skip to Main Content

ফিচার I বীজের জাদু

ফলের ভেতরের এই অংশ ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর উপাদানে ভরা। শরীরের জন্য যেমন, তেমনি রূপচর্চায়ও এগুলো বিশেষভাবে কাজে লাগে। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে নানা রকমের ফলের সমারোহ ঘটে। গ্রীষ্মকালে এ দেশে তা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, সেগুলো পুষ্টিগুণে ভরপুর। অনেকেরই ধারণা, ফলের বীজ খেয়ে ফেললে পেটের রোগ হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। আঁটি গিললে পেটে গাছ হওয়ার গল্প শৈশবে শোনেনি, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। এ কারণে যেকোনো ফল খাওয়ার সময় সবাই খুব কায়দা করে তা মুখে দেয়, অথবা বীজগুলোকে আলাদা করে বাইরে ছুড়ে ফেলে। কিন্তু শুধু ফলেই নয়, এর বীজেও রয়েছে বিভিন্ন গুণাগুণ এবং উপকারিতা।
কাঁঠাল: প্রোটিন, ভিটামিন ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ এই ফল গরমে শরীর সুস্থ রাখার পক্ষে একেবারে আদর্শ। তবে শুধু ফলেই নয়, গুণ রয়েছে এর বীজেও।
বলিরেখা থেকে ত্বককে নিষ্কৃতি দিতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে কাঁঠালের বীজ। একটি আঁটি কোল্ড ক্রিমের সঙ্গে পিষে পেস্ট তৈরি করতে হবে। তারপর সেটি নিয়মিত ত্বকে মাখলে দেখা যাবে, দাগগুলো আর আগের মতো উঁকিঝুঁকি মারছে না। এ ছাড়া কাঁঠালের বীজ ত্বককে করে তুলবে সজীব ও তরতাজা। দু-একটি আঁটি সামান্য দুধ ও মধুতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে, সেটা দিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে। সেটি সারা মুখে লাগিয়ে শুকোতে হয়। তারপর উষ্ণ গরম জলে মুখটা ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যাবে দ্বিগুণ।
কাঁঠালের বীজে প্রচুর ভিটামিন এ থাকে। চোখের স্বাস্থ্যের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নাইট ব্লাইন্ডনেস কাটাতে সাহায্য করে। চুলের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে ভিটামিন এ। চুলের আগা ফেটে যাওয়া রোধ করে এটি।
প্রতিদিন খাবারের মেনুতে কাঁঠালের বীজ রাখলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়াবে। এতে আছে হিমোগ্লোবিনের একটি উপাদান। ফলে এটি খেলে অ্যানিমিয়া দূর হবে। আয়রন সুস্থ রাখবে মস্তিষ্ক ও হার্ট।
কাঁঠালের বীজ প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসে ঠাসা। সে জন্য এটি মানসিক চাপ কমাতে বিশেষ কার্যকর। ত্বকের নানা রোগ সারাতেও এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ত্বকে ময়শ্চারের মাত্রা বেশি রাখতে ও স্বাস্থ্যকর চুল পেতে নিয়মিত কাঁঠালের বীজ খাওয়া ভালো।
বদহজম রোধে কার্যকর কাঁঠালের বীজ। এটি রোদে শুকানোর পর পিষে পাউডারের মতো করতে হয়। বদহজমে সহজ হোম মেড রেমেডি হতে পারে এটি। শুধু বীজ খেলেও কমবে কনস্টিপেশনের সমস্যা। কারণ, এতে প্রচুর ফাইবার থাকে।
আম: এই ফল খেতে পছন্দ করে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। শুরু হয়েছে আমের মৌসুম। প্রতিটি বাড়িতে এ সময় ফলটি খাওয়ার ধুম। তবে এটি আমরা যতটা আয়েশ করে খাই, আঁটি ততটাই অবহেলায় ফেলে দিই। কিন্তু আমের আঁটি বা বীজও উপকারী। ফল খাওয়ার পর এই ফলের শুকনো আঁটি স্বাস্থ্যের কাজে আসবে।
আমের আঁটিতে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি অ্যাসিড, মিনারেল এবং ভিটামিন রয়েছে, যা চুলের জন্য উপকারী। এর বাইরের স্তর বাদ দিয়ে তারপর নারকেল, অলিভ বা সরষের তেলের মধ্যে আঁটি ডুবিয়ে কয়েক সপ্তাহের জন্য সূর্যের আলোতে রেখে দিতে হবে। তারপর নিয়ম করে প্রতিদিন চুলে মাখাতে হয়। চুল ঘন, কালো এবং উজ্জ্বল থাকবে। আমের আঁটির পাউডারের সঙ্গে টমেটো মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করা যায়। সেটি মুখে মাখতে হবে। ব্রণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ত্বকের মরা কোষ দূর করে এবং ব্ল্যাকহেডস সারিয়ে তুলতেও এটি কার্যকর। আমের বীজ বা আঁটি পিষে পাউডার বানিয়ে রেখে দিতে হবে। টুথপেস্টের বদলে এই পাউডারে দাঁত মাজা যেতে পারে। দাঁত ভালো থাকবে। ডায়রিয়া হলে মধুর সঙ্গে ১-২ গ্রাম পাউডার মিশিয়ে দিনে তিনবার করে খেলে উপকার পাওয়া যাবে। আমের আঁটির নির্যাস ওজন কমাতেও সাহায্য করে। এ ছাড়া কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণসহ রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে তুলতে এটি কার্যকর। প্রতিদিন নিয়ম মেনে আমের আঁটির নির্যাস খেলে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমে। মুক্তি পাওয়া যায় হাইপারটেনশন থেকেও।
ডালিম/আনার: ফলটির অনেক গুণ। হৃদ্্রোগ থেকে মুক্তি এবং দীর্ঘ যৌনজীবন লাভের ক্ষেত্রে আনারের জুড়ি নেই। বীজ থেকেও উপকার পাওয়া যায়। এই বীজে কোনো ক্যালরি নেই, আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। আরও আছে ভিটামিন সি, যা শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই বীজ শরীর সুস্থ রাখতে সহায়ক। ত্বক ও চুলের যত্নেও বেশ কার্যকর। আনারের বীজ গুঁড়া করে স্যালাডে ছড়িয়ে খাওয়া যায়, পানিতে গুলে খেলেও উপকার মেলে।
আঙুর: সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। আঙুরের বীজও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অনিদ্রা দূর করাসহ নানা উপকার পাওয়া যায় এতে।
তরমুজ: এই ফলের বীজে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সকালে উঠে খালি পেটে কয়েকটি রোস্ট করা তরমুজের বীজ খেলে কিছুদিনের মধ্যেই মুখের সব বলিরেখা দূর হবে। তরমুজ থেকে সরাসরি না খেয়ে, বিচিগুলো শুকিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেলে তা আরও বেশি পুষ্টির জোগান দেয়। খোসা ছাড়িয়ে নিলে এর থেকে অনেক ক্ষতিকর জিনিস বের হয়ে যায়। ভেতরের অংশে থাকে প্রোটিন। ১ আউন্স তরমুজ বীজ প্রায় ১০ গ্রাম প্রোটিনের জোগান দেয়। ফলটির মতোই এর বিচিরও হয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে প্রোটিন, ভিটামিন বি, ম্যাগনেশিয়াম আর উপকারী ফ্যাট থাকে, যা কোলেস্টেরল কমায়। হার্টের অসুখ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়ানো যায়। সরাসরিও এটি খাওয়া যেতে পারে। স্বাদ অনেকটা সূর্যমুখীর বিচির মতো। এ ছাড়া এই বীজ স্যালাডের সঙ্গে খেতেও সুস্বাদু।
কমলা: এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। কমলার বীজ শরীরকে বিষমুক্ত করতে সাহায্য করে। শীতের মৌসুমে প্রতিদিনের খাবারে অন্তত একটা কমলা থাকা উচিত। এর বীজ শক্তি বাড়াতে বিশেষ সহায়ক, তাই একে ‘পাওয়ার হাউস’ বলা হয়। এতে থাকা পালমিটিক, ওলেইক ও লিনোলেইক অ্যাসিড শক্তি বাড়াতে পারে। শরীরে বিভিন্ন কোষে শক্তি জমিয়ে অবসন্ন দূর করে। এই বীজে থাকা ভিটামিন বি৬ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর এবং শরীরের বাজে কোলেস্টেরল কমাতেও এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। এতে থাকা ভিটামিন সি ও ফাইটোকেমিক্যালস কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। কমলার বীজে থাকা ভিটামিন সি ও ডি-লিমোনেন ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। বিশেষ করে স্তন ক্যানসারে এটি কার্যকর।
এই বীজে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া এতে থাকা ভিটামিন ‘সি’ ত্বকের জন্য বিশেষ কার্যকর। কমলার বীজ শুকিয়ে গুঁড়া করে নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। তবে হজমসংক্রান্ত সমস্যা থাকলে এটি খাওয়া বারণ।
আতা: বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফল। ধারণা করা হয়, স্বাদের দিক থেকে কিছুটা নোনতা হওয়ায় এমন নামকরণ। আতা ফলের বীজগুলো ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে। এর ব্যবহারে ত্বকের গভীরে থাকা কোষ পুনরায় বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষতস্থানের ব্যথা তাৎক্ষণিকভাবে পালায়। এই বীজে রয়েছে এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রোপার্টি।
লটকন: শুধু বর্ষাকালে এই ফল বাজারে পাওয়া যায়। লটকনে এমন সব উপাদান রয়েছে, যাতে কোলন ক্যানসারসহ নানান জটিল ও কঠিন অসুখ সেরে ওঠে। তাই সুস্থ থাকতে প্রচুর লটকন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এর বীজও মানবদেহের জন্য উপকারী। এটি গনোরিয়া রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
লিচু: গ্রীষ্মের জনপ্রিয় ফল। এতে প্রচুর খাদ্যশক্তি ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এ ছাড়া কাশি, পেটব্যথা, টিউমার এবং গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি দমনে লিচু কার্যকর। এ ফলের বীজগুলোতে ব্যথা-উপশমের উপাদান রয়েছে। হজমজনিত ব্যাধিগুলোর জন্য দীর্ঘকাল ধরে লিচুর বীজ গুঁড়া করে ব্যবহার করা হয়। এটি অন্ত্রের কৃমি নাশেও ব্যবহৃত হয়। চর্মরোগের ব্যথা সারাতে লিচুর বীজ কাজে লাগে। বীজ শুকিয়ে পাউডার করে চা বানিয়ে খেলে গ্ল্যান্ড ফোলা ও এর ব্যথা সারে। এমনকি নিউরোলজিক পেইনও কমে। চীনারা অন্ডকোষের ব্যথায় লিচুর বীজ গুঁড়া করে এর চা পান করে। এই চা ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে রাখে।
তেঁতুল: টক খেতে যারা ভালোবাসেন, তাদের কাছে খুব পছন্দের ফল। তেঁতুলের বীজও খুব উপকারী। নানা রকম আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, দাঁত মজবুত করতে, হজমশক্তি বাড়াতে, বাতের ব্যথা নিরাময়ে এ বীজ খুবই কার্যকর। শুষ্ক চোখের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ড্রপ তৈরিতে তেঁতুলের বিচি কাজে লাগ। এ ছাড়া পাকস্থলীর গোলযোগ, লিভার এবং গলব্লাডারের সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এটি। গর্ভকালীন বমিভাব ও মাথাঘোরার সমস্যায় তেঁতুল বিচির শরবত উপকারী। বিচি গরম পানিতে ফুটিয়ে একধরনের আঠা তৈরি করা যায়, যা ছবি আঁকার কাজে ব্যবহৃত হয়।
আমলকী: মানুষের শরীরে সব উপকারী ভেষজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল এটি। প্রতিদিন একটি করে গোটা আমলকী খেলে ধীরে ধীরে উপকারিতা নজরে আসবে। অনেক রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। এই ফল অনেকভাবে খাওয়া যায়—টুকরো করে কেটে, গুঁড়া শুকিয়ে, অথবা কেটে লবণ মাখিয়ে তা শুকিয়ে বা সেদ্ধ করে। তবে কাঁচা আমলকী খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি। ফলটির বীজও ফেলনা নয়। আমলকীর বিচি নিশ্বাসের দুর্গন্ধ দূর করতে সহায়ক। এর গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে খেলে মুখের দুর্গন্ধ থেকে চটজলদি মুক্তি পাওয়া যায়। শরীরকে ঠান্ডা রাখতে আমলকীর বীজ খুব উপকারী। ফলটির মধ্যে যেসব উপাদান থাকে, তা অনায়াসে শরীর ঠান্ডা রাখে বলে পেটের সমস্যা এতে সম্পূর্ণ দূর হয়। আমলকী টক বলে এই ফলের বীজ স্বাদ গ্রহণ করার ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে।
অড়বরই: দেখতে প্রায় আমলকীর মতোই কিন্তু আকারে একটু ছোট, হলদে সবুজ। স্বাদও অন্য রকম। অনেকটা কামরাঙা বা বিলিম্বির মতো। এই ফলের নাম অড়বরই। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে একে নলতা, লেবইর, ফরফরি, নইল, নোয়েল, রয়েল, আলবরই ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। তবে অড়বরইয়ের পাশাপাশি রয়েল নামটাই বেশি প্রচলিত। এর বীজে রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ। লিভারের অসুখের টনিক বানানো হয় এর বীজ দিয়ে। পেটের অসুখ ও কৃমিনাশক হিসেবে এ ব্যবহার রয়েছে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top