skip to Main Content

ফিচার I গ্রিন মেশিন

টেকসই ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের জন্য। নতুন এক উদ্ভাবন। উদ্দেশ্য, ধরিত্রীকে বাসোপযোগী করে তোলা

পরিবেশদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের বিকল্প নেই। কয়েক বছর ধরে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি হাঁটছে সেই পথে। উদ্ভাবিত হচ্ছে নানা রকমের প্রযুক্তি, যা টেকসই পণ্য উৎপাদন করছে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে। বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ড এখন এই উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এদিক দিয়ে অবশ্য অন্য সব লেবেলের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপ।
গত বছরের নভেম্বরের শেষে মনকি—এইচঅ্যান্ডএমের মালিকানাধীন একটি উইমেন্স ওয়্যার ব্র্যান্ড, প্রথমবারের মতো কমার্শিয়াল প্রডাক্ট লঞ্চ করেছে, যা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রিসাইক্লিং প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির নাম গ্রিন মেশিন। এটি প্রথমবারের মতো পলিয়েস্টার আর সুতির মিশ্রণ পৃথক এবং পুনর্ব্যবহারে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ফাইবার তৈরি করতে সক্ষম। কোম্পানিটি এই গ্রিন মেশিনে প্রস্তুত ফাইবার দিয়ে বানিয়েছে ট্র্যাক স্যুট সেট, যাতে রয়েছে হুডি এবং ট্র্যাক প্যান্ট।
২০১৬ সালে এইচঅ্যান্ডএম ফাউন্ডেশন কোলাবোরেশন করে হংকং রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (এইচকেআরআইটিএ)। এই পার্টনারশিপের ঠিক এক বছরের মাথায় একটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়, যখন এইচকেআরআইটিএর গবেষকেরা হাইড্রোথার্মাল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর মাধ্যমে তুলা আর পলিয়েস্টারকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং রিসাইকেল করে একদম নতুন ধরনের ফাইবার এবং সেলুলোজ পাউডার তৈরি করা যায়। অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এটি অনেক বেশি কোমল। ফাইবারের কোনো ক্ষতিও করে না। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি উপাদানের গুণগত মান অক্ষুণ্ন থাকে। ফাস্ট ফ্যাশনের পাল্লায় পড়ে যেসব কাপড় বাতিলের খাতায় ওঠে, সেগুলো ফেলে দেওয়া হয় ভাগাড়ে, সেসব কাপড় খুব সহজে গ্রিন মেশিনের হাইড্রোথার্মাল পদ্ধতির মাধ্যমে রিসাইকেল করা সম্ভব।
এটি সম্পর্কে এইচঅ্যান্ডএম ফাউন্ডেশনের ইনোভেশন লিড এরিক ব্যাং বলেন, গ্রিন মেশিন প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি মাইলফলক। আমরা রিসাইকেল টেক্সটাইল তৈরির কাছাকাছি শুধু নই, একে সবার জন্য সহজলভ্য করছি। এভাবে ‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন যে ব্যয়বহুল’—এ মিথ থেকে বেরিয়ে আসছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে আমরা যদি সিরিয়াস হয়ে থাকি, তবে অল্পতেই থেমে গেলে চলবে না। মেশিনটি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, এটি আমাদের রান্নাঘরে থাকা প্রেশার ব্রয়লারের চেয়ে খুব ভিন্ন কিছু নয়। এই হাইড্রোথার্মাল পদ্ধতিতে একটি মিশ্রিত কাপড় থেকে তন্তুগুলো আলাদা হয়ে যায়। এমনকি রং পর্যন্ত বের হয়ে আসে। এর অর্থ, এই কাপড় যেকোনো স্টাইলে রিসাইকেল করা সম্ভব।
শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক কাঞ্জি কাঞ্জিওয়ারা এবং তার টিম এই হাইড্রোথার্মাল পদ্ধতি আবিষ্কার করে নাম দেয় গ্রিন মেশিন। এর বৈশিষ্ট্য হলো, এতে শুধু তাপ, পানি, চাপ এবং একটিমাত্র জীবাণুবিয়োজ্য রাসায়নিক পদার্থের ৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। জানা গেছে, এই রাসায়নিক পদার্থ আসলে সাইট্রিক অ্যাসিড। লেবু ও লেবুজাতীয় ফলসমূহে এটি পাওয়া যায়। এ ছাড়া তা ব্যয় এবং সময়সাশ্রয়ী। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এ পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো রকমের দূষণের সম্ভাবনা নেই। গ্রিন মেশিন দিয়ে তৈরি ফ্যাব্রিক অত্যন্ত টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব।
আমরা এখন যে ধরনের পোশাক পরি, তার বেশির ভাগই বিভিন্ন রকমের ফাইবারের মিশ্রণে তৈরি। এর ভেতর সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তুলা ও পলিয়েস্টারের মিশ্রণ। এগুলো একসঙ্গে থাকলে তা রিসাইকেল করা খুবই কঠিন, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। গ্রিন মেশিন হাইড্রোথার্মাল পদ্ধতির মাধ্যমে এই মিশ্রণকে আলাদা করে। এতে পলিয়েস্টার সুতায় আর তুলা সেলুলোজ পাউডারে পরিণত হয়। এই রিসাইকেল পলিয়েস্টার দিয়ে বানানো যাবে নতুন পোশাক আর সেলুলোজ পাউডার অন্য অনেক কাজে ব্যবহার করা যাবে। এইচঅ্যান্ডএমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এথিক্যাল ফ্যাশন ব্র্যান্ড মনকি প্রথম সুযোগ পেয়েছে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের। এর মাধ্যমে তারা যে হুডেড সোয়েটশার্ট এবং সোয়েটপ্যান্ট বানিয়েছে, তাতে এমব্রয়ডারি করে লেখা আছে, respect your mother (nature) অর্থাৎ ধরিত্রী মাতাকে সম্মান করো। এভাবে তারা নিজেদের ক্রেতাদের পরিবেশ রক্ষার খাতিরে, সাসটেইনেবল জীবনযাপনে আহ্বান জানাচ্ছে।

ব্র্যান্ডের প্রডাক্ট হলেও ট্র্যাক স্যুট সেট বেশ সুলভ মূল্যে বিক্রি করছে মনকি। অনলাইন এক্সক্লুসিভ এই সোয়েটপ্যান্ট এবং সোয়েটশার্টের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র চল্লিশ পাউন্ড, যা অন্যান্য এথিক্যাল ফ্যাশন ব্র্যান্ডের যেকোনো পণ্যের চেয়ে কম। উল্লেখ্য, মনকি প্রথম তাদের শোরুম খোলে সুইডেনের গোথেনবার্গে, ২০০৬ সালে। এখন পর্যন্ত ব্র্যান্ডের বেসড এই শহরে। ২০০৮ সালে মনকি যোগ দেয় এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপে এবং আজ এটি ইউরোপ ও এশিয়ার বিরাট একটা মার্কেট দখলে রেখেছে তাদের প্রডাক্ট দিয়ে। এই স্টোরিটেলিং ব্র্যান্ড প্রায় পনেরো বছর ধরে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দুর্দান্ত সব ফ্যাশনপণ্য নিয়ে আসছে। তাদের উইমেন্স ওয়্যার লেবেলটি স্ট্রিট স্টাইলের জন্য বেশি বিখ্যাত। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মনকির ১১৯টি স্টোর, ২৮টি মার্কেট স্টোর এবং ৩১টি অনলাইন মার্কেট রয়েছে। সাসটেইনেবল ফ্যাশনের পথে এই ব্র্যান্ডের পদচারণ অনেক আগে থেকে। গত সেপ্টেম্বরে মনকি এনেছিল লিমিটেড এডিশন আপসাইকেল ডেনিম কালেকশন। এর আগে তারা প্লাস্টিকের বোতল আর সামুদ্রিক বর্জ্য থেকে বানিয়েছিল নজরকাড়া সব সুইমওয়্যার। ব্র্যান্ডটি ঘোষণা দিয়েছে, তারা বড় মাপে অটাম ২০২১ কালেকশনের সব পোশাক গ্রিন মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করবে।
ইতিমধ্যেই এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রযুক্তির দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়েছে এবং বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ৪৬তম ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন অব ইনভেনশন অব জেনেভাতে গোল্ড মেডেল এবং ২০১৯ সালে এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইনোভেটিভ ইনভেনশন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন।
ফাস্ট ফ্যাশন হাউস এইচঅ্যান্ডএম প্রকৃতি রক্ষার খাতিরে নিজেদের পরিবর্তন করার পথে হাঁটা শুরু করেছে অনেক আগে। নিজেদের কালেকশন বানানোর জন্য ব্যবহার করছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। গ্রিন মেশিনের আগে তারা এনেছে রিসাইক্লিং সিস্টেম ‘লুপ’। এ পদ্ধতিতে পুরোনো, অবাঞ্ছিত কাপড় চোখের নিমেষেই পরিণত হবে স্টাইলিশ আউটফিটে। আর পাঁচ বছর ধরে তারা আয়োজন করছে ‘গ্লোবাল চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’। এ অ্যাওয়ার্ডকে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের নোবেল প্রাইজ বলা হয়। যেসব উদ্ভাবনের মাধ্যমে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি পরিবেশবান্ধব প্রডাক্ট উৎপাদন করবে, তাদেরকে পুরস্কার এবং আরও ভালো গবেষণা করার জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বের নামকরা এই ফ্যাশন গ্রুপ। একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য এইচঅ্যান্ডএম ফাউন্ডেশন দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন, উদ্ভাবক এবং উদ্যোক্তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে।

 ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top