশুনে ফটোগ্রাফার ঠিক করুন। আজকাল অতিরিক্ত নাটকীয়তার চর্চা করতে গিয়ে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি পুরো ড্রামাটিক ব্যাপার হয়ে গেছে। এসবের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ছবি তোলায় ভালো হাত রয়েছে তেমন ফটোগ্রাফার খুঁজে পেতে অসুবিধা হতে পারে।
স্মরণীয় সেই দিনটির প্রতিটি বিশেষ মুহূর্ত খুব যতনে তোলা থাকুক ওয়েডিং অ্যালবামের জন্য। ছবির দল যেন বহু বছর বাদেও এই সময়টার মুগ্ধতা নতুন করে নিয়ে আসে।

 গ্রন্থনা: সাদমান সাকিব
মডেল: ইশা
ওয়্যারড্রোব: অদ্রিয়ানা এক্সক্লুসিভ
জুয়েলারি: জড়োয়া হাউস
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top