skip to Main Content

ফিচার I সনাতনী খাদ্যকর

প্রাচীন ভারতের সামাজিক বিন্যাসে খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবসার বিশেষ এক ভূমিকা ছিল। তাতেই গড়ে উঠেছিল বর্ণভিত্তিক বিভিন্ন শ্রেণি

বর্ণপ্রথায় পেশা ও পদবির বন্ধন ছিল অবিচ্ছেদ্য। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী ব্রাহ্মণ ছাড়া বাংলাদেশে অন্য যত বর্ণ—সবই সংকর। পুরাণমতে, তারা মূলত চতুর্বর্ণের পারস্পরিক যৌনমিলনে জন্ম নেওয়া মিশ্রবর্ণের মানুষ এবং শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। ব্রাহ্মণেরা শূদ্রসংকর উপবর্ণগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছিল। তারপর তাদের সামাজিক মর্যাদা ও পেশা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল তারা। যে তিন বিভাগে বর্ণ ভাগাভাগি হয়েছে সেগুলো হলো: উত্তম-সংকর, মধ্যম-সংকর ও অধম-সংকর বা অন্ত্যজ। এই তিন পর্যায়ে মোট ৩৬টি জাতের কথা বলা হলেও পরে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৪১টি জাত। যাদের পেশা ভিন্ন। তা ছাড়া যুক্ত হয়েছে ‘ম্লেচ্ছ’ শ্রেণি। আবার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সব সংকর বা মিশ্র উপবর্ণগুলোকে ‘সৎশূদ্র’ ও ‘অসৎশূদ্র’—এই দুটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এসব জাতের কয়েকটি খাদ্য উৎপাদন কিংবা খাবার বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের নিয়েই এখানকার আলোচনা।
উত্তম-সংকর পর্যায়ে যে ২০টি উপবর্ণ রয়েছে, তাদের মধ্যে তৈলিক, দাস, বারজীবী, মোদক ও তাম্বলীরা খাদ্য উৎপাদন কিংবা বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। তৈলিকদেরকে তৌলিকও বলা হয়। তৎকালে এরা গুবাক ব্যবসায়ী ছিল। মানে সুপারির কারবারি। দাস বলতে বোঝায় কৃষকদেরকে। বারজীবীদের আরেক নাম বারই। তারা পান চাষ করত। তবে বিক্রি করত না। যারা বেচত তাদের বর্ণ ছিল তাম্বলী। তামলী নামেও ডাকা হতো। তারাও উত্তম সংকর বর্ণেরই। তা ছাড়া এ বর্ণে আছে মোদক। তাদের কাজ দুধ দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি করা। এই বর্ণের লোকেরা ময়রা নামেও পরিচিত। সনাতন রীতিনীতির সঙ্গে দুধের যোগ থাকায় ময়রা পেশাকে পবিত্র ভাবা হয়। তাই এরা উত্তম সংকর। এমনকি ব্রাহ্মণেরাও তাদের ছোঁয়া ‘অন্ন’ ও ‘জল’ গ্রহণ করতেন।
এরপরেই আসে মধ্যম-সংকর। এই পর্যায়ে আছে ১২টি উপবর্ণ। যাদের মধ্যে আভীর, তৈলকার ও ধীবর বর্ণের লোকেরা খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। তারা মূলত গরু লালন-পালন করেন। হিন্দু সমাজে তারা সদগোপ নামে পরিচিত। তাদের জীবিকা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বিক্রি করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ময়রা ও মোদকেরা দুগ্ধজাত খাদ্য তৈরি করত। কিন্তু গোয়ালাদের কাজ তা বিক্রি করা। এই বর্ণের লোকেদের আদি নিবাস ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে। মহাভারতের সময়ে তাদেরকে গোপালা কিংবা আহীর নামেও ডাকা হতো। এ বর্ণে আছে তৈলকার বা তেলি। বর্তমানে তারা কলু নামেও পরিচিত। অনেকের মতে সাঁওতালি ‘কুলহু’ থেকেই কলুর উৎপত্তি। এই জাতির লোকেরা তেলবীজ পিষে তেল তৈরি করে। প্রাচীনে তারাই তৈলকার বর্ণের মধ্যম-সংকর জাতি ছিল। এ ছাড়া এ বর্ণে আছে ধীবর। যারা মূলত মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদেরকে কৈবর্ত, জালিক, জেলে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। যদিও বৃহদ্ধর্মপুরাণে মধ্যম-সংকরে ধীবর ও জালিককে ভিন্ন বর্ণের দেখানো হয়েছে। তবে পেশায় তারা একই।
এরপর আসে অধম-সংকর বা অন্ত্যজ। এখানে ৯টি বর্ণ রয়েছে। কিন্তু কেউই খাদ্য উৎপাদন কিংবা বিপণনের সঙ্গে যুক্ত নয়। এবার আসা যাক ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বর্ণ-বিন্যাসে। এখানে সৎশূদ্র বর্ণে ঠাঁই পেয়েছে মোদক ও তাম্বুলী। বৃহদ্ধর্মপুরাণ মতে, এরা হলো উত্তম-সংকর। এদের পেশা বিষয়ে ওপরেই আলোচনা হয়েছে। ‘অসৎশূদ্র’ বর্ণে আছে তীবর, তৈলকার, শুঁড়ি, মাংসচ্ছেদ ও কৈবর্ত। তীবর বলতে জেলেদেরকেই বোঝায়। কৈবর্তও তা-ই। তবু এই দুটি বর্ণকে আলাদা দেখানো হয়েছে। কারণ, কৈবর্ত বলতে কলিকালের জেলেদের বোঝায়। তৈলকারও এই বিভাগের বর্ণ। আছে শুঁড়ি। এই বর্ণের লোকেদের কাজ হলো মদ বিপণন। এ ছাড়াও আছে মাংসচ্ছেদ। এ বর্ণের লোকেরা মূলত কসাইবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করে।
এখানে যা বলা হলো, তা ছিল বর্ণপ্রথার রমরমা দশায় বিভিন্ন বর্ণের মানুষের পেশার বর্ণনা। এখন এসব পদবির সঙ্গে পেশার যোগসূত্র আর নেই বললেই চলে।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top