skip to Main Content

ফিচার I বটের ছায়ায়

এই অঞ্চলে বটবৃক্ষগুলো বহু বছরের সাক্ষী হয়ে আছে। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রসিদ্ধ অনেক স্থান, হাটবাজার ও সমাবেশস্থল। বিনোদনের উৎসকেন্দ্র তো বটেই। লিখেছেন বিপ্লব সরকার

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, বৃক্ষ তোমার নাম কী! ফলে পরিচয়। যদিও সব ফল বা বীজে গাছের প্রকৃত পরিচয় থাকে না। ক্ষুদ্র বটফলের মধ্যে যে লুকিয়ে থাকতে পারে এমন অরণ্যের বিশালতা, দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
তবে এই গাছকে কেবল বৃক্ষ বললে তার অস্তিত্বকে ছোট করা হয়; বরং এটি বৃক্ষরাজ তথা মহীরুহ। বাংলা অঞ্চলে তো বটেই, গাছটি বিশ্বের প্রাচীনতম। চিরহরিৎ সাইকাস প্রজাতির বহুবর্ষজীবী এই উদ্ভিদ নিয়ে ভারত উপমহাদেশে কত শত-সহস্র কাব্য, উপন্যাস, গল্প, নাটক, লোককথা, পৌরাণিক উপাখ্যান ও গান রচিত হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, বটগাছের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সংস্কৃতিচর্চা, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি। এমনকি এই বৃক্ষের ছায়ায় গড়ে উঠেছে অবসর যাপন, গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে ক্লান্ত মানুষের শীতল আশ্রয় এবং বিনোদনের উল্লেখযোগ্য স্থান। এখন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে অনুষ্ঠান হয়, মানুষ বসবাসও করে এমন যান্ত্রিক শীতল ঘরে। একসময় বটগাছের নিচেই চলত এসব কর্মকান্ড।
কিছুকাল আগেও এই উপমহাদেশে বটবৃক্ষ মানেই জনপদ। নতুন সড়কের দুপাশে, খেলার মাঠের একদিকে, হাটবাজারে, পুকুরপাড়ে, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, এমনকি আদালত চত্বরেও সেগুলোর দেখা মিলত। এই গাছ বহু শতবর্ষজীবী হওয়ায় তার অস্তিত্ব এসব স্থানে প্রায়শ চোখে পড়ে। আবার কোথাও কোথাও পুরোনো বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে ছোট পরিসরে গড়ে উঠতে দেখা গেছে জনবসতি, মেলা, ব্যবসায় এবং অন্যান্য উদ্যোগ। বাংলাদেশ ও ভারতে বটগাছকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পবিত্র মনে করে। তাই এই উদ্ভিদের নিচে মন্দির ও মূর্তি স্থাপন করা হয়।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে বটগাছ কাটা নিষিদ্ধ। ভারতে এটি জাতীয় বৃক্ষ। সনাতন ধর্মে এই উদ্ভিদের পাতাকে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্রামের উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। বৌদ্ধধর্মে এই গাছের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে। গৌতম বুদ্ধ বটবৃক্ষের নিচে বসে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ভারত উপমহাদেশেও অনেক ঋষি-সন্ন্যাসী, পীর-দরবেশ এর ছায়ায় আস্তানা গেড়েছেন। বাংলাদেশে অনেক অলি-আউলিয়ার কবর ও মাজার রয়েছে এই মহীরুহের নিচে।
যদিও বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে নানা প্রজাতির গাছের সঙ্গে এগুলো কেটে ফেলাও একটি সাধারণ ঘটনা। এ কারণে অনেক মহীরুহই এখন বিলুপ্তপ্রায়।
শোনা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে সুলতান শেরশাহের নির্মিত সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের দুপাশে অসংখ্য বটগাছ রোপণ করা হয়েছিল। এখন থেকে সুদূর সিন্ধু নদ পর্যন্ত দীর্ঘ এই সড়ক। পথচারীদের বিশ্রামের উদ্দেশ্যে এমন চিরহরিৎ, শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত বৃক্ষ রোপিত হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও পরবর্তীকালে দেশভাগ, নদীভাঙন ইত্যাদি কারণে এই রোডের দৈর্ঘ্য কমে আসে। কেটে ফেলা হয় ছায়াদানকারী সেসব গাছের অধিকাংশই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কয়েকটি বটবৃক্ষের পরিচয় দেওয়া হলো :
কালীগঞ্জ
১৯৮৪ সালে বিবিসির জরিপ অনুযায়ী এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষ এখানে। গ্রামের নাম বেথুলি হলেও সুইতলা মল্লিকপুর নামেই বেশি পরিচিত। কালীগঞ্জ শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলি মৌজায় অবস্থিত। তবে অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত, এমনকি কিংবদন্তিও। কেউ বলে সুইতলা বটগাছ, কারও মতে মল্লিকপুরের, আবার অনেকের কাছে এই মহীরুহ বেথুলির বলে পরিচিত। এখন এটি প্রায় ১১ একরজুড়ে ছড়িয়ে আছে। উচ্চতা ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। এখন এটি ৫২টি গাছের সমষ্টি।
বেথুলি গ্রামে একসময় ছিল কুমার সম্প্রদায়ের বাস। পানির জন্য তখন ব্যবহৃত হতো পাতকুয়া। সেন বংশীয় কুমার পরিবারের কোনো একজনের পাতকুয়ার পাড়ে একটি গাছ জন্মায়। সেটিই এই বটবৃক্ষ। কারও মতে, এটি ৩০০ বছর আগের কথা, কেউ বলে ৪০০ বা তারও বেশি প্রাচীন এই কিংবদন্তি।
জানা যায়, এই জমির মালিক ছিলেন রায় গ্রামের জোতদার নগেন সেনের স্ত্রী শৈলবালা সেন। পরে এটি খাস হয়ে যায়। ২০০৯ সাল থেকে যশোরের সামাজিক বন বিভাগ বটগাছটির রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে রেস্টহাউস। আগে এখানে তিথি মেনে পাঁঠা বলি হতো। সেসব রীতি অনুযায়ী বটগাছের নিচে কালীপূজার একটি স্থায়ী আসন স্থাপিত হয়েছে। বিবিসি সংবাদের পর এটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে বছরজুড়ে। বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষের দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলকাকলি আর ছায়াশীতল পরিবেশ শুধু স্থানীয়দেরই নয়, মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদেরও।
রূপগঞ্জ
অনেকের মতে, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের হিরনালের বটগাছ। উদ্ভিদটির বয়স নিয়েও আছে নানা মত। কেউ মনে করে ৪০০ বছর, কারও ধারণা ৫০০ বছরের বেশি। এই এলাকার কুলাদি মৌজায় অবস্থিত গাছটি এক একরজুড়ে বিস্তৃত এবং হিরনাল বাগবাড়ি বটগাছ নামে পরিচিত।
জনশ্রুতি আছে, জমির মালিক ছিলেন ৩৬০ আউলিয়ার একজন আল হাদী (র.)। তিনি ঢাকাস্থ মিরপুরের শাহ আলীর (র.) বড় ভাই। পাঁচ শ বছর আগে তিনি এখানে বাস করতেন। পরে এটি খাস হয়ে যায়। একসময় এখানে তিথি অনুযায়ী পাঁঠা বলি হতো। এখন সেখানে কালীপূজার আসন স্থাপিত হয়েছে। কথিত আছে, তৎকালীন জমিদার রামরতন ব্যানার্জি হাতির শুঁড় দিয়ে বটগাছটি টেনে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।
সাইট্টা বটগাছ
ধামরাই উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের সাইট্টা গ্রামে দেবীদাস বংশের পূর্বপুরুষেরা বাস করতেন। তারা তাদের জমির ওপর একটি বট ও একটি পাকুড়গাছ রোপণ করেছিল। সনাতন ধর্মানুসারে তারা মনে করত, বটগাছটি মহিলা আর অন্যটি পুরুষ। শোনা যায়, এই বিশ্বাস থেকে তারা ঢাকঢোল বাজিয়ে, ব্রাহ্মণ ডেকে, বৈদিক মন্ত্র পড়ে, গ্রামবাসীকে ভোজন করিয়ে বৃক্ষ দুটির বিয়ে দেয়। এ কারণে স্থানীয় ব্যক্তিরা গাছ দুটিকে স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দিত।
জনশ্রুতি আছে, একবার গাছ দুটির নিচ দিয়ে ইট ভর্তি একটি ট্রাক যাওয়ার সময় ডালের সঙ্গে আটকে যায়। তখন চালক সেটি কেটে দিলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে প্রবীণ ব্যক্তিদের পরামর্শে বটবৃক্ষের নিচে কয়েক কেজি বাতাসা ও মোমবাতি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে সুস্থ হন। এ ছাড়া কার্তিক সরকার নামের এক কৃষকের জমিতে বটের ডাল ছড়িয়ে পড়লে তিনি সেটি কেটে দেন। তারপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তখন ওই কৃষক বটগাছের নিচে একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে পূজা দিলে সুস্থ হন। এ রকম অনেক জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে সাইট্টা বটবৃক্ষ ঘিরে। জানা যায়, এই ঘটনার পর কেউ আর এ গাছের ডাল কাটেনি। ফলে এখন সেটি ছড়িয়েছে প্রায় ৫ বিঘা জায়গাজুড়ে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, গাছ দুটি তাদের দেবতা। বৃক্ষের নিচে কালীমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে প্রতিবছর এই দেবীসহ সরস্বতী, বুড়ির পূজা এবং দশমী ও বাসন্তী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। পিচ ঢালা পথের দুপাশে ধান-গম-ভুট্টার ক্ষেত এবং ছায়াময় বটগাছ মিলে সত্যিকারের গ্রামীণ রূপবৈচিত্র্য চোখে পড়বে।
আনন্দনগর বাজার
ধামরাইয়ের আনন্দনগর বাজারের মাঝখানে রয়েছে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বটবৃক্ষ। এটিকে ঘিরেও ছড়িয়ে আছে নানান জনশ্রুতি। স্থানীয় কাইয়ুম ব্যাপারী জানান, তিনি গাছটির কথা শুনেছেন তার ঠাকুরদার কাছে। এখানে তখন ধু ধু মাঠ ছিল। দিনের বেলাতেও ছেলেমেয়েদের বটগাছটির নিচে যেতে দেওয়া হতো না। এখন সেখানে দেড় শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। বেড়েছে জনসমাগম। আগে সাপ্তাহিক হাট বসত, এখন সেটি স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে বন্ধ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখানে বিভিন্ন সময় পূজার আয়োজন করে। প্রতিবছর শীতকালে সাকরাইন মেলা বসে।
রমনার বটমূল
বাঙালির বর্ষবরণের সঙ্গে রমনার বটমূল অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে। উদ্যানটি প্রথম গড়ে ওঠে মোগল আমলে ১৬১০ সালে। পরে লন্ডনের কিউই গার্ডেনের কর্মী প্রাউডলক ১৯০৮ সালে এটিকে নতুন করে নির্মাণের দায়িত্ব নেন। ধরে নেওয়া যায়, রমনার বটবৃক্ষের বয়স এক শ বছরের বেশি। এর শীতল ছায়ায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের সূচনা হয় ১৯৬৭ সাল থেকে। আজ তা বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এ ছাড়া বলতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার কথা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ দেশের প্রায় সব কটি রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা হয়েছে এখান থেকে।
বটবৃক্ষ বিশালতা, ঐশ্বর্য, সম্মোহন, আশ্রয়, শক্তি, সাহস ও শীতলতার প্রতীক। লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের লোগোতে বিশ্বের সব দেশ ও মহাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন দশটি গাছের পাতা স্থান পেয়েছে। সেখানে এশিয়া মহাদেশের স্মারক হিসেবে রয়েছে বটপাতা।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top