skip to Main Content

ফিচার I মৎস্যমঙ্গল কথা

মাছের সঙ্গে আমরা কি সম্পর্কের গন্ডিটা ছোট করে আনছি? এটি কি শুধুই আমাদের খাদ্য, নাকি সাংস্কৃতিক চিহ্নও? এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজছেন সামীউর রহমান

বাঙালি সংস্কৃতিতে মাছ কি শুধুই খাবার? মাছের সঙ্গে মানুষের কি স্রেফ খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু। মেঘের ডাক শুনলেই খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ ভাজা খাওয়ার ইচ্ছে, সেকি স্রেফ বিজ্ঞাপনের জোরে? নাকি ডিএনএর গভীরে প্রোথিত কোনো গোপন স্মৃতির ভেসে ওঠা। গাঙ্গেয় বদ্বীপে মাছ নিছক খাদ্য নয়। এটি মিশে আছে লোকগাথা সাহিত্যে, উপন্যাসে, কবিতায়। কবির চিন্তার জল আর ঔপন্যাসিকের ভাবনার অতলেও তাই এ প্রাণীর অবাধ বিচরণ। মাছ মিশে আছে সামাজিক ও লৌকিক আচারে, কিংবদন্তিতে, ভাষায়।
ছোট্ট একটি উদাহরণ বা শব্দবন্ধ দিয়ে অনেক কিছুই বোঝাতে বাগধারা বা প্রবাদ প্রবচনের শরণ। বাংলা বাগধারায় মাছের কত রকম উপস্থিতি! কই মাছের প্রাণ, ঝাঁকের কই, মাছের মায়ের পুত্রশোক, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, গভীর জলের মাছ, রাঘব-বোয়াল, রুই-কাতলা, চুনোপুঁটি, পুঁটি মাছের প্রাণ, ধরি মাছ না ছুঁই পানি, মাছের তেলে মাছ ভাজা- এমন আরও কত উদাহরণ আছে! খনার বচনে আছে- মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই; লাউগাছে মাছের জল, ধেনো মাটিতে ঝাল প্রবল। ছোট মাছকে যখন বড় মাছ খেয়ে ফেলে, তখন তাকে বলে মাৎস্যন্যায়। সমাজে যখন এই পরিস্থিতি হয়, তখনো মাৎস্যন্যায়ই বলে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এ রকম পরিস্থিতি থেকেই রাজা হয়ে ওঠেন গোপাল, সূচনা করেন পাল বংশের।
লোকসংস্কৃতিতেও মাছ স্বমহিমায় বিরাজমান। গ্রামীণ জীবনের যে দারুণ ছবি জসীমউদ্দীন তাঁর সংকলিত ‘বাঙালির হাসির গল্প’ বইতে জমা করেছেন, তাতে মাছের ছড়াছড়ি। স্বামীকে ষোলোকলা দেখাতে গৃহিণীর চাষের ক্ষেতে শোল মাছ রেখে আসার গল্পের রেশ কাটার আগেই চোখের সামনে হাজির হয়ে যাবে লোভী মুসাফিরের গল্প। বাজারে এক ধনী গৃহস্থকে বড় মাছটা কিনতে দেখে মুড়ো খাবার লোভে তার বাড়িতে হাজির হয়ে যাবার পর চতুর গিন্নি কী করে সেই মুসাফিরকে শায়েস্তা করে, সেই গল্পটা যে কারও মুখেই হাসি ফোটাবে। গোপাল ভাঁড়ের ইলিশ কিনে বাড়ি ফেরার গল্পটা মনে পড়ে কি? সেই যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে জব্দ করতে ফেলেছিলেন এক আজব পরীক্ষায়; হাতে করে হাট থেকে ইলিশ ঝুলিয়ে ফিরবে গোপাল আর কেউ দাম জিজ্ঞেস করবে না। তারপর গোপাল যে লাজলজ্জা ভুলে ধুতি খুলে মাথায় বাঁধবে, সেটা কে জানত! ইলিশের পিঠের একটা অংশ কেন বাদামি, তা নিয়েও আছে করুণ এক গল্প। হরিণ আর ইলিশ বাজি ধরেছিল, দৌড়ে কে কাকে হারাবে। বিজয়ীর পুরস্কার বিজিতের পিঠের মাংস।

নির্মম সেই বাজিতে হেরে গিয়ে হরিণ তার পিঠ থেকে এক টুকরো মাংস কেটে দেয় ইলিশকে। সেই থেকে এখনো ইলিশের পিঠে নাকি হরিণের মাংসের স্বাদ! পীর-দরবেশদের নিয়ে নানান জায়গায় যেসব অলৌকিক গল্পগাথা শোনা যায়, তাতেও বড় অংশ জুড়ে আছে মাছ। বগুড়ায় মহাস্থানগড়ের কাছে আছে শাহ সুলতান মাহমুদ বলখীর মাজার। কথিত আছে, তিনি নাকি মাছের পিঠে চড়ে এসেছিলেন বরেন্দ্রভূমিতে! সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারের গজার মাছ নিয়েও জনশ্রুতি আছে, হজরত শাহজালাল নিজে এই পুকুরে মাছ পুষতেন বা কোথাও লাল রঙের সুন্দর মাছের পোনা দেখে দরগাহ-সংলগ্ন পুকুরে তা ছেড়েছিলেন। এখনো দর্শনার্থীরা দরগাহর পুকুরে গজার মাছ দেখতে যান। মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাসের মা সত্যবতী জন্মেছিলেন মাছের গর্ভে। সত্যবতী ও তার যমজ ভাইকে মাছের পেটে পেয়েছিলেন ধীবরদের রাজা। তাই সত্যবতীর গায়ে ছিল মাছের তীব্র গন্ধ, যে কারণে তার নাম হয়েছিল মৎস্যগন্ধা। এই সত্যবতীর সন্তানদের বংশধরই কুরু ও পান্ডব, যাদের লড়াই আর রাজনীতির বিশাল আখ্যান মহাভারত। এই মহাকাব্যের নায়ক অর্জুনকে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে তীর বিদ্ধ করতে হয়েছিল মাছের চোখে!
বেহুলা নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক চিরায়ত বাঙালি নারীর মুখচ্ছবি। লখিন্দরের সঙ্গে বেহুলার বিয়েতে চাঁদ সওদাগর অতিথি আপ্যায়নে খাইয়েছেন বেসন দিয়ে চিতল মাছের কোল ভাজা, জিরে লবঙ্গ মাখিয়ে বড় বড় কই মাছ ভাজা, লঙ্কা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল, আম দিয়ে কাতলা মাছ, মহাশোলের অম্বল, রুই মাছের মাথা দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল- এমন আঠারো রকমের মাছের পদ। সেই বিয়ের ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে অবশ্য মেনু উদ্ধার করা হয়নি, সেটি পাওয়া গেছে বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে দেবদেবীর বন্দনায় যেসব মঙ্গলকাব্য রচনা করা হতো, তাতে নানান বিভঙ্গে উঠে আসে সাধারণ মানুষের গল্পও। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখী ব্রাহ্মণভোজনের জন্য রেঁধেছিলেন আম দিয়ে শোল মাছ, বাচা মাছের ঝোল, ভেটকি ও খয়রা মাছ ভাজা। তেতো রান্না করেছেন পচা মাছ দিয়ে, তিতকুটে স্বাদ কাটাতে দিয়েছেন গুড়। এপার এবং ওপার, কোনো বাংলাতেই অবশ্য এখন আর বিয়ে বা অন্নপ্রাশন, কোনো অনুষ্ঠানেই এমন সব ব্যঞ্জনের স্বাদ পাওয়া যাবে না।

ক্যাটারিং সার্ভিসের কল্যাণে হিন্দু পরিবারের বিয়েতেও কমে এসেছে আগের দিনের সেই পাত পেড়ে খাওয়ানোর চল। তবে মাছভাজাটা এখনো অন্ধের যষ্টি হয়ে টিকে আছে, ওপারে যেটা হয়ে গেছে চিলি ফিশ বা ফিশ ব্যাটার ফ্রাই! বাংলাদেশে মুসলমানদের বিয়েতে মাছ থাকে না বললেই চলে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে রূপচাঁদা বা খুলনার দিকে বরযাত্রীদের চিংড়ি খাওয়ানোর প্রচলন আছে। তবে গায়েহলুদে কনের বাড়িতে মাছ পাঠানোর প্রথাটা এখনো টিকে আছে মুসলিম পরিবারগুলোতেও। এক জোড়া মাছের একটিকে নথ পরিয়ে লাল কাপড়ে মুড়ে কনেবউ বানিয়ে পাঠানোর সঙ্গে মাছের পেটে পয়সা বা টাকা ভরে দেওয়াটা এখনো হারিয়ে যায়নি। বিয়ের পর জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে বাজার থেকে মাছ কেনা আর নতুন বউয়ের সেই মাছ কাটার মাধ্যমে সংসারজীবনের সূত্রপাতের ছবিটাও হয়ে যায় আঁকা!
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের পর চোখ ফেরানো যাক আধুনিক যুগের প্রখর বাস্তবতায়। সাহিত্যে দেবদেবীর বন্দনা নয়, মানুষের জীবনই মুখ্য। আবু ইসহাক তার ‘জোঁক’ ছোটগল্পে দেখিয়েছেন, কী করে সামান্য মাছভাতেই তৃপ্ত শ্রমজীবী মানুষ, ‘কি রানছে রে তোর মায়? ট্যাংরা শাক আর কলমী শাক। মাছ পাইলো কই, বড়শী দিয়া ধরছিল মায়।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের ইলিশ ঘাটের ছবিটা মনে পড়ে, ‘কাদার মধ্যেই একটা লোহার টেবিল ও কাঠের চেয়ার পাতিয়া চালানবাবু কেদারনাথ মাছ গোনা দেখিয়া খাতায় লিখিয়া যাইতেছে। একশ মাছ গোনা হইবা মাত্র তার চাকরটা ছোঁ মারিয়া চালানবাবুর চাঁদা পাঁচটা মাছ তুলিয়া লইবে। পাঁচটা ওয়াগন দাঁড়াইয়া আছে। মাছে বোঝাই হইয়া যথাসময়ে ওয়াগনগুলি কলিকাতায় পৌঁছাইবে। সকালে বিকালে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ বাড়ি ফিরিবে। কলিকাতার বাতাসে পাওয়া যাইবে পদ্মার ইলিশ ভাজার গন্ধ।’ কুবেরের মতো জেলেরা শখ করে নয়, আর কিছু জোটাতে না পেরেই ইলিশ খায়। পিসি ইলিশের তেলে ইলিশ ভাজেন, ইলিশ মাছ ভাজা আর লঙ্কারক্তিম তপ্ত ফেনসমেত অন্নে কুবের মুহূর্তেই পেট ভরায় আর ঘরের পুরুষরা যখন পদ্মার বুকে মাছ ধরায় ব্যস্ত, তখন মেয়েদের ঘরোয়া আলাপে শোনা যায়, ‘পাক করছিলি কি? আখায় দুগা বাইগন দিছিলাম, আর ইলশার ঝোল।’
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম জীবনের রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। মধ্যবিত্ত জীবনে মাছ কতটা খুশির উপলক্ষ নিয়ে আসে, সেই ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন অনেক উপন্যাস আর ছোটগল্পে। এমনি এক গল্প ‘ফেরা’। মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসার, মেয়েকে আলুভাজি দিয়ে খাওয়াতে সাধাসাধি করছে মা। লোভ দেখাচ্ছে ডিম ভাজার। মেয়ের আবদার, ‘পোলাও কোর্মা খাব মা।’ এ রকম একটা দুঃখের মুহূর্তকে এক পলকে সুখী সংসারে বদলে দেয় একটা কানকোয় দড়ি বাঁধা রুই মাছ! ঝড়-বৃষ্টির রাতে জলকাদা ভেঙে দীপুর বাবা বাড়িতে এসেছেন হাতে করে মাছ নিয়ে, উপলক্ষ চল্লিশ টাকা বেতন বৃদ্ধি। এরপর বাবা-মেয়ের কথোপকথন, ‘আজ আমরা দুবার করে খাব, তাই না বাবা? হ্যাঁ। দুবার করে কেন খাব বাবা? বড় মাছ এনেছি সেই জন্যে।’ এ রকমই আরেকটা গল্প ‘নিশিকাব্য’। আনিস ঢাকায় চাকরি করে, গ্রামে থাকে পরী। অফিসের কাজে ময়মনসিংহ এসে সকাল সকাল কাজ শেষ করে মাঝরাতে বাড়ি যায় আনিস, তাকে দেখে চমকে ওঠে বাড়ির সবাই। পুকুরে জাল ফেলা হয়, ধরা হয় মৃগেল মাছ। মাঝরাতে আবার চুলা ধরিয়ে রান্না, সকালের ট্রেন ধরার তাড়ার মাঝে এই রাতটাই যে প্রাপ্তি! মাছের সঙ্গে কাঁটাও হুমায়ূনের চোখ এড়ায়নি। আরেকটি ছোটগল্প ‘সে’-এর শুরুটা হয় মেয়ের গলায় ফুটে যাওয়া কাঁটা বের করার কাজে পরিচয় হওয়া এক চিকিৎসকের সূত্র ধরে। হলুদ পাঞ্জাবির হিমু ফুফাতো ভাই বাদলের গলার কাঁটা নামিয়ে দেয় অদ্ভুতভাবে! ইলিশ মাছের ডিম, খলিসা মাছের ঝোল, হাওড়ের লালমুখো পাবদা, শিং মাছের ডিমের পাতুরির মতো অসাধারণ সব খাবারের বর্ণনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মে। জনপ্রিয় বহুব্রীহি নাটকে ‘বাবা’ রূপী আবুল হায়াতকে ভাবতে দেখা যায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এক বছর মাছ ধরা বন্ধ রাখার ব্যাপারে। এক বছর না হোক, ডিম ছাড়ার মৌসুমে এবং বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখার সরকারি নির্দেশনার সুফল মিলতে শুরু করে। বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে হয়ে উঠেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বেড়েছে ইলিশের উৎপাদনও।
কবিতার শব্দস্রোতেও সাঁতার কেটেছে মাছ! বুদ্ধদেব বসুর আস্ত কবিতাই আছে ইলিশ নিয়ে, ‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/ জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব, নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়। তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।’ গানের কলিতে আছে চিতল বন্দনা, ‘চিতল মাছের মুইঠ্যা, গরম ভাতে দুইটা/ ভুইল্যা বাঙালি খায় চিনা জাপানি লুইট্যা পুইট্যা।’ ফিলিপস বাতির বিজ্ঞাপনে ‘মাছের রাজা ইলিশ আর বাত্তির রাজা ফিলিপস’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন।
খাদ্য হিসেবে খুব একটা সমাদৃত না হলেও পরিবেশ সুরক্ষায় প্রাকৃতিক মানদন্ড বলা যায় দাড়কিনা মাছকে। ছোট আকারের এই মাছ বাড়ির আশপাশের অগভীর নালা, ডোবায় জন্মায়। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে আর মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগে এই মাছের আবাসস্থল বিনষ্ট হচ্ছে। এ-জাতীয় মাছ মশার লার্ভা খায়। এগুলো মরে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে মশা দমনও কমে গেছে, বাড়ছে মশাবাহিত রোগ।
মাছ তাই নিছক খাদ্য নয়। মাছ আমাদের প্রতিবেশী হয়ে মিশে আছে গানে, গল্পে, কবিতায়, লোকগাথায়, জীবনধারায়। এ প্রাণী ভালো থাকলে ভালো থাকব আমরাও।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top