skip to Main Content

ফিচার I হারেমের মিথ

বস্তুত, পাশ্চাত্যের ধারণায় হারেমের ছবি তৈরি করা হয়েছে আমাদের মনে। ইতিহাসের বাস্তবতা এর বিপক্ষেই যায়

মধ্যযুগের ইতিহাসে মোগলরা এমন একটা জায়গা দখল করে আছে, যেন আর কেউ এখানে শাসন করেনি। সুলতানি, আফগান-পাঠান আমল- সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে মোগলদের সঙ্গে। এসব নিয়ে তৈরিও হয়েছে নানা গুজব, গল্প আর মিথ। এগুলো থেকে সত্য বের করে আনাটা বেশ কঠিন। এমনই এক বিষয় হলো হারেম।
হারেম শব্দটা উচ্চারণ হতেই যে দৃশ্যপট সামনে চলে আসে, তার কৃতিত্ব পুরোটাই ইউরোপীয়দের। তবে তাদের বর্ণনা বানোয়াট, কল্পনা, অতিরঞ্জিত। কারণ, হারেমে ইউরোপীয়দের প্রবেশাধিকারই ছিল না। আরবি শব্দ হারাম- যার আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা। এ থেকেই হারেম শব্দের উৎপত্তি। প্রাসাদের যে আলাদা অংশে শাসকের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, নারী কর্মচারী, উপপত্নীরা থাকতেন, সেটাই হারেম, হারিম বা হেরেম নামে পরিচিত। বহিরাগত যে কারও জন্য সেখানে প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। মূলত মোগল শাসনামলে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে হারেম গড়ে ওঠে।
এক্সোটিক ইস্ট নিয়ে একটা সময়ে ইউরোপীয়দের আগ্রহের কেন্দ্র ছিল হারেম প্রথা। তাদের সেই আগ্রহের খোরাক হিসেবে হারেমের এক বিকৃত ধারণা গড়ে ওঠে, সেটিই কালের আবর্তে আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাসের কল্যাণে।
আমরা যে হারেমের কথা শুনি, যেখানে নারীরা চার দেয়ালে বন্দি থাকত, এমন হারেমের শুরু কিন্তু আকবরের সময়ে। এর আগে বাবর আর হুমায়ুনের সময়কার ‘হারামান’ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। বাবর যতই অস্বীকার করুন না কেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন চাগাতাই মোঙ্গল। মোগলদের নামও তো এসেছে সেখান থেকেই। যদিও তারা নিজেদের গুরকানি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত, মোঙ্গল পরিচয় ঢাকতে। মোঙ্গলদের শুরু কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী হিসেবেই। বলা হয় সূর্যের স্বর্গীয় আলো থেকে আলানকুয়া গর্ভবতী হয়ে চেঙ্গিস আর তিমুরের গোত্রের আদি মাতা হয়েছিলেন। আবুল ফজলও আইন-ই-আকবরিতে সেকথাই লিখেছেন।
মধ্য এশিয়ার আধা-যাযাবর যোদ্ধা গোত্রপতি বাবর হিন্দুস্তানে যাত্রা কালে তার সঙ্গে কেবল যোদ্ধারাই ছিল না, ‘হারামান’ বা পরিবার নিয়ে চলছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন বয়স্ক পরিচারিকা, তরুণী স্ত্রীরা, বাচ্চা, চাকর-বাকর, বিধবা আত্মীয়া, বিধবা বোনেরা ও অবিবাহিত রাজকীয় আত্মীয়ারা। হারামানের এই নারীরা তাঁবুতে থাকত আর জীবনের অধিকাংশ সময় ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুরুষদের সঙ্গেই দূর-দূরান্তে পাড়ি দিত। প্রথম দিকের মোগল, বিশেষত বাবর ও হুমায়ুন নারীদের বিশেষ সম্মান করতেন। মা ও দাদি- যাদের পরামর্শ ও উপদেশ যুদ্ধরত ভাইদের এবং সা¤্রাজ্যকে একতাবদ্ধ করে রাখত। ঘোড়ায় চেপে হিন্দুস্তানে আসা প্রথম দিকের একজন মহিলা হলেন বাবরের বড় বোন খানজাদা। বাবর ও হুমায়ুন দুজনেই খানজাদাকে বিশেষ সম্মান করতেন; কারণ, জীবনের শুরুতেই খানজাদাকে বড় এক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। বাবরের সুরক্ষার জন্য তাকে পিছে পড়ে থাকতে হয়েছিল উজবেক গোত্রপতি সাইবানি খানের সঙ্গে। মোগলরা কৃতজ্ঞ ছিল গোত্রের এই নারীদের প্রতি যারা বলিষ্ঠ ছিল, শারীরিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিল আর পুরুষের কষ্টের ভাগীদার হতো। শত্রুর হাতে গিয়ে পড়া নারীদের ব্যাপারে সংবেদনশীল ছিল, অনেকটাই তখনকার রাজপুত প্রথার বিপরীত। রাজপুতেরা মহিলাদের শারীরিক সতীত্বের ব্যাপারে কঠোর ছিল আর শত্রুর কবলে পড়া নারীদের ক্ষেত্রে মনে করত ‘সম্মানহানি’।
প্রথম দিকে এই হারামানে কোনো নির্ধারিত স্থান ছিল না নারীর জন্য। কারণ, ঘর আর স্বদেশ- এই দুটো ধারণাই তখন মাত্র জন্ম নিতে শুরু করেছে। রুবি লাল ডোমেস্টিসিটি অ্যান্ড পাওয়ার ইন দ্য আর্লি মোগল ওয়ার্ল্ডে দেখিয়েছেন, শুরুর দিকের মোগলদের ভেতরে প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জায়গার সীমার তেমন পরিষ্কার ধারণা দেয়া নেই। ভ্রমণরত অবস্থাতেই নারীদের বিয়ে হতো, গর্ভবতী হতো, বাচ্চা প্রসব করত, বখে যাওয়া সন্তান আর ভাইদের শাসন করত- পথেই তৈরি করে নিয়েছিল তাদের ঘরবাড়ি। যখন খানজাদা ৬৫ বছর বয়সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কান্দাহার থেকে কাবুলে কামরান মির্জার দরবারে গিয়েছিলেন, তখন এই কষ্টকর আর একাকী যাত্রায় তিনি তার ‘হারেম’কেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। হারেমের সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার প্রবল ইচ্ছাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন, একই সঙ্গে বাদশাহর দূতের দায়িত্বও পালন করেছেন। বাবরের প্রধান স্ত্রী মাহাম বেগম, দিলদার বেগম ও গুলরুখ বেগম এবং উপপত্নী গুলনার আগাচা ও নারগুল আগাচা বাচ্চা প্রসব করেছেন, এমনকি এ সময়েও যখন তারা প্রতিনিয়ত পথ পাড়ি দিচ্ছেন, শত্রুর তাড়া খেয়ে। তারা একটি তিমুরীয় রাজ্যকে তাদের স্থায়ী দেশ বানাবে- এই ধারণা একদম শুরু থেকেই বিশ্বাস করে আসছিল, এমনকি যখন সেটা নিছক মরীচিকা ছিল।
যখন তেরো বছর বয়সে আকবর প্রথম বাদশাহ হলেন, তখন কাবুল থেকে তাকে হারামান পাঠাতে হয়েছিল প্ররোচনা হিসেবে, যেন মধ্য এশিয়ার অভিজ্ঞ যোদ্ধারা তার পাশে থেকে হিন্দুস্তানে এসে লড়াই করে। হারেমের পরিবর্তিত রূপের দেখা পাই আবুল-লেখনীতে। সেখানে প্রথম পৃথক, স্বতন্ত্র রাজকীয় হারামানের কথা জানা যায়। এটা ছিল নতুন জেনানা, একটি আদর্শগত জগৎ, যেখানে নারীরা মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে আসতেন। আকবর অনেক মহিলাকেই স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেছিলেন. তার সিংহাসন পোক্ত করতে, যাদের ভেতরে প্রচুর রাজপুত রাজকুমারীও ছিলেন। সে সময়ে মোগল জেনানা কলেবরে বাড়তে শুরু করে এই সব স্ত্রীর অনুচর আর নির্ভরশীলদের আগমনে। তাই বেলেপাথরে প্রথম দেয়াল ঘেরা প্রাসাদ তৈরি হয় প্রথমে ফতেহপুর সিক্রিতে, এরপর আগ্রায়। আকবরের উদ্দেশ্য ছিল ‘ভালো ও সঠিক শৃঙ্খলা’ বজায় রাখা। এ সময়েই নির্ধারিত হয় যে রাজকীয় মোগল মহিলাদের নাম ধরে ডাকা অশোভন, আর তাই তারা ছদ্মনামের উপাধির বিশালতার আড়ালে চলে যেতে থাকে: আকবরের জন্মদাত্রী হামিদা বানুর জন্য মারিয়াম মাকানি (মরিয়মের মতো খ্যাত) আর জাহাঙ্গীরের জন্মদাত্রী হরখা বাঈয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল মারিয়াম-উজ-জামানি (পৃথিবীর মরিয়ম)। পরবর্তীকালে আরও পরিষ্কারভাবে মুছে ফেলা হয়েছে ‘শুদ্ধতার স্ত¤’¢, ‘শুদ্ধতার শীর্ষ’ ইত্যাদি দিয়ে, আবুল ফজলের উদ্ধৃতিতে। আবুল ফজল সব সময় এই মোগল নারীদের জেনানার ‘পবিত্র নারী’ বলে এসেছেন, হোক সে তরুণী বা বৃদ্ধা। জাহাঙ্গীরের মায়ের পরিচয় আকবরের জীবনীকারদের শব্দমালায় এমনভাবে ডুবে গেছে যে, কেবল একটি বাক্য খুঁজে পাওয়া যায় এ সম্পর্কে। সেখানে বলা হয়েছে, শাহজাদা সেলিমের (ভবিষ্যতের জাহাঙ্গীর) মা হরখা বাঈ। মারিয়াম-উজ-জামানি নামের আড়ালে এই রাজপুত রাজকুমারী হয়ে ওঠেন স্বাধীন, সম্পদশালী রাজকীয় রমণী, যিনি কিনা ষোলো শতকে বিপজ্জনক, জলদস্যুময় জলরাশিতে তার নিজের জাহাজের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
হামিদা বানু ও হুমায়ুন দেশত্যাগে বাধ্য হন, শের শাহ সুরির কারণে, এক বছরের কিছু বেশি বয়সের আকবরকে তারা পেছনে ফেলে যান। হুমায়ুন যখন হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন, আকবর তখন একলা নন। তাকে একদল বিশ্বস্ত মহিলার তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া হয়, যারা নিঃস্বার্থভাবে তার জীবন আর সুখ-দুঃখের খেয়াল রাখত। এদের ভেতরে কেউ কেউ তাকে স্তন্যদান করেছিলেন, যারা ছিল ‘আনাগা’ বা দুধমা। সিংহাসন পুনরুদ্ধার হলেও এর পরপরই হুমায়ুনের মৃত্যু তেরো বছরের আকবরকে সিংহাসনে বসায়। সে সময়েও আকবর নির্ভরশীল ছিলেন এসব দুধমা আর তাদের পরিবারের সহযোগিতা, বিশ্বস্ততা এবং দিকনির্দেশনায়। এদের ভেতরে একজন ছিলেন মাহাম আনাগা। আকবর প্রচন্ড বিশ্বাস করতেন এই নারীর বিবেচনা ও দক্ষতায়। ফলে তিনি প্রচন্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ ও উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং একটা সময়ে গিয়ে সা¤্রাজ্যের প্রভাবশালী ‘উকিল’ বা সহশাসক হয়ে ওঠেন। মাহাম আনাগা মোগল মহিলাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন, যিনি দিল্লির স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন খাইর-উল-মানজিল মসজিদের মাধ্যমে।
আকবর পরিণত হতে শুরু করলে দুধমায়েদের ওপর তার নির্ভরশীলতা কমতে থাকে। কিন্তু তিনি সব সময়েই গভীরভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন হারামানের তিমুরীয় নারীদের প্রতি। তার মা হামিদা বানু ছাড়াও সেখানে ছিলেন গুলবদন ও বেগা, বৈরাম খানের বিধবা সালিমা সুলতান। সালিমা ছিলেন বাবরের নাতি। উনিশ বছর বয়সে তাকে আকবরের হারামানে নেওয়া হয়। তখন আকবরের বয়স বাইশ বছর। যদিও আকবর সালিমাকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তাদের কোনো সন্তান ছিল না। তাই এই সম্পর্ক নিয়ে খানিকটা সন্দেহ রয়ে যায়। আকবরের জেনানা শুধু তার স্ত্রীদের জন্য ছিল না। এটা ছিল তার সেনাপতিদের বিধবা, ভিনদেশ থেকে আশ্রয় নেওয়া আত্মীয়া, বয়স্ক মা ও দাদি-নানি, বিধবা সৎমা, অবিবাহিত আত্মীয়া, ভৃত্য, রাজপুত রাজকুমারীদের অনুচর, বাচ্চা, পরিচারক আর মহিলা কারিগরদের আশ্রয়। আসলে এটা ছিল পবিত্র জায়গা, হারেম শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে ‘পবিত্রতম প্রার্থনার জায়গা, যেখানে যেকোনো ধরনের অপরাধ করা মানা (হারাম)’ থেকে। যখন আকবরের রাজপুত স্ত্রীরা ভারী সব নাম, উপাধি আর উঁচু দেয়ালের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিল, তখনো তিমুরীয় রক্তধারার নারীরা বিস্ময়কর স্বাধীনতা ভোগ করত। সালিমা সুলতান হজে গিয়েছিলেন গুলবদন বেগমের সঙ্গে। এই সফর ছিল সাত বছর দীর্ঘ আর ঘটনাবহুল। আকবরের সন্তান জাহাঙ্গীরের পুনরুত্থানেও তিনি ছিলেন বেশ সরব। জাহাঙ্গীর এমন এক জঘন্য অপরাধ করেছিলেন যে তার বাবার কাছে তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। জেনানার মহিলাদের প্রিয় শাহজাদা বা অভিজাতরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেও পার পেয়ে যেত, যেমনটা আজিজ কোকা করেছিলেন, এমনকি হত্যাও- যেটা জাহাঙ্গীর করেছিলেন। দরবার চলাকালীন মহিলারা তাদের মতামত জানাতে পারতেন জালির আড়াল থেকে, আর যেকোনো সময় আচমকা সফরে বেরিয়ে যেতেন পুত্রের কাছে বা কোনো সুফি সাধকের আস্তানায়, আবুল ফজলের মতে যা ‘হঠাৎ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করত “সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার” মাঝে।’
এভাবেই হারেম প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হতে থাকে, বিভিন্ন শ্রেণির মহিলাদের কল্যাণে। সময়ের আবর্তে বয়স্ক তিমুরীয় তুর্কিভাষী নারীরা মৃত্যু পর্যন্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন। তাদের জায়গায় এলো রাজপুত আর পারস্যের রমণীরা, যখন আর কোনো চাগাতাই তুর্কি অবশিষ্ট ছিল না, তখন হারেম আরও একবার বদলে যায়। সে নিয়ে পরে না হয় একসময় আলোচনা হবে। তবে ইউরোপীয়দের ধারণার হারেম ভারতে কোনোকালেই বিরাজ করেনি।
 আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top