skip to Main Content

ফিচার I প্রাণঘাতী কীটনাশক

ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের কবল থেকে শস্য রক্ষায় ব্যবহৃত এই উপাদান মানবদেহ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। তবে তা সহনীয় করে তুলতে জানা চাই প্রয়োগের সঠিক মাত্রা। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

পোকামাকড় থেকে ফসল সুরক্ষিত রাখতে একধরনের বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহৃত হয়, যাকে বলে কীটনাশক। এই রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে তৈরি দ্রব্য মূলত পোকামাকড় নির্মূলে ব্যবহৃত হয়। এর প্রয়োগে পোকামাকড়ের ডিম, লার্ভার বিনাশ ঘটে। কৃষিক্ষেত্রসহ চিকিৎসা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং গৃহস্থালির নানা কাজে এটির ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু ফসলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে প্রাণিকুল, এমনকি জনস্বাস্থ্য। ফলে এমন প্রশ্ন খুব যৌক্তিক হয়ে দাঁড়ায়, ফসল সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক, মানুষ ও অন্যান্য জীবের প্রাণনাশক নয় তো?
বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দিলে এই প্রশ্নের ভিতটা আরেকটু মজবুত হবে। তারা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানাচ্ছেন, খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে ব্রঙ্কাইটিসসহ শ্বাসযন্ত্রে নানা জটিল রোগ। অনেকেই এর ফলে কিডনি ও লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি এর প্রভাবে গর্ভবতী মায়েরা ত্রুটিযুক্ত বা অসুস্থ সন্তান জন্ম দেন।
আমাদের দৈনন্দিন খাবারের শতকরা ৯৮ ভাগ শাকসবজিতেই কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এর ক্ষতিকর প্রভাব রান্নার সময় তাপেও নষ্ট হয় না, বরং কোনো কোনোটির বিষক্রিয়ার কার্যকারিতা বেড়ে যায়। যা মানবদেহে ধীরগতিতে ক্রিয়া করে, ফলে তাৎক্ষণিকভাবে বোঝার উপায় থাকে না কেউ আক্রান্ত হচ্ছে কি না। শাকসবজিতে রোগ ও পোকা দমনের জন্য বালাইনাশক ব্যবহার করায় সেসবের অধিকাংশ বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। এসব বিষাক্ত পদার্থ খাদ্যশস্যে প্রয়োগের পর ১৫-২০ দিন কার্যকর থাকে। আর সেসবই নিয়মিত খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ।
শুধু মানবদেহেই নয়, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর। মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ফসলের মাঠ গড়িয়ে নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ে গিয়ে মাছের মৃত্যুর কারণ ঘটাচ্ছে। তা ছাড়া এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে অনেক পাখি ও প্রাণীও হারিয়ে যাচ্ছে। এর ক্ষতিকর আরেকটি প্রভাব পড়ছে ভবিষ্যতের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে। কমে যাচ্ছে জমির উর্বরতা শক্তি। মরে যাচ্ছে ফসলের জন্য উপকারী পোকা।
বিশ শতকে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কীটনাশকের ব্যবহারকে উপজীব্য করে এর বিস্তৃতি ঘটেছে। শাকসবজির সঙ্গে কীটনাশক মিশ্রিত খাবার খেয়ে অনেক সময় তা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের রাসায়নিকই পরবর্তীকালে জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে বলে ধারণা করা হয়। অনেক ধরনের কীটনাশক মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। কিছু কিছু রাসায়নিক খাদ্যশৃঙ্খলেও প্রভাব বিস্তার করছে।
নিকোটিন, নিমের নির্যাসকৃত প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন কীটনাশক পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বৈশ্বিকভাবে অদ্যাবধি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভেষজবিহীন কীটনাশক ধাতব পদার্থ এবং আর্সেনেট, কপার ও ফ্লোরিন যৌগের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়, যাতে সালফারের ব্যবহার প্রায়শই হয়ে থাকে।
প্রতিটি প্রাণীর ডিএনএ/আরএনএ রয়েছে। কীটনাশক কোষের মিউটেশন ঘটাতে পারে, পুষ্টিমান কমিয়ে দেয়। এই কৃত্রিম উপাদান ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে ফসল রক্ষা করার কথা। কিন্তু যে মাত্রায় তা ব্যবহৃত হলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে পারে, অজ্ঞতা-অদক্ষতা এবং শিক্ষার অভাবে কৃষকেরা সেটির সঠিক প্রয়োগ করছেন না। ফলে খাদ্যের গুণগত মান ও পুষ্টি থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এ খাবারের মধ্যে যদি জিনগত কোনো পরিবর্তন হয়, তার ভবিষ্যৎ প্রভাব মানবদেহে চলে আসবে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে কীটনাশকের ভূমিকা রয়েছে।
কোনো খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহারের পর সেটা দীর্ঘ সময়ের জন্য খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। কিন্তু অনেক সময় কৃষক সকালে এসব রাসায়নিক পণ্যে ব্যবহার করে বিকেলেই বাজারে নিয়ে আসছেন, ফলে কীটনাশকের প্রাণকোষ সুরক্ষিত থাকছে। সাধারণত রাসায়নিকের গুণাগুণ নষ্ট করার পরই পণ্য বাজারে আনতে হয়। কৃষকদের এ বিষয়ে যথাযথ ধারণা ও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। ফলে সুরক্ষিত প্রাণকোষসহ রাসায়নিকযুক্ত পণ্য বাজার থেকে কিনে ভোক্তারা সরাসরি খেয়ে ফেলছে। এতে কীটনাশকবাহিত ঝুঁকি কিন্তু দিন দিন বাড়ছে।
এসব রাসায়নিক মূল ও পাতার সাহায্যে উদ্ভিদের ভেতর প্রবেশ করে, এভাবে খাদ্যদ্রব্য বিষাক্ত হয়। ফলে এসব শাকসবজি খেলে মানুষের লিভার আক্রান্ত হওয়াসহ স্নায়ুরোগ, রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, ক্যানসার, গর্ভপাত, পঙ্গুত্বের মতো সমস্যায় ভোগে। কীটনাশক জমিতে দেওয়ার কারণে শস্যের উপকারী পোকামাকড়ও মারা যাচ্ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক জলজ প্রাণী। অন্যদিকে এর ব্যবহারে বহুগুণ বেড়েছে ক্ষতিকর পোকামাকড়।
কীটনাশকের প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে দুর্বল এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস করে। এমনকি মায়ের দুধের মধ্যে এর উপস্থিতি দেখা যায়। ভারত থেকে নিষিদ্ধ হিলডন, ডিডিটি, ব্লিচিং পাউডারসহ বহুবিধ বিষাক্ত কীটনাশক বাংলাদেশে অনবরত প্রবেশ করছে। ডিডিটি জৈব ক্লোরিন জাতীয় কীটনাশক। দেখতে সাদা বর্ণের হলেও এটি দ্বারা অ্যান্টার্কটিকার সিল মাছও আক্রান্ত। শুঁটকি সংরক্ষণে এটি বহুল ব্যবহৃত। উপকূলীয় এলাকাতে লোকজন শুঁটকি বেশি খায়। ফলে তাদের শরীরে কীটনাশকের উপস্থিতির মাত্রা অনেক।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার এলাকার অধিবাসীদের স্নায়বিক বৈকল্যে ভোগার হার ২৫%। ডিডিটি নিজে নিজে বা প্রাকৃতিক কারণে কিংবা ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সহজে ভেঙে যায় না। ফলে এগুলো পরিবেশে থেকে যায়। এটি সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের বেশি। তবু ক্রমাগত এগুলোর ঘনত্ব বাড়ার ফলে মানবদেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। আলু আবাদের সময় ডিডিটি ব্যবহার করা হয়। এটির প্রভাবে অনেক জলজ প্রাণীর শূককীট ধ্বংস হয়ে যায়। ফাইটোপ্ল্যাংকটনের সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা কমে যায়, এনজাইম প্রক্রিয়া ধীর হয় বলে এর প্রভাবে পাখির ডিম্বস্ফুরণ দেরিতে ঘটে। ডিমের ক্যালসিয়াম স্তর পাতলা হতে থাকে এবং একসময় ভ্রূণের বিকাশ হয় না। এভাবে বহু পাখির বিলুপ্তি ঘটছে। এসব কীটনাশকের প্রভাবে প্রতিদিন ৪০ থেকে ১৪০টি প্রজাতি জীবের চিরবিলুপ্তি হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ প্রয়োগের ফলে বায়ুদূষণও ঘটে।
কৃষিকাজে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ, ছত্রাক ও আগাছা দমনের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত ওষুধ ছিটানো হয়। এসবের মধ্যে ডিডিটি ছাড়াও রয়েছে হেপটাক্লোর, অ্যালডিন, ক্লোরোডিন, ফুরাডন প্রভৃতি। ক্ষেত-খামারে এগুলো ব্যবহার আজকাল মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তা ছাড়া কীটনাশক বৃষ্টির পানির সঙ্গে ধুয়ে নদ-নদীতে যাচ্ছে, ফলে পানি দূষিত হচ্ছে। মাছ উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
এক জরিপে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৪৫ হাজার ১৭২ টন রাসায়নিক দ্রব্য ফসলে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত ১০ বছরে এর পরিমাণ বেড়েছে চার গুণ। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকলেন, সানটাপ, পুরাটাপ, সায়পারম্যাথিন নামের কীটনাশকগুলো বাংলাদেশের বাজারে বিক্রির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত। এগুলো ধানের ফসলে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ এসব মাত্রাতিরিক্ত বিষযুক্ত কীটনাশক কৃষকেরা সবজিক্ষেতে ব্যবহার করছে। এসব রাসায়নিক প্রয়োগের পর সবজি ২১ দিনের মধ্যে রান্না করে খেলে শরীরে নানা রোগবালাই দেখা দেয় বলে জানা যায়। এ ছাড়া সবজিতে ব্যবহারের অনুমোদনপ্রাপ্ত কীটনাশক প্রয়োগের পরও কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে ক্ষেত থেকে তুলে তা বিক্রি না করা এবং খাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকযুক্ত শাকসবজি শিশুর পেটে গেলে ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যু হতে পারে। গ্রীষ্মকালে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় আম-লিচু খেয়ে শিশুদের অসুস্থ হওয়ার কথা জানা যায়। এগুলো ক্ষতিকর কীটনাশকের প্রভাব।
সাধারণত আমাদের দেশে শাকসবজি পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া হয়। এতে ক্ষতির মাত্রা কিছুটা হ্রাস পেলেও এসব কীটনাশক স্লো-পয়জন হিসেবে শরীরে কাজ করে।
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top