skip to Main Content

ফিচার I কুড়িয়ে পাওয়া পুষ্টি

শাকের সঙ্গে বাঙালির রসনার যোগ বহু আগে থেকেই। এগুলোর বেশির ভাগই একসময় ছিল চাষের বাইরে

বাড়ির আশপাশ থেকে খাবার সংগ্রহ মানুষের আদি স্বভাব। কিন্তু কৃষি আবিষ্কারের পর আবাদি ও অনাবাদি খাদ্য নামে তার দুটি ভাগ হয়ে যায়। যার রেশ রয়ে গেছে আজও। বিশেষ করে শাকসবজিতে। এমন অনেক লতাগুল্ম আছে, যেগুলো অযত্নেই বেড়ে ওঠে—বাড়ির পাশে, মাঠেঘাটে, পুকুরপাড়ে কিংবা জমির আলে। সেসব শাকের কোনো মালিকানা থাকে না। ফলে তা তুলে আনার অধিকার সবার। এসবের পুষ্টিমানও প্রচুর। আবার মানুষ কখনো এগুলোর জিনোটাইপ পরিবর্তন করতে চায়নি বলে এসব শাকসবজির স্বাদ একেবারেই আদি। ভেজালমুক্ত ও তাজা। যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত থেকে গেছে এগুলোর খাদ্যমান।
শহরে বা উন্নয়নশীল গঞ্জে না হলেও এখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এসব শাকের হদিস মেলে। সর্বত্রই ছড়িয়ে থাকে পুষ্টিকর নানা রকম গুল্ম। বাড়ি থেকে দুই কদম এগোলেই মেলে ঢেঁকিশাক, মোরগশাক, গিমাশাক, পিপুল, কানাইশাক, রসুনশাক, কাঁটানটে, খ্যাটখ্যাটি, মরিচপাতা ইত্যাদি। আবার একটু উঁচু জায়গায় গেলে পাওয়া যায় নটেশাক, যারকোন, গন্ধভাদালী, চিরকুটি। স্যাঁতসেঁতে জমিতে গজিয়ে ওঠে সেঞ্চিশাক, নিলিচি, মুনসিশাক, বন কচু, চিনিগুড়ি। ভেজা মাটিতে হয় নুনিয়াশাক, আমরুল, বনপাট। শুকনা জমিতে কিছুটা বৃষ্টির পানি পেলে জন্মায় গিননারিস, চুকাকলা, বনঝুড়ি। কস্তরী, থানকুনি, হুটকা এসব শাক হয় খানিকটা ছায়াযুক্ত স্থানে। আবাদি জমিতে আগাছা হিসেবে গজায় নুন খুরিয়া, দুধলী, দন্ডকলস, শুশনীশাক, শিয়ালমুতি, থ্যানথ্যানে ও হুটকাশাক। ঝোপঝাড়ে জন্মে তেলাকুচা, বিষ কচু ইত্যাদি। ডোবার আশপাশে মেলে হেলেঞ্চা শাক, বন কচু, কলমি, কাটা কচু, হরিশাক, পানিভাংগা ও হাগড়াশাক। শুধু সমতলেই নয়, পাহাড়িদের খাদ্যতালিকায় কুড়িয়ে পাওয়া শাকের উপস্থিতি বিস্তর। জুম চাষ থেকে পাওয়া ফসলের বাইরেও তারা সংগ্রহ করে বেশ কিছু অনাবাদি উদ্ভিজ্জ। গ্রামাঞ্চলের প্রায় সবখানেই মেলে এসব লতাগুল্ম। গবেষণা অনুযায়ী এসব শাকের সংখ্যা ষাট-সত্তর।
এসব শাক যে শুধু পেট ভরায় এবং পুষ্টি দেয়, এমন নয়। এগুলো গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবনের খাদ্যসংস্কৃতিও তুলে ধরে। কথিত আছে, একটা সময় গ্রামের লোকেদের কেবল কেরোসিন ও লবণ কিনতে হতো। বাকি সবই তারা সংগ্রহ করত আবাদি ও অনাবাদি উৎস থেকে। খাল-বিল হতে মাছ সংগ্রহ করে আমিষের প্রয়োজন মেটাত তারা। কিন্তু মাছ রান্নার জন্য অনুষঙ্গ-পদ চাই। তখন হয়তো দল বেঁধে বাড়ি থেকে খানিক দূরের কোনো জমিতে গিয়ে চিমটি কেটে কেটে তুলে আনা হতো উপযোগী শাক। মাছ যোগে তা রান্না করে প্রতিবেশীকে বাটি ভরে দিয়ে আসার চল ছিল। তারপর কলতলায় বাসন মাজতে মাজতে চলত সেই তরকারির স্বাদের আলোচনা। অনেকের ধারণা, অনাবাদি এসব শাক আকালের খাবার। দরিদ্ররা অভাবের সময় এগুলো খায়। আসলে তা নয়। অনাবাদি এসব লতাগুল্ম খাওয়াটা বাঙালির প্রাচীন অভ্যাসের মধ্যেই পড়ে।
নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বইয়ে আছে, প্রাচীনবঙ্গের গ্রামের দরিদ্র বাঙালির অন্যতম খাবার ছিল শাকসবজি। ষোড়শ শতাব্দীর চৈতন্যকাব্যগুলোতেও এর উল্লেখ রয়েছে। দ্রৌপদীর থালার শাকান্ন খেয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন কৃষ্ণ। সন্তুষ্ট হয়েছিলেন দুর্বাসাও। মহাভারতের যুগ থেকেই বাংলা খাবারে সগৌরবে উপস্থিত থেকেছে শাক। যদিও সংস্কৃত সাহিত্যে এসব লতাগুল্মকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’-এ এসব অনাবাদি লতাগুল্মের গুরুত্ব মেলে। বাংলা রচনার এই আদি নিদর্শনে রয়েছে শাকের কথা। বলা হয়েছে, ‘ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সংযুক্তা। মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা পুনবন্তা।’ যার মানে, কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মাছ আর নলচেশাক যে স্ত্রী পরিবেশন করেন, তার স্বামী পুণ্যবান।
অনাবাদি শাকসবজির প্রতুলতা আগের মতো নেই। তা ছাড়া এখন এগুলো আবাদ করা হয়। ফলে সার ও রাসায়নিকের মিশ্রণে বদলে গেছে সেগুলোর স্বাদ। শহরে বা গঞ্জে সেসব আঁটি বেঁধে বিক্রি করা হয় চড়া দামে। মানুষের আন্তরিকতাও কমে গেছে বলে আফসোস করেন অনেকেই। আগে যেমন একজনের জমি বা মাচা থেকে অভাবী কেউ শাক তুলে নিলে ভূপতি কোনো আপত্তি তুলতেন না, সেই দিন আর নেই। বেশির ভাগই ছোটে মুনাফার পেছনে। তবু সরকারি খাসজমিতে মেলে কিছু কিছু অনাবাদি শাক। গ্রামের লোক হয়তো সেগুলো তুলে খায়। শহরের মানুষ কিনে খায়। তা ছাড়া পুরো গ্রাম চষেও আগের মতো ষাট-সত্তর পদের শাক মেলে না। হাতে গোনা দশ-পনেরোটিই টিকে আছে হাতের নাগালে। কয়েকটির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বলা যাক।
গিমাশাক: ডায়াবেটিসে উপকারী। তা ছাড়া কোষ্ঠকাঠিন্য, অন্ত্র ও রক্তপ্রবাহে সমস্যা, অ্যাজমা, ফুসফুসসংক্রান্ত রোগ সারায়। এই শাক খেলে অ্যাসিডিটি কমে। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে খাওয়া যেতে পারে গিমা। এতে রয়েছে ফ্যাট, শর্করা, খাদ্য আঁশ ও প্রোটিন, ভিটামিন- সি, ক্যারোটিনয়েডস, ভিটামিন বি১, বি২, ই, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ।
ঢেঁকিশাক: ক্যানসার, লিভার ইনফেকশন এবং ছোঁয়াচে ঠান্ডা কাশি থেকে রক্ষা করে। এটি শ্বাসতন্ত্রকে সতেজ রাখে। কাশি সারায়। এ শাক জন্ডিসের ওষুধ। জ্বর ভালো করতে খুব ফলপ্রসূ। উচ্চ রক্তচাপ কমায়। ঢেঁকিশাকে রয়েছে শর্করা, ফ্যাট, প্রোটিন, ভিটামিন বি১, বি২, বি, বি৬, ভিটামিন সি, এ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, লৌহ, জিংক, সেলেনিয়াম, তামা ও ম্যাঙ্গানিজ।
তেলাকুচা: পেটের গোলমাল কমায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটি কিডনিতে পাথর হতে বাধা দেয়। কুষ্ঠ, জ্বর, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস এবং জন্ডিস রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এই শাকে প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন বি২, বি১, আঁশ ও ক্যালসিয়াম রয়েছে।
উষনিশাক: শরীরে বিষব্যথা দূর করে। অ্যাজমা ও অ্যালার্জি সারায়। এই শাক কার্ডিওভাসকুলার রোগ, স্ট্রোক এমনকি ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম। তা ছাড়া রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। উষনিশাকে প্রচুর পটাশিয়াম আছে। এতে বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যসিডের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও সোডিয়াম থাকে।
হেলেঞ্চা: রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। ব্রঙ্কাইটিস রোগেও হেলেঞ্চা উপকারী। এটি ক্যানসার প্রতিরোধী। নিয়মিত খেলে ব্লাড সুগারও কমে। হেলেঞ্চা শাকে আছে প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা, ভিটামিন এ, সি, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top