skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I ভিয়েতনামের মৈনাখে

সেখানে বৃষ্টি ঢেকে ফেলে পাহাড়ের সবুজ। রয়েছে আদিগন্ত ধানক্ষেত আর আদিবাসীদের গ্রাম। সে এক শান্ত, সুন্দর নৈসর্গিক জনপদের গল্প। লিখেছেন ফাতিমা জাহান

দূরের সবুজ পাহাড় এখন আবছা হয়ে আসছে, কুয়াশা চারদিকে, সারা দিনই এমন ছিল। পাহাড়ি এলাকা বলে মেঘের মান-অভিমান একটু বাড়াবাড়ি রকমের। এসব পথঘাট ঢেকে দেয় তো এই অনাকাক্সিক্ষত বৃষ্টিতে চুপচুপে ভিজিয়ে দেয়। ঠান্ডাও বেশ। দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে একেবারে। এই জায়গার নাম ‘ফান সি পান’ বা ফানসিপান। ভিয়েতনামের অন্যান্য শহরে এখন রোদগলা গরম। এই গ্রামের কথা শুনে তাই ছুটে এসেছি একটু পাহাড়ের ছায়া পাওয়ার জন্য। গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়ে বাইরে থেকে ঘরে এসে যদি এক গ্লাস হিম শীতল পানি পাওয়া যায়, তাহলে ভিয়েতনামের সমস্ত গরম আবহাওয়া ঠেলে বহু দূরে একদম চুপচাপ একটা জায়গা ঠিকই আছে সেই জলতেষ্টা মেটানোর জন্য। হ্যানয় শহর থেকে সাড়ে তিন শ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিলাম বাসে করে। যেখানে নামলাম সে জায়গার নাম ‘সা পা’। ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু আমি এখানে থাকতে আসিনি। এই এলাকা থেকে ট্রেক করে যেতে হবে আরও উনিশ কিলোমিটার, তাহলেই দেখা পাব ফানসিপান গ্রামের। কে জানে কেমন দেখতে সে গ্রাম! যে পথ দিয়ে ট্রেক করতে হবে, তার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অবশ্য বিভিন্ন দেশে বৈরী আবহাওয়া আর পরিবেশে ট্রেক করে এটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে যে কোথাও আছে ভয়ংকর ফাঁদ, কোথাও-বা কোমল বনভূমি। এখানে নিয়ম অনুযায়ী গাইড সঙ্গে নিতে হয়। হ্যানয় থেকে রওনা হবার সময় সব ব্যবস্থা করে এসেছি। বাস থেকে নেমে হোটেল নেবার কথা। যেখানে থাকব ঠিক করেছি, সেখানে ফানসিপানের স্থানীয় আদিবাসী একটি মেয়ে, তাদের নিজস্ব পোশাকে হাজির। বলল, ‘স্নান, নাশতা সেরে নাও, আমরা এখনই রওনা হব।’
এসেছি রাতের বাসে। খুব ভোরে, বলতে গেলে অন্ধকার থাকতেই নেমেছি এখানে। একটু না ঘুমালে কীভাবে চলবে! আর ট্রেকিংয়ের জন্য আমি একা নই, সঙ্গে কম করে হলেও কুড়িজন ভ্রমণার্থী অপেক্ষা করছে। প্রায় সবাই ইউরোপীয় আর কয়েকজন আমার সঙ্গে একই বাসে করে এসেছে। গতকালও সারা দিন টইটই করে ঘুরেছি, রাতে না ঘুমিয়ে পুরোটা পথ আশপাশের শোভা দেখতে দেখতে এসেছি। ভ্রমণে তো এমনিই রাতের পর রাত জেগে, ট্রেক করে বা যানবাহনে কাটাতে হয়। তবু গরমের দেশ থেকে এসে শীতের পেলব পরশ পেলে চোখ এমনিতেই আবেশে মুদে আসে। কিন্তু হাতে সময় নেই। আদিবাসী মেয়েটির নাম সাও। আজকের জন্য তিনিই আমার ভ্রমণের সঙ্গী। তাই মাথা নেড়ে বললাম, ‘জো হুকুম জাহাঁপনা।’
ঘণ্টা দেড়েক পরই সাও আমাদের ছোট দলটি নিয়ে যাত্রা শুরু করল।
বাইরে মেঘ আর বৃষ্টিতে সা পা শহর পুরো অদৃশ্য হয়ে আছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বিনা দ্বিধায় বলতে পারব, ‘সা পা একটি ভোজবাজির শহর; কারণ, এখানে কিচ্ছু দেখতে পাওয়া যায় না।’ হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য মফস্বল শহরের মতো সরু পিচঢালা রাস্তার দুপাশে অনেকগুলো দোকান দেখলাম। আস্তে আস্তে দোকানের পর্ব শেষ হলো। পথের দুপাশে এখন সারি সারি কাঠের বাড়িঘর, লোকালয়। এভাবেই চললাম প্রায় এক ঘণ্টা। মেঘ বেশ ঘটা করে জাঁকিয়ে বসেছে, বৃষ্টি বর্ষাতির আবরণ মানছে না। ভেদ করে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দলের সবাইকে। কুড়িজনের দলও এখন দু-তিনজন করে ভাগ হয়ে গেছে।
সিঙ্গাপুর থেকে আসা এক দম্পতির সঙ্গে চলছি। গাইডের সঙ্গেও তার গাঁয়ের কয়েকজন আদিবাসী ভিড়েছে আমাদের পথ চিনিয়ে নিতে। সবে মেঠো পথ শুরু হয়েছে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে। পিচ্ছিল তো বটেই, তার ওপর মেঘমেদুর বরষা যে এত কাছাকাছি এসে জড়িয়ে ধরবে, তা কে জানত, সামনের পাহাড় প্রায় অদৃশ্য ঝমঝম বৃষ্টির তালে তালে। ঠিক যেন আমাদের আষাঢ় মাস আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শীতকালীন আমেজ। বর্ষাতি, গামবুট পরে ট্রেক করতে হবে—আগে থেকেই বলা ছিল। দলের সবাই তাই মেনে চলছে। চারদিকে এখন সাদাকালো ছবির মতো শুধুই ধোঁয়াশা। সবুজ বনানী আর সামনের পর্দা সরাচ্ছে না, মাঝে মেঘের আহ্লাদিপনা।
মেঘ আমার প্রিয়। তার নিজস্ব সব নাটকীয় মুহূর্তও ভালো লাগে, একেক সময় একেক রূপ ঝরে ঝরে পড়ে তার।
মেঘও বুঝি এবার আমার মনের কথা শুনে ছুট লাগাল দুষ্টু বালিকার মতো। কয়েক গজ পরেই পরিষ্কার চারদিক। বৃষ্টি উধাও। সামনে তখন সবুজ পাহাড়ের সারি। সেখানে ভরা জোয়ার তুলেছে ধানক্ষেত। পাহাড় কেটে কেটে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয়েছে রাইস টেরেস। সেখানে ঢেউ খেলে যাচ্ছে ফিকে সোনালি আর সবুজ রঙের মখমলের বিছানা। বাতাসের তোড়ে ডান দিকে হেলে বলছে এক রূপকথা আর বাঁ দিকে হেলে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে গাইছে গান।
এ রকম জায়গায় সারা বছর বসে থাকা যায়। দলের সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত আর আমি পাহাড় বেয়ে উধাও হতে চাইলাম ধানক্ষেতের মাঝখানে। কিন্তু এই রাইস টেরেসের একেকটা ধাপ আমার গলাসমান উঁচু। নিশ্চয়ই মই লাগে এক টেরেস থেকে অন্য টেরেসে লাফ দিয়ে চড়তে। ভেবেছিলাম আমার নিরুদ্দেশের খবর কেউ জানবে না। কিন্তু সাও খপ করে ধরে ফেলল। কী সুন্দর ইংরেজি বলে মেয়েটা! বয়স হবে ২৪-২৫। ইংরেজি শিখেছে ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে, কখনো স্কুলে যায়নি ও। তার নাকি তিনটে ছানাপোনাও আছে। পরনে এখানকার ট্র্যাডিশনাল পোশাক, মন ভালো করা ভীষণ রঙিন জ্যাকেট আর স্কার্ট। মাথায় তার চেয়েও রঙিন স্কার্ফ। ঠান্ডার কারণে জ্যাকেটের নিচেও কয়েকটা জামা পরতে হয়। সাও আর তার বর মিলে সংসার চালায়। সব কাজে দুজনকেই হাত লাগাতে হয়। সাওয়ের বর এখন বাচ্চা সামলাচ্ছে। ওরা থাকে ফানসিপানে।
সাও এখানকার মং আদিবাসী গোষ্ঠীর। এ ছাড়া দাও, তে, গিয়াই গোষ্ঠীর বসবাস এই ছোট্ট জনপদে। একসময় এ এলাকা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। উনিশ শতকের শেষ দিকে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী এ জায়গা আবিষ্কার করলে এখানকার কয়েকটি গ্রামের পরিচয় হয় বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে। তবু আশপাশের বনভূমি আর পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে, গ্রামগুলোয় উনিশ শতকের ছোঁয়া এখনো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। তাই থাকুক, এমনই অকৃত্রিম, অকৃপণ এই অবারিত সবুজ ঝরনাধারার মতো প্রকৃতি।
আবার শুরু হলো সারি বেঁধে পথচলা, সামনের রাস্তা সরু আর পিচ্ছিল হতে চলেছে। লাল, কর্দমাক্ত মাটি আর সরু পাহাড়ি পথ কোথাও উঁচু, কোথাও ঢালু। এর মধ্যেই দুজন পা পিছলে পড়ে গেল। যদিও সামনে খাদ নেই। এখন বুঝলাম, কেন গায়ের ৫-৬টি মেয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলছে। একেকজন বিশাল দেহী আছাড় খাওয়া ইউরোপীয় নাগরিককে তুলতে দুজন তো লাগেই। আর কয়েকজন আদিবাসীর হাত ধরে ধরে পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিচ্ছে। এই দেখে বাদলের মজা করার গতিও হলো দ্রুততম, নামিয়ে দিল বরষা। এরই মাঝে পথচলা।
আমি তখন স্প্যানিশ একটি মেয়ের হাত ধরে পথ পাড়ি দিচ্ছি। বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটি। এমন ভাব দেখাচ্ছি যেন কিছুই হয়নি, যেন দেশ-বিদেশে পাহাড়ে ট্রেক করাই আমার একমাত্র কাজ। অবশ্য ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে না হন্টনের জন্য। আশপাশে ঘন কুয়াশা, আরও সামনে ঘন জঙ্গল। গাছগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে পরিচিত হলো বাঁশঝাড়। সফরসঙ্গীদের কেউই বাঙালি বা ভারতীয় না হওয়ায় বাঁশঝাড়-সম্পর্কিত কোনো ভূতের গল্প বলে ভয় দেখানো গেল না কাউকেই।
এ ট্রেইল শেষ হবে একটি গ্রামের কাছাকাছি জায়গায়। সে অবধি হাঁটার নামই জীবন; শুধু হাঁটা নয়, খাড়াই-উতরাই পার হওয়া। এবং হিরো হবার বাসনায় অন্যদের হাত ধরে ধরে মহা উদ্যমে পার করিয়ে দেওয়া।
এমনই একটি ঢালু জায়গায় দলের একেবারে সামনে চলে গেছি। এ রকম ঢালু গভীর পাহাড়ি পথ বহু পার হয়েছি, এ আর এমন কী। যেই না বললাম, অমনি তাল সামলাতে না পেরে নিজেই ঢালে পা পিছলে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। গেল আমার সব বাহাদুরি ভেস্তে। দুজন এখন দেখি আমারই দুহাত ধরে টেনে তুলছে।
বাকি পথ আর বাহাদুরিতে মনোযোগ দিইনি। সেই তো ‘ভরা বাদর, নাহি মন্থর, বৃথাই বাহাদুরি মোর।’
পায়ে বেশ চোট লেগেছে, কিন্তু পথচলা থামাতে পারছি না; আমি থামলে দলও আটকে থাকবে এক জায়গায়। এরই মাঝে জঙ্গলের শোভা দেখা, যদিও দুপাশে পাহাড় আর মেঘ ছাড়া কিছুই নেই। এত দীর্ঘ সময় মেঘের আড়ালে থাকতে থাকতে মনে হলো, আমি আকাশের কোনো এক ঘাটের বন্দরে নোঙর ফেলেছি। দুহাত দিয়ে মেঘ সরিয়ে, গলাসমান মেঘ পার হতে হতে এগিয়ে চলেছি এই চরাচর।
আরও ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আমাদের বিরতি মিলল একটা গ্রামে, যেখানে বাঁশের ছাউনি আর বাঁশের খুঁটি গেড়ে তৈরি হয়েছে আমাদের মতো পথচারীদের জন্য রেস্তোরাঁ। এখানেই দুপুরের খাওয়া সারতে হবে। এখানেও মেঘে ডুবে যাচ্ছে টেবিল চেয়ার। ছোট ছোট দ্বীপের মতো মেঘের মাঝে উঁকি দিচ্ছে রেস্তোরাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটার ছেলেমেয়েরা। ভিয়েতনামিজ খাবার খুব পছন্দ করি। অল্প তেলে প্রায় মসলাহীন, বেশ স্বাস্থ্যকর খাবার রান্না করে এরা। আর খেতেও অসাধারণ। এখন অবধি যা খেয়েছি সবই সুস্বাদু। সঙ্গে ভাত তো থাকেই। ভিয়েতনামকে বলা হয় ‘রাইস বোল অব ওয়ার্ল্ড’।
ভাতের সঙ্গে কয়েক রকমের সবজি, চিকেন, টফু ইত্যাদি খেয়ে আমাদের দল চলল আদিবাসীদের গ্রামের দিকে। রাতে সেখানেই আদিবাসী ঘরে থাকার ব্যবস্থা।
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top