skip to Main Content

ফিচার I শহরের মৃত্যুগাথা

মৃত নগরের গল্প। পৃথিবীতে এমন কিছু নগরী আছে, যেগুলো আজ জাদুঘরের বিষয়। মানে, ইতিহাস ছাড়া সেসবের বিবরণ পাওয়া মুশাকিল। কিন্তু কেন এমনটি হলো? লিখেছেন মনোজ দেব

শহরেরও মৃত্যু হতে পারে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ, মহামারি ইত্যাদির ফলে। যদিও মৃত শহরগুলো পর্যটকদের প্রধান একটি আকর্ষণ। পৃথিবীতে রয়েছে এমন কিছু নগর, যেগুলো সময়ের পরিবর্তনে পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত স্থানে, কোনোটি ভীতিকর। যেমন পম্পেই, মায়া সভ্যতার প্রাচীন নগরী কিংবা চেরনোবিল।
হাজার বছরের পুরোনো শহর পম্পেই। ভিসুভিয়াসের লাভার নিচে ডুবে যায় ছোট্ট এই নগরী। ইতালির ক্যাম্পানিয়া প্রদেশের নেপলসে [নাপোলি] এর অবস্থান। একসময় উপকূলের কাছাকাছি থাকলেও এখন সমুদ্র সেখান থেকে দূরে সরে গেছে। নেপলস থেকে ট্রেনে যাওয়া যায়। এই মৃত নগরীর রয়েছে অনেক প্রবেশপথ। ফটকের ভেতরে ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস। সারি সারি স্তম্ভ, পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল। পাথরের রাস্তা চলে গেছে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আছে দেবরাজ জুপিটার, অ্যাপোলোসহ আরও অনেক দেব-দেবীর মন্দির। নগরের মাঝখানে রয়েছে উন্মুক্ত বড় অনুষ্ঠানস্থল, যাকে বলে ফোরাম। এর চারদিকে বিভিন্ন ধরনের ভবন। ফোরামের স্কয়ারে আছে বেশ কিছু স্মৃতিস্তম্ভ। পুরো শহরে অনেকটা একই রকম সারি সারি ইমারত ধসে পড়া ছাদ, ফাঁকা জমি। এখন সেখানে ঘন ঘাস আর গাছগাছালির সারি।
শহরের মাঝখানে হাউস অব দ্য ফন নামের বিখ্যাত বাড়ি। উদ্যানে ছিল ফোয়ারা, তার সামনে ফনের ভাস্কর্য। এককালে এই বিশাল বাড়ির মূল আকর্ষণ ছিল অসাধারণ মোজাইকের কাজ। যেখানে আলেকজান্ডারের সঙ্গে ইরানের স¤্রাট দারিউসের যুদ্ধ দেখানো হয়েছে। এমনই আরেকটি স্থাপনা হাউস অব দ্য ট্র্যাজিক। এর প্রবেশপথে মোজাইকে খোদাই করা ভীষণ আকর্ষণ কুকুর, আর ভেতরে গ্রিক পুরাণের নানা চিত্র।
পম্পেই শহরের রাস্তাগুলো ছিল সামান্য ঢালু, বৃষ্টির পানি যেন সহজে নেমে যেতে পারে। ওখানের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল রান্নাঘর। চমৎকার মোজাইকের কাজ, রান্নার বাসনকোসন রাখার জন্য গোল গোল ছিদ্র—ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখনো টিকে আছে। এই নগরীর অসাধারণ সব চিত্রকর্ম নেপলস পুরাতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত। একইভাবে এখানকার আদিবাসী ও অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহগুলোর অধিকাংশই এই মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।
ধারণা করা হয়, ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের সময় এখানে বিশ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। জনসংখ্যা হাজার দশেক হলেও এই এলাকা ছিল রোমানদের অবকাশ যাপনের কেন্দ্র। এখানে গড়ে উঠেছিল রোমান অ্যারেনা, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই থেকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান—সবই এখানে চলত।

দুই
২৫০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। মেক্সিকোর দক্ষিণে এবং উত্তর-মধ্য আমেরিকায় ছিল মায়া সভ্যতা। যেখানে বাস করত প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির মানুষ। অঞ্চলটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিকভাবে গতিশীল। কিন্তু কেন ধ্বংস হয় এই সভ্যতা?
গবেষকেরা বলছেন, পরিবেশগত দুর্যোগ, মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এমনটি হয়েছিল। অনেকে অনুমান করেন, সে সময়ের একটি তীব্র খরা এই সভ্যতার পতনের কারণ। শুষ্ক মৌসুমে যেসব জলাধার এই অঞ্চলের লোকদের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখত, সেগুলোর স্বল্পতা সেখানকার দীর্ঘকালীন খরার জন্য দায়ী। এভাবেই তারা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। নবম শতকে মায়া সভ্যতার ধ্রুপদি যুগের শেষ দিকে, ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক কিছু একটা ঘটেছিল বলে গবেষকদের ধারণা। ফলে জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে আর সভ্যতার স্মারক পাথরের ভবনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ভিয়েনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কৃষি প্রযুক্তি খরার সময় এই অঞ্চলকে টিকিয়ে রেখেছিল, সেসবই বড় বড় বিপর্যয়ের সময় তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তিন
প্রাকৃতিক দুর্যোগও কোনো কোনো সময় পরিবেশগত বিশৃঙ্খলার কারণে ঘটে, কিন্তু চেরনোবিল দুর্ঘটনা পুরোটাই প্রযুক্তির ফল। স্মরণকালের এই ক্ষতির জন্য পরোক্ষ হলেও প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ধ্বংস করাকে দায়ী করেছেন গবেষকেরা।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে পুরো শহরটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেখানে নিরাপদ শীতলীকরণে একটি পরীক্ষা চালানোর সময় পারমাণবিক চুল্লি জরুরি বন্ধ করতে গেলে অসতর্কতার কারণে বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। এর আগুন ১০ দিন জ¦লেছিল। আর পারমাণবিক বিক্রিয়াজনিত পদার্থ প্রায় ১ কিলোমিটার উচ্চতায় ছড়িয়ে পড়েছিল । পরিমাণে তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় বিস্ফোরিত পাঁচ শ পারমাণবিক বোমার সমান। ফলে পারমাণবিক মেঘ ইউক্রেন, বেলারুশের আকাশ ছাড়িয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কয়েকটি দেশ ও ব্রিটেনের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সরকারি তথ্যমতে, এই দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ৫০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ৬ লাখ শিশু। দুর্ঘটনার তিন মাসের মধ্যে মারা যায় ৩১ হাজার। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ২০০ বিলিয়ন ডলারের সমান। অন্যদিকে, তেজস্ক্রিয়তার কারণে পাশর্^বর্তী প্রিপিয়াত নদীসহ অন্যান্য জলাধারের পানি দূষিত হয়ে পড়ে। নদীটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় জলাধার দনিপে মিশেছে। গবেষকেরা বলছেন, এসব জলাধারের পানিতে মিশে যাওয়া তেজস্ক্রিয় ৮০০-১০০০ বছর ধরেও শোধিত হবে না। এখন পর্যন্ত শহরটি পরিত্যক্ত। এর ৫০ মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই।

চার
পৃথিবীব্যাপী এখন অনেক দেশই পরিবেশসচেতন হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এখানকার পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বনায়ন, নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির পক্ষে এবং পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কথা বলছে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনও করছে। গবেষকেরা বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা যদি শুধু সম্পদের ঘাটতি নিয়ে কাজ করে এবং মানুষ তাদের আচরণের পরিবর্তন না ঘটায়, তাহলে সমাজ ও সভ্যতা অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তাদের মতে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বড় শহরগুলো এমনই ঝুঁকিতে রয়েছে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top