skip to Main Content

ফিচার I যুগল ফকিরি

দুয়ের একাত্মতাই ফকিরি বিবাহের মূলমন্ত্র। যা আসলে যুগল সাধনা। ফকিরির এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখছেন অতনু সিংহ

সাধারণত বিবাহ হলো দুটি মানুষের যৌথ যাপনের জন্য একটি সামাজিক/আইনি চুক্তি। এর মাধ্যমে নারী ও পুরুষ পারস্পরিক দায়বদ্ধতার সম্পর্কে যুক্ত হয়। পরে এই সংসারই হয়ে ওঠে তাদের ব্যক্তিজীবনের কেন্দ্র ও পরবর্তী প্রজন্মপরম্পরার উৎসমুখ। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিবাহব্যবস্থার সবচেয়ে প্রধান দিকটি হলো ব্যক্তিজীবনে দুটি মানুষের একীভূত হওয়া। এই দুইয়ের এক হয়ে ওঠার এক পরমার্থিক প্রকাশ লক্ষ করা যায় ফকিরি সাধনায়। এটা যে মানবসমাজের যূথবদ্ধতার অংশ, সেই বিষয়টি যৌথ ফকিরি সাধনার মধ্যে স্পষ্ট। বাংলার ফকিরিতে যুগল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফকিরি সাধনায় যুগল একত্র হয়ে আত্মের মধ্যে পরমের সন্ধান চালায়। তাই এই জুটি বাঁধা বাংলার ফকিরি সিলসিলার মুখ্য বিষয়। একেই বলা যেতে পারে ফকিরি বিবাহ।
বাংলার ফকিরি বিবাহের আচারে বৈষ্ণব সাধনসঙ্গীদের ঘরবাঁধার সঙ্গে মিল থাকলেও নানা ক্ষেত্রে এটা স্বতন্ত্র। কী রকম সেটা? একই সাধনপথের দুজন শিষ্য যদি একে অন্যকে যুগল বলে নির্বাচন করেন, তখন গুরুর কাছে অনুমতি নিতে হয়। অথবা কখনো কখনো গুরুও ঠিক করে দেন কে কার যুগল হবেন। এরপর গুরু একটি দিনক্ষণ ঠিক করেন, ওই দিন গুরুর দেওয়া কন্ঠি বা কাঠের মালা বদল করে একে অন্যের সাধনসঙ্গী হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করেন সাধক-সাধিকা। কিন্তু এখানেই বিষয়টা শেষ নয়। এরপর এই যুগলের খিলকা নেওয়ার পালা। অবশ্য অনেক সময়েই কন্ঠি বা কাঠের মালাবদল ও খিলকাপ্রাপ্তির অনুষ্ঠান একযোগেই সম্পন্ন হয়।

‘কে তোমারে এ বেশ ভূষণ পরাইলো বলো শুনি’
ফকিরি গ্রহণকে বলা হয় খিলাফতপ্রাপ্তি। এ জন্য খিলকা গ্রহণ করতে হয়। খিলকা না নিলে যুগল সাধনা বা দুইয়ের মধ্যে এক হয়ে পরমের সন্ধান সম্ভব নয়। গুরু যদি মনে করেন খিলকা দেওয়া উচিত, তবেই তা দেওয়া হয়। এটি গুরুর আসনে ওই যুগলের অধিষ্ঠান ও ফকিরিপ্রাপ্তি। এই আচার অনুষ্ঠানে সাধক-সাধিকাকে চোখ বেঁধে স্নান করিয়ে আনা হয় আশ্রম-সংলগ্ন নদী/পুকুরের মতো কোনো জলাশয় থেকে। এরপর দুজনকেই পরানো হয় ‘খিলকা’। যা মূলত ফকিরির জন্য দীর্ঘ সাদা বসন। খিলকা ছাড়াও যুগলের মধ্যে যিনি পুরুষ, তার বিশেষ অঙ্গে কৌপিন বেঁধে দেওয়া হয়। মাথায় বেঁধে দেওয়া হয় পাগড়ি। কামকে বশে রাখার জন্যই এই রীতি। ইন্দ্রিয় জয় করে আপন অন্তরে বিরাজমান সাঁইয়ের সন্ধানহেতু ফকিরিতে এই রীতির প্রচলন। এরপর দুজনের হাতেই তুলে দেওয়া হয় নারকেল মালার করঙ্গ, আমৃত্যু এতে তাদেরকে জলপান করতে হবে। এ ছাড়া দেওয়া হয় মাটির পাত্র, এই পাত্রেই খিলকাপ্রাপ্তির পরবর্তী সময়ে ৯টি ঘর থেকে মাধুকরী বা ভিক্ষা করে অন্ন সংগ্রহ করতে হবে ফকিরি পথের সাধক-সাধিকাকে। চোখ বাঁধা অবস্থায় স্নান সারা ও খিলকা প্রদানের পরে গুরু ও গুরুমা ফকিরির আরও কিছু আচারের মাধ্যমে যুগল সাধককে ফকিরি বা খিলাফত প্রদান করেন। এই অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ লালন সাঁইয়ের গানেও রয়েছে। এই আচারকে লালন বলছেন ‘জিন্দা দেহে মরার বসন, খিলকা তাজ আর ডোর কোপিনী’। এই প্রসঙ্গে এসেছে ‘জ্যান্তেমরা’র কথাটা।
জিন্দা মরার পোশাক পরা
আপন ছুরত আপনি সারা।
ভবলোককে ধ্বংস করা
দেখি অসম্ভব করণী।।
ফকিরিতে জ্যান্তেমরার ধারণা তাৎপর্যপূর্ণ। সাধন তরিকায় এমন এক পর্যায়ে যেতে হয় যখন জীবিতের স্বাভাবিক ইন্দ্রিয়প্রবণতা থেকে মুক্তি ঘটে। অর্থাৎ দেহের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তখন নিজের হাতে, ষড়রিপু তখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। রিপুর কোনো প্রকাশ সচরাচর ঘটবে না, এমন এক অবস্থায় চলে যেতে হয় ফকিরির মধ্য দিয়ে। তাই গানে গানে বলা হচ্ছে,
যে মরণের আগে মরে
শমনে ছোঁবে না তারে।
শুনেছি সাধুর দ্বারে
তাই বুঝি করেছ ধনী।।
এই অনুষ্ঠানে চোখ বেঁধে ফকিরি গান গাইতে গাইতে সাধু ও ভক্তরা আশ্রমের চারপাশে ওই যুগলকে প্রদক্ষিণ করান। গুরু ও গুরুমাকে সালাম দিয়ে বা ভক্তিপ্রদানের মাধ্যমে এই আচার অনুষ্ঠানের সমাপন হয়। এরপ নতুন ফকির-ফকিরানির চোখ খুলে দেওয়া হয়। তাদের জীবনে শুরু হয় মাধুকরীসহ সাধনার নতুন অধ্যায়। এ পথে একবার গেলে ফিরে আসা যায় না। গানেও সে কথা বলা হয়েছে,
সেজেছ সাজ ভালই তরো
মরে যদি ডুবতে পারো।
লালন বলে যদি ফেরো
দুকূল হবে অপমানী।।

যুগল ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ
এবার বোঝা দরকার, এই যুগল ও যুগলের একাত্ম হওয়ার বিষয়টি ফকিরিতে কেন গুরুত্বপূর্ণ। ধারণাটি শুধুই আধ্যাত্মিক অর্থে নয়, বরং দার্শনিক ও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যবহ।
বিষয়টি বোঝা যাবে বাংলায় ফকিরির ইতিহাসচর্চা ও তার দার্শনিক বিষয়টি স্মরণ করলে। এই সাধনা মূলত চৈতন্যদেবের জাতপাতবিরোধী ভাবান্দোলন এবং তার দার্শনিক চিন্তার পরম্পরা। আর শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা তত্ত্ব ও মনুবাদী বর্ণবিভাজনকে বাংলায় আমদানি করে জাতপাত-বর্ণবাদের মাধ্যমে ব্রাহ্মণেরা নিজেদের কর্তৃত্বকে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক চেহারা দিতে শুরু করেছিল। একই সঙ্গে প্রকৃতি ও মানবসত্তার সংযোগের বিদ্যা ‘তন্ত্র’কে বিকৃত করে ব্রাহ্মণসমাজের ব্যভিচার ও কালাজাদুবিদ্যার উপায়ে পর্যবসিত হলো। একমাত্র নিজেদের ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সমাজে বর্ণবাদী শাসন কায়েম করেছিল তারা, যাতে জগতের বা গণসমাজের ইহলৌকিক চাওয়াপাওয়া এমনকি জীবনের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলোও হয়ে উঠল ‘মিথ্যা’ বা ‘মূল্যহীন’। পরিণতিতে অব্রাহ্মণসমাজের ওপর নেমে এলো ব্যাপক নিপীড়ন! নারী হয়ে উঠল ব্রাহ্মণ পুরুতপতির রমণবিনোদনের উপায়। এই সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের সেনযুগের অবসানের পরে সুলতানি যুগে বঙ্গের বৃহৎ নদীয়ায় চৈতন্যের আবির্ভাব। বৃহত্তর নদীয়ায় অদ্বৈতাচার্য, চৈতন্য ও নিত্যানন্দ- এই তিন মহাপুরুষের সামাজিক রাজনৈতিক ও দার্শনিক সংগ্রামই ছিল বাংলায় ফকিরি ধারার সূচনা। চৈতন্যকেই নদীয়ার প্রথম ফকির বলে অভিহিত করেছেন লালন সাঁই। তাঁর গানে আমরা পেয়ে যাই, ‘এমনও বয়সে নিমাই ঘর ছেড়ে ফকিরি নিলে, ধন্য মায়ের নিমাই ছেলে’। লালন সাঁইয়ের গান থেকেই আমরা জ্ঞাত হই, জাতগোত্র বিভাজনের বিরুদ্ধে একদা আরবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংগ্রাম চৈতন্যদের প্রেরণা দিয়েছিল। তাই সুলতান যুগে বাংলায় ফকিরির সূচনা চৈতন্যের হাত ধরেই। এই ফকিরির মাধ্যমে বর্ণবাদ, বিত্তবাদ ও লৈঙ্গিক বিভাজনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তিনি।
বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য প্রতিহত করতে শঙ্করাচার্যীয় একত্বের দর্শনকে খন্ডন করতে হয় চৈতন্যকে। শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে খন্ডন করে অচিন্ত্য ভেদ-অভেদ দর্শনের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ পেশ করেছিলেন শ্রীচৈতন্য। তিনি ব্রহ্মকে অদ্বৈত সত্তা হিসেবে খারিজ করলেন। বরং বললেন দ্বৈত না হলে অদ্বৈত হওয়া যায় না। আরও বললেন, জগতের রূপবৈচিত্র্যও সত্য। সহজ কথায়, জগৎকে মায়া বলে উড়িয়ে না দিয়ে তার রূপবৈচিত্র্যের মাধ্যমে পরম নিরাকারের ভজনা করা দরকার। দুয়ের মধ্য দিয়ে এক বা একের মধ্যে দুয়ের ধারণা এর আগে আমরা সাংখ্যদর্শনে দেখেছি। দ্বৈতাদ্বৈতবাদকে বলা যেতে পারে পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্মতায় সমর্পিত হওয়ার সাংখ্যদর্শনের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুনর্নির্মাণ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্ম অদ্বৈত’ আর ইসলামের ‘নিরাকার অখন্ড আল্লাহই একমাত্র উপাস্য’ শুনতে এক রকম হলেও, সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে মহানবী (সা.) আর শঙ্করাচার্য পরস্পর বিপ্রতীপ। কেননা, কাবার পৌত্তলিকতার কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সমাজের গোত্রবিরোধ ও জাতিবাদকে প্রতিহত করে একটি উম্মাহ তৈরির জন্য নিরাকার আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলো। এ জন্য বলা হলো, আল্লাহ একমাত্র উপাস্য। কিন্তু শঙ্করের অদ্বৈতবাদে ব্রহ্ম সত্য আর জগৎ মিথ্যা হয়ে যাওয়ায় ব্রাহ্মণেরা হয়ে গেল সামাজিক সবকিছুর একমাত্র অধিকারী; কারণ ‘নিরাকার ব্রহ্ম’র জ্ঞান একমাত্র তাদের।

এ ছাড়া ইহলৌকিক বৈচিত্র্যকে স্বীকার না করে ব্রাহ্মণ্যবাদ ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী ব্রাহ্মণদের জন্যই যাবতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধা কুক্ষিগত করেছিল ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে। ফলে শূদ্রের জীবনে নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়। তাই পুরুষ ও প্রকৃতির একাত্মতায় রূপবৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে রূপ থেকে অরূপে যাওয়ার দার্শনিক ডিসকোর্স নির্মাণ করলেন চৈতন্য, যাতে যুগল হয়ে উঠল গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি ‘দেহ’ সম্পর্কিত ধারণায় পরিবর্তন ঘটল। এর আগে স্মার্তব্রাহ্মণেরা বঙ্গের প্রকৃতিনিবিড় তন্ত্রবিদ্যার বিকৃতি ঘটিয়ে দেহকে করে তুলেছেন ইন্দ্রিয়সুখের আধারমাত্র। এতে মূলত নিপীড়নের শিকার হয়েছে নারী। চৈতন্য তন্ত্রকে খারিজ করলেন এইভাবে, প্রথমত তিনি বললেন, প্রতি ব্যক্তির বহিরঙ্গে রয়েছেন রাধা আর অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ। এ ছাড়া বললেন, পরম পুরুষ একজনই- তিনি কৃষ্ণ। জগতের সকল প্রাণী তার লীলার রূপমাধ্যম অর্থাৎ রাধা। এখান থেকেই যুগলভাব ও যুগলসাধনার সূচনা। তন্ত্রের মতো দেহ দিয়ে ইন্দ্রিয়ের মুক্তি নয়। বরং যুগলের দুজন প্রতিটি বিষয়ে একে অন্যের অভিন্ন সত্তা। একে অন্যের অন্তরে মানুষ হয়ে মনের যিনি আসল মানুষ, তাঁর সন্ধান করাই ফকিরির যুগলসাধনা। দুই থেকে এক হয়ে এককের সন্ধান ও তাতে মগ্ন হয়ে থাকাই ফকিরি। এই পথ রূপবৈচিত্র্যের ভেতর দিয়ে অরূপে যাওয়া, এই পথ ইহলৌকিক জগতের মধ্যেই এই তার পরমার্থিক প্রকাশ। এ পথেই জানা জানা যায়, পরমের মালিকানা কেবল ব্রাহ্মণের নয়, বরং জীবজগতের সবাই তার আলোকপ্রাপ্ত।
চৈতন্যের অবর্তমানে নিত্যানন্দের হাত ধরে এগিয়েছে দ্বৈতাদ্বৈতবাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পরম্পরা। যা পরবর্তীকালে লালন সাঁইসহ বৃহৎ নদীয়ার সকল সাধন সিলসিলার মধ্যে ব্যাপ্ত হয়েছে। চৈতন্য-নিত্যানন্দ পরম্পরার সব কটি ঘর ও ঘরানার মধ্যেই যুগলসাধনার বিষয়টি রয়েছে। এভাবেই মনের মানুষের সন্ধানকার্য বহমান।
ফকির-ফকিরানির যৌথ যাপন আসলে পারস্পরিকভাবে এক হয়ে যাওয়া তা যেকোনো সাংসারিক বন্ধনের মতোই। কিন্তু এই বাঁধন ছিন্ন হলে ফকিরিচ্যুত হতে হয়। কেননা দুই থেকে এক হয়ে ফের দুই হওয়া যায় না।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top