skip to Main Content

ফিচার I ধাতুজাত

একসময় ছিল প্রাত্যহিক ব্যবহার্য; এখন শৌখিন ও প্রদর্শনযোগ্য সামগ্রী হিসেবে এর কদর। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

অনেক আগেই বাংলায় কাঁসা-পিতলের তৈরি তৈজসের ব্যবহার ছিল। একটা সময় গ্রামবাংলাজুড়ে শোনা যেত কাঁসারির হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ। সে সময় দেশে পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের খুব প্রচলন ছিল। বিশেষ করে রান্নাঘরের তৈজসপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে কাঁসা-পিতলের থালা, বাটি, গ্লাস, রান্নার হাঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো।
সাধারণত জমিদারবাড়ি ও অভিজাত পরিবারগুলোতে ধাতব তৈজসপত্র বেশি দেখা যেত। তামা-কাঁসার জিনিসপত্র ব্যবহারকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। তবে এখন শহরে তো বটেই, গ্রামগঞ্জে আর খাবার টেবিলে সেসব সোনালি ধাতুর থালা-গ্লাসের উপস্থিতি সচরাচর চোখে পড়ে না। চুলার ছাইয়ের সঙ্গে একটু তেঁতুল দিয়ে ঘষামাজা ঝকঝকে কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি; চামচ, জগ, কলসি, বালতি, ঘটি গত শতকের মাঝামাঝিতেও প্রচুর দেখা গেছে। বিয়েশাদি বা মুখে ভাতের নিমন্ত্রণে চমৎকার কারুকাজ করা ধাতব তৈজসের সেট উপহার দেওয়ার চল ছিল তখন।
বাড়ির বনেদিয়ানার পরিচয় প্রকাশ পেত কাঁসা-পিতলের সামগ্রীর মান ও পরিমাণের প্রাচুর্যের ওপর। এসব তৈজসপত্র কেবল যে বহুদিন টিকে থাকত; তা-ই নয়, পরিবারে মূল্যবান সম্পদ হিসেবেও গণ্য হতো। সোনা-রুপার অলংকারের পরে কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্রই ছিল বাড়ির দামি সামগ্রী।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধাতুনির্মিত সামগ্রীও বদলে যেতে থাকে। তার জায়গায় চলে আসে চিনামাটির থালা-বাটি। পরে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অভঙ্গুর ও তাপসহনীয় কাচ; পোরসেলিন, পাইরেক্স, মেলামিনসহ নানা রকম উপাদানের তৈজসপত্র। এখন স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় প্লাস্টিকের সামগ্রীর জয়জয়কার। তা সত্ত্বেও কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র একেবারে উঠে যায়নি। সেসবের ঐতিহ্য আর আভিজাত্য ফিরে আসছে নতুন রূপে। আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত হলেও কাঁসার থালা-বাটি এখন শহুরে সংস্কৃতির শখের উপাদান। নগরবাসীর কেউ কেউ তা সংগ্রহে রাখেন ঘরের সাজে বাঙালিয়ানা ও নিজস্ব রুচির প্রকাশ ঘটাতে।
ধারণা করা হয়, পাল বংশের রাজত্বকাল থেকে এ বাংলার যেসব শিল্প উৎকর্ষে পৌঁছেছে, কাঁসা-তামা-পিতলের তৈজসপত্র সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে এ ধারণা নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশে কিংবা অবিভক্ত বাংলায় এই সোনালি ধাতুর প্রচলন কখন, কীভাবে শুরু হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। মনে করা হয়, এটির চল শুরু প্রাচীন সভ্যতায়, যখন ব্রোঞ্জের কাল ছিল। আবার অনেকেই এ শিল্পকে মহাস্থানগড়কেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন।
১৫৭৬-১৭৫৭ সালে মোগল আমলে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয় বলে জানা গেছে। তখন এসব ধাতু দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক ইত্যাদি যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করা হতো। ব্রিটিশ শাসন আমলেও এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় ঢাকার ধামরাই, শিমুলিয়া ছাড়াও টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে।
কালের বিবর্তনে কাঁসা-পিতল সামগ্রী ব্যবহারের মাত্রা দিন দিন কমে গেলেও শৌখিন মানুষের কাছে এর চাহিদা রয়ে গেছে। অন্দরসজ্জার উপকরণ হিসেবেও ইদানীং ঘরে শোভা পাচ্ছে এই ধাতব উপকরণ। এসবের মধ্যে রয়েছে নানা রকম শোপিস; ওয়াল ম্যাট, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গ্লাস, থালা, বাটি, কাজলদানি, চামচ, হুক্কা, কলস, ঘণ্টা, গামলা, চামচ, বালতি, ডেগ, কড়াই প্রদীপ, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, সংগীত সাধনার যন্ত্র, খেলনা, আয়নার ফ্রেম ইত্যাদি। তখনকার দিনে এসব জিনিসের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও।
শুধু ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবেই নয়, কাঁসা-তামার পাত্রের ব্যবহার সুস্বাস্থ্যেও অবদান রাখে। অন্যদিকে সময়ের পরিবর্তনে পুরোনো আমলের জিনিসপত্রের চল আবারও ফিরে এসেছে। মাটি কিংবা পাটের তৈরি উপকরণের প্রতি ঝুঁকছে সবাই। ঠিক একইভাবে প্রতিদিনের ব্যবহারে খাবার ও পানি গ্রহণের জন্য অন্য যেকোনো উপাদানের বাসনের পরিবর্তে কাঁসা-তামার তৈরি পাত্র ব্যবহারের চল ফিরিয়ে আনা যেতে পারে, যেগুলো একই সঙ্গে আভিজাত্য আনবে এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষায়ও ভূমিকা রাখবে। তামার পাত্রে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত পানি সংরক্ষণ করা হলে এই ধাতুর মাইক্রোবিয়াল ধর্ম পানিতে থাকা ক্ষতিকর মাইক্রোবগুলোকে মেরে ফেলে। এতে করে ওই পানি পানে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা কমে যায় অনেকখানি।
এ ছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পানি ধারণ এবং তা পানের পাত্রও বদলে ফেলা যেতে পারে। অনেক বাড়িতেই প্লাস্টিকের জগে পানি রাখা হয়। প্লাস্টিক পার্টিকেল পানির সাহায্যে খুব স্বল্প পরিমাণে শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই সামগ্রীর পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে তামা-পিতল বা কাঁসার জগ। অন্যদিকে তামার পাত্রে পানি ধারণ এবং তা পান করা হলে পাকস্থলীর খাদ্য দ্রুত ও ভালোভাবে পরিপাক হয়, যা শরীর থেকে ফ্যাট বের করে দিতে সহায়ক। ফলে দেহে বাড়তি ফ্যাট জমতে পারে না।
তামাকে বলা হয় বলিরেখা দূরীকরণের প্রাকৃতিক উপাদান। বয়সজনিত ও অনিয়মের কারণে ত্বকে বয়সের ছাপকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলতে তামার পাত্রে ধারণ করা পানি পানের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এই ধাতু থেকে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা কোষকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক। এই ধাতু ক্ষতিকর রেডিক্যাল মুক্ত হওয়ায় ত্বক তো বটেই, স্বাস্থ্যের ওপরেও কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পাশাপাশি তামা একটি অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি তথা প্রদাহবিরোধী উপাদানও। ফলে শরীরের যেকোনো অংশের প্রদাহের পাশাপাশি আর্থ্রাইটিসজনিত হাড়ের ব্যথাতেও তামার পাত্রে ধারণ করা পানি উপকারী উপাদান হিসেবে বিবেচ্য।
মেলামিন ও প্লাস্টিকের পাত্র যেমন ক্যানসার ডেকে আনে, অন্যদিকে তামার পাত্র রোগটি থেকে শরীরকে মুক্ত রাখতে কাজ করে। বিশেষত এই ধাতুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-কারসেনোজেনিক ধর্ম শরীরে ফ্রি রেডিক্যালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে ক্যানসার সংক্রমণে বিঘ্ন ঘটায় এবং বৃদ্ধি প্রতিহত করে।
তামা-পিতল অথবা কাঁসার বাসন-কোসনের চাহিদা কমলেও এগুলোতে তৈরি শোপিসের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। উপহার হিসেবে দেওয়া যায় বলে এমন পণ্য ক্রেতারা বেশি কিনছেন। বৈশাখের মতো উৎসব-পার্বণেও এসব ধাতুর জিনিসপত্রের ব্যবহার দেখা যায়। এ ছাড়া শারদীয় দুর্গাপূজাতেও কাঁসার নতুন তৈজসপত্র কেনার হার বেড়েছে। পুরান ঢাকা, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন এলাকার তৈজসপত্রের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে কাঁসা ও পিতলের বিভিন্ন সামগ্রী। বাংলাবাজারের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী বাসনালয়ের সামনে থেকেই চোখে পড়ে নানা রকম কাঁসার বাসনপত্র ও পূজার নানা সামগ্রী। অন্যদিকে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় রয়েছে বিশাল বাজার। এলিফ্যান্ট রোডেও আছে অনেক দোকান। গুলশান ডিসিসি মার্কেটে (দোতলা) মিলবে পিতল ও কাঁসার তৈরি বিভিন্ন গৃহসজ্জা সামগ্রী এবং অ্যান্টিক শোপিস। ফরমাশ দিয়ে বানিয়েও নেওয়া যায় নিউ এলিফ্যান্ট রোড ও পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে। এখানে রেডিমেড ও অর্ডার- দুভাবেই পিতল-কাঁসার পণ্য বিক্রি হয়। এ ছাড়া আড়ং, যাত্রা, দেশী দশ, স্বদেশি, আইডিয়া ক্রাফটসহ বিভিন্ন দেশি ফ্যাশন হাউসে পাওয়া যায় পিতল ও কাঁসার তৈরি নানা শোপিস ও গৃহসজ্জা সামগ্রী।
সাধারণত কেজি দরে এসব পণ্য বিক্রি হয়। এখন ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে কাঁসা এবং ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে পিতলের তৈরি পণ্যসামগ্রী। পিতলের হাঁড়ি প্রতি কেজি ১ হাজার ৫০০ টাকা, গ্লাস ১ হাজার ২০০ টাকা, প্লেট ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং থালা ১ হাজার ৬০ টাকা। কাঁসার তৈরি হাঁড়ি ২ হাজার ৫০০ টাকা (কেজি হিসেবে), গ্লাস ২ হাজার ২০০ টাকা, প্লেট ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং থালা ২ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া একটি করেও কেনা যায়।
কাঁসা ও পিতলের বাটি প্রতিটি ২৫০ থেকে ১২০০ টাকা, থালা প্রতিটি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, জগ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, চামচ প্রতিটি ১৮০ থেকে ৩০০ টাকা, গ্লাস প্রতিটি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, সাজানোর জিনিস ১৫০ থেকে ৫০০০ টাকা, প্রদীপদানি ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আড়ংয়ে কাঁসার মোমদানি ১০৯৯ থেকে ১১৬৩ টাকা, বাটি প্রতিটি ৮৭০ টাকা, সিঁদুর বাটি ১৮৭ টাকা, শোপিস প্রতিটি ১৮০ থেকে ১২০০ টাকা।
শুধু ব্যবহার করলেই চলে না, জানতে হয় এসব পণ্যের পরিচর্যা সম্পর্কেও। সঠিকভাবে যত্ন করতে জানলে এসব তৈজসপত্র ব্যবহার করা যায় দীর্ঘদিন। ব্যবহারের পর এগুলো জমিয়ে না রেখে সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে রাখতে হবে। কাঁসা-তামা বা পিতলের পাত্র পরিষ্কার করতে তেঁতুল, লেবু কিংবা ভিনেগার দিয়ে ঘষে নিতে হয়। দাগ পড়ে গেলে তেঁতুল গোলানো পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখা দরকার। এরপর নরম কাপড় দিয়ে ধীরে ধীরে ঘষলে দাগ উঠে যাবে।
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top