skip to Main Content

ফিচার I চায়ের উপনিবেশ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতেই গড়ে উঠেছিল এখানকার চা-বাগানগুলো। সেই ব্রিটিশরা আজ নেই, কিন্তু রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক আইন ও পীড়নমূলক প্রথাগুলো। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

ব্রিটিশরা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া শোষণ এখনো বাগানগুলোতে একইভাবে চলছে। রপ্তানিকারক পণ্যের কারিগর চা-শ্রমিকদের এখনো তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রেখেছে কোম্পানিগুলো। বাগানে ২০ কেজি চা-গাছের কচি পাতা মেপে নিয়ে ১২০ টাকা হাতে গুঁজে দেওয়া পর্যন্তই মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক সীমাবদ্ধ। ২০২১ সালে এসে এ কথা শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, চা-বাগানের শ্রমিকদের মালিক তো দূরের কথা, বাগানের ম্যানেজার থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলাফেরা বা মেলামেশাও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চা-বাগানে এখনো ঔপনিবেশিক সেই আইন রয়ে গেছে। চারপাশে উন্নয়নের ছোঁয়া। সময়ের বিবর্তনে দেশ, জাতি এবং মানুষের জীবনে নানা পরিবর্তন ঘটলেও চা-শ্রমিকদের ভাগ্য এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন।
এই অঞ্চলে চা-শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে। সম্ভবত ১৭৮০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে চা-চাষের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর আগ পর্যন্ত ব্রিটিশরা চীন থেকে চা আমদানি করে ব্যবসা করত। আসামে চা-চাষের সূচনা ১৮৩৯ সালে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামেও চা উৎপাদন শুরু হয়। এ জন্য সেখানে চীন থেকে চারা আমদানি করা হয়। মূলত ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোই এর উদ্যোক্তা ছিল। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই এলাকায় জঙ্গল পরিষ্কার করেই শুরু হয়েছিল চা-বাগানের কাজ। সেটি সহজ ছিল না। প্রথমে চেষ্টা করা হয়েছিল স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে চা চাষ করা। তবে সেখানকার লোকেরা এসব কাজ করতে চাইত না এবং দক্ষও ছিল না। সিলেট তখন ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যভুক্ত একটি জেলা। আসামের জনসংখ্যা তখন খুবই কম ছিল। চা-বাগান গড়ে তোলার জন্য বিশাল একটা জনগোষ্ঠী সেখান থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তা ছাড়া সিলেটসহ আসাম অঞ্চলের আর্থসামাজিক বিন্যাসে নিয়মিত মজুরিভিত্তিক শ্রমিকের কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। সেখানকার প্রায় সবারই নিজস্ব জমিজমা ছিল। তাই নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে চা-বাগানের শ্রমিক হতে রাজি ছিল না স্থানীয়রা। অন্যদিকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের কাছে চা-শিল্প বিকাশের জন্য আসলে শ্রমিক নয়, ক্রীতদাস প্রয়োজন ছিল। এর জন্য বাইরের শ্রমিক জরুরি হয়ে পড়েছিল। ফলে ভারতের উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের অভাবপীড়িত হাজার হাজার বেকার কৃষক-মজুরকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোর করে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুদের এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়।
এসব মানুষকে আসাম ও সিলেট অঞ্চলের গহিন জঙ্গলে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করে ব্রিটিশ শাসকেরা।
হতদরিদ্র এবং অসহায় ওই সব শ্রমিককে এই বলে নিয়ে আসা হয়েছিল যে, তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন এক পাহাড়ঘেরা দেশের চমৎকার বাগানে, যেখানে গাছের পাতা খাঁটি সোনার তৈরি। কেউ সে গাছে ঝাঁকুনি দিলেই ঝরতে থাকবে সেই সোনালি পাতাগুলো। কিন্তু বাগানে আসার পর এসব শ্রমিকের পরিচয় হয় ‘কুলি’। চা—কোম্পানিগুলো তাদেরকে সম্পত্তিতে পরিণত করে। হতভাগ্য সেই সব শ্রমিককে আর সোনার পাতা পাওয়া হয়নি। প্রাচীন দাসপ্রথার আদলে সবুজে ঘেরা চা-বাগানের লেবার লাইনে তাদেরকে বন্দি করে ফেলা হয়। বাগান কর্তৃপক্ষ সে সময় স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাদের নিয়ে গিয়ে শ্রমদাস করে ফেলার জন্য একটি চুক্তি করে। চা-বাগানের অশিক্ষিত শ্রমিকের কাছে তা বহুল প্রচলিত ‘গিরমিন্ট’। এদিকে অর্থনৈতিকভাবেও তাদেরকে এমনভাবে নিগড়ে ফেলা হয়, যাতে তারা বাগানের বাইরে কিছু করতে না পারে।
সারা দিনের হাড়-খাটুনি শেষে শ্রমিকেরা ঠিকমতো খাবার জোটাতে পারত না। অখাদ্য খেয়ে; অসুখ-বিসুখে ভুগে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া বাধিয়ে, বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়ে, হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে এবং একই সঙ্গে মালিকদের নির্যাতন মাথায় পেতে তাদেরকে জীবন নির্বাহ করতে হতো। এসব নিপীড়নের জন্য আইনও করা হয়েছিল। ‘ওয়ার্কমেন্স ব্রিচ অব কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট’ নামের ওই আইনে বলা হয়েছিল, যদি শ্রমিকেরা চুক্তিভঙ্গ করে বাগান থেকে চলে যেতে চায়, তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাগানমালিকদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, এর শাস্তি হিসেবে তারা শ্রমিকদের আটক করতে পারবে।
তখনকার শ্রমিক-কর্মচারীদের ব্রিটিশ চা-বাগান মালিকদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ছিল না। শ্রমিকেরা যেহেতু বহিরাগত ছিল, তাই তারা নিজেদের পরদেশি ভাবত। তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তোলা হয়েছিল। একটি বাগানে যদি ১০০ চা-শ্রমিক থাকত, তাদের মধ্যে স্থানীয় বাঙালি থাকত মাত্র ১০ জন। আর বাকি শ্রমিকদের মধ্যে ওডিশা, বিহার, দেহাতি অথবা মধ্যপ্রদেশের দলিত শ্রেণিভুক্তদের মিশ্রণ দেখা যেত। এদের মধ্যে একটি শ্রেণিকে নেপাল থেকে আনা হয়েছিল। এরাই মূলত এখন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ চা-শ্রমিক।
বাগানের ম্যানেজার সব সময় ব্রিটিশ নাগরিকই হতেন। তখন তাদের দাপট ছিল এখনকার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের মতোই। তারা যখন হাতে বেত নিয়ে বাগান পরিদর্শনে বের হতো, শ্রমিকেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। বেতন আনার সময় ডাকলে নারী শ্রমিকেরা আতঙ্কে কাঁপত। ম্যানেজারের বাংলোয় গিয়ে চাবুক না খেয়ে কেউ বের হতে পারত না। ম্যানেজারের কামরাতেও ঢুকতে হতো নমনীয় কায়দায়। খালি পায়ে ঢুকে তাদেরকে হাঁটু গেড়ে বসতে হতো। কাজ শেষে ফিরতে হতো পেছন ফিরে।
এ রকম অসংখ্য জঘন্য কালো আইনের বেড়াজালে শ্রমিকদের জীবন দাসত্বে পরিণত হয়েছিল। অথচ এই শ্রমিকদের বলা হয়েছিল ‘গাছ হিলায়ে তো পয়সা মিলেগা’। অর্থাৎ গাছ ঝাঁকালেই পয়সা পাওয়া যাবে। গাছ থেকে টাকা আসত ঠিকই, তবে তা পুরোটাই চলে যেত মালিকের পকেটে। শ্রমিকের কপালে পয়সার বদলে জুটত নির্যাতন আর কাটাতে হতো শোষণের দুর্বিষহ জীবন। সেই আচরণ তারা সব সময় মেনে নিতে পারত না বলেই মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ করে উঠত। এই বিদ্রোহ থেকেই ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯২১ সালের ২০ মে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন প-িত গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত এবং দেওশরণ ত্রিপাঠী। উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার শিকলকে ভেঙে ‘মুল্লুকে চলো’ অর্থাৎ নিজেদের জন্মভূমিতে ফেরা। বিদ্রোহটি ব্রিটিশদের ভিত নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই বিদ্রোহের পরিণতিতে শ্রমিকেরা গণহত্যার শিকার হয়েছিল। চাঁদপুরের ফেরিঘাটে গোর্খা বাহিনীর হামলায় সেদিন রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল। ঠিক কতসংখ্যক চা-শ্রমিককে সেদিন হত্যা করা হয়েছে, তা-ও রয়েছে অজানা।
মুল্লুক চলো আন্দোলন হয়েছিল বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শ্রমিকেরা বাগানে থাকতে চায়। তবে সেটাও তাদের কপালে জোটে না। শ্রম আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী, একজন শ্রমিক চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বাগান ছেড়ে যেতে বাধ্য থাকে।
প্রতিটি বাগানের জন্য সে সময় আলাদা প্রতীকী মুদ্রা ছিল। বাগানের বাইরে এগুলোর কোনো মূল্য ছিল না। এসব মুদ্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনত চা-শ্রমিকেরা। অর্থাৎ বাগানে তাদের বেঁধে রাখার সব আয়োজন করে রেখেছিল কূট বুদ্ধির ব্রিটিশ মালিকেরা। এ মুদ্রার কিছু নমুনা বাগান-শ্রমিকদের কাছে এখনো আছে। ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ শাসন শেষ হলো, পাকিস্তানও বিদায় নিল। কিন্তু চা-শ্রমিকদের ভাগ্যে আগেও যা ছিল, এখনো তাই আছে। পারিশ্রমিক কিছুটা বাড়লেও তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ-পাকিস্তানিদের চালু করা সিস্টেমের সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি। তারা কেবল দেখেছে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি-বিহারি ম্যানেজারদের ইংলিশ বদলে বাংলিশ বলা ম্যানেজার।
সারা দিন কাজের পর একজন চা-শ্রমিকের আয় হয় ১২০ টাকা। তাদের নেই কোনো নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত পরিচয়; লেখাপড়ার সুযোগ, স্যানিটেশন এমনকি চিকিৎসার ব্যবস্থাও। নিজের অধিকার নিয়ে যেন শ্রমিকেরা সোচ্চার না হতে পারে, সে জন্য মালিকপক্ষের সহযোগিতায় তাদেরকে নেশার ঘোরে রাখা হয়। পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি চা-বাগানে রয়েছে মদের দোকান। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যতটুকু পয়সা কপালে জোটে, তা-ও তারা মদের আসরে শেষ করে রেখে আসে।
চা-বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনো ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের দাস হয়ে আছে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top