skip to Main Content

ফিচার I অতিমারির অর্থনৈতিক নারী

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ বহু মানুষকে কর্মহীন করেছে। এই শূন্যতা পূরণে নারীরাও এগিয়ে এসেছে; দাঁড়িয়েছে ভাই, স্বামী কিংবা বাবার পাশে

করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। চাকরি হারিয়েছে অনেকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীর চাকরি হারানোর হার বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এ বিষয়ে সতর্ক করেছে- এই ঝুঁকি সাম্প্রতিক দশকগুলোয় কাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতার বিষয়ে যে ‘অগ্রগতি’ অর্জিত হয়েছিল, তা মুছে ফেলতে পারে। নারীর কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, চাকরি হারানো নারীদের আবার কাজে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ হবে না।
পোশাক খাত, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ সেবা খাত, আবাসন ও কৃষি এবং গৃহকর্মে দেশের নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। করোনায় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে নারীরা চাকরি হারানো শুরু করেছে। পুঁজিসংকটে পড়ে সরে যাচ্ছে ছোট উদ্যোক্তাও। আবার বিদেশে কর্মরত অনেক নারীই দেশে ফিরে এসেছেন। বিভিন্ন চাকরি থেকেও তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে বা তারা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেকে পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
জাতিসংঘের শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন খাতে চাকরিজীবী নারীর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় ৫১ কোটি নারী করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আইএলও বলছে, পূর্ববর্তী সংকটের চেয়ে এবার নারীদের কর্মসংস্থান পুরুষের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, বিশেষ করে সেবা খাতে মন্দা প্রভাবের কারণে। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টা ১৪ শতাংশ কমে গেছে, যার অর্থ হচ্ছে, প্রায় ৪০ কোটি নতুন বেকারের সৃষ্টি। ২০২১ সালের মধ্যে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আগের অবস্থানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমন অবস্থায় আইএলও সতর্ক করেছে যে কোভিড-১৯ কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সমতার যে জায়গা তৈরি হয়েছিল, তা মুছে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের বিস্তারে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশের সব জেলা ও বিভাগের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ পরিচালনা করে জুনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
আইএলওর এক বিশ্লেষণে বলা হয়, যে কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক মেলে না, সে রকম কাজের তিন-চতুর্থাংশ নারীদের করতে হচ্ছে। সংকটের সময় কাজ পাওয়া খুব কঠিন, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষেরাই কাজগুলো পান। ৩৪টি দেশে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক দেশে এ রকম বাস্তবতা খুব জোরালো যে কাজ পাওয়ার বেলায় নারীদের চেয়ে পুরুষকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
তবে অনেকে মনে করেন, নারীর আবার কাজে ফেরার বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে নারী যে খাতে চাকরি করত, সেটির চাহিদার ওপর। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, চাকরির বাজার থেকে নারীরা বের হয়ে যাচ্ছেন, তবে সেই কাজের চাহিদা আবার ফিরে আসবে কি না, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রিকশাচালকদের চাহিদা আবার বেড়েছে। সেই তুলনায় গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরতদের চাহিদা এখনো তেমনভাবে ফিরে আসেনি। অর্থাৎ, যে কাজে নারীরা নিয়োজিত ছিল, সেই সুযোগ ফিরে আসছে বা ফিরে পাচ্ছে কি না। অনেকে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়েছে। শহরে যে কাজ করত, গ্রামে সেই কাজের সুযোগ নেই। শহরে আবার ফিরে আসার ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা সামলাতে হচ্ছে। অর্থনীতি কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, নীতিনির্ধারকেরা কোন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করবে।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, নারীরা শিক্ষা, কারিগরি দক্ষতায় পুরুষের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি প্রযুক্তিগত (ডিজিটাল) দক্ষতায়ও নারী খুব বেশি আগাতে পারেনি। অথচ নতুন স্বাভাবিকের সঙ্গে সবাইকে অভ্যস্ত হতে হলে এবং কর্মক্ষেত্রে থাকতে হলে এসব দক্ষতা অপরিহার্য। গ্রামীণ নারীদের জন্য ডিজিটাল দক্ষতার বিষয়টি রপ্ত করা আরও ভয়াবহ। নারীরা কর্মক্ষেত্রে আবার কতটুকু ফিরতে পারবে, তা-ই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার ও নারীকে আবারও কর্মমুখী করতে ব্যাপক প্রশিক্ষণের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
তবে করোনা মহামারির সময়ে যখন চারপাশে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন পরিবারে নারীই অর্থনীতির জোগানদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নারীর স্বল্প শিক্ষা, কারিগরি দক্ষতার অভাব সত্ত্বেও তারা বিভিন্ন গৃহকর্মে নিজেদের যেভাবে সক্রিয় করে তুলেছে তা অভাবনীয়। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে খাদ্য, চিকিৎসা, পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেসব দেশে চাকরি হারানো নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক। যদিও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এ সময় খাদ্যসহ অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা ছিল অপর্যাপ্ত। বিশেষত চাকরি হারানো মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য। তখনই সংসারে অর্থনৈতিক উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংকট মোকাবিলা করতে নারীরা এগিয়ে আসেন।
আশাজাগানিয়া সংবাদ হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা করোনাকালে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। ক্রেতা অনলাইনে পণ্য দেখে অর্ডার করছেন এবং সময়মতো সেসব হাতে পেয়ে টাকা পরিশোধ করছেন। করোনাকালে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়েছে। প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, করোনাকাল আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে বরণ করার প্রাথমিক স্টেজ হিসেবে একটি বার্তা দিয়েছে।
এভাবে বাংলাদেশে প্রচুর নারী বেকার ভাই, বাবা অথবা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছে। নিজে বা কখনো অন্যের সহযোগিতায় অনলাইন উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ঘরে খাবার তৈরি করে, কাপড় সেলাই করে, বুটিকের শাড়ি, থ্রিপিস বানিয়ে বা বিনোদন ও শিক্ষামূলক বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করে তারা নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। এমনকি করোনা অতিমারির কারণে বেকার বাবা বা ভাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীরা।
এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড় খাত হলো বিউটি পার্লার, যেখানে লাখ লাখ নারী কাজ করে। কিন্তু এই খাতও করোনার মধ্যে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ ছিল। আরেকটি জায়গায় নারীরা আছেন, সেটি হলো ফ্যাশন ডিজাইন ও বুটিক হাউস। কিন্তু এই খাতের সঙ্গে জড়িত নারীরাও পয়লা বৈশাখ ও দুটি ঈদের বড় বাজার ধরতে পারেনি।
এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়েও কিছু নারী উদ্যোক্তা অবশ্য তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন, তবে তাদের বেশির ভাগই ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। উইমেন চেম্বার অ্যান্ড কমার্স ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের সভাপতি সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদের মতে, এই সময়ে সব নারীকেই বিশেষ সাহায্য করতে পারে ই-কমার্স। কিন্তু এখানে প্রধান সমস্যাটি হলো নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতার অভাব। গুটিকতক নারী, যারা তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ, তারা করোনার মধ্যেও ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনও যদি নারীদের এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করত, তাহলে হয়তো আরও বেশি নারী উদ্যোক্তা ই-কমার্সের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারতেন।
 মনীষা উজ্জয়িনী
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top