skip to Main Content

স্বাদশেকড় I আলুভাজা মুচমুচে

রাগ থেকে ভালো কিছুও হতে পারে। তা না থাকলে আজ হয়তো মানুষ পটেটো চিপসের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতো। খাদ্যটির উৎপত্তিস্থল নিয়ে রয়েছে মিথ

১৮৫৩ সাল। নিউইয়র্কের ছোট শহর সারাটোগায় গ্রীষ্মের দহন। সেখানকার মুনস লেক হাউস নামের একটি রেস্তোরাঁর রসুইকর ছিলেন জর্জ ক্রাম। প্রতিদিনকার মতো সরাইখানায় আসা অতিথিদের তুষ্ট করায় ব্যস্ত তিনি। সেদিন হুট করে রেস্তোরাঁয় চলে আসেন শহরের এক ধনকুবের। নাম কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট। ঢুকেই খেতে চাইলেন আলুভাজা। সময়মতো থালা চলেও এলো। কিন্তু ধনী মানুষ বলে কথা! ভাজা পছন্দ হলো না। অভিযোগ করলেন, আলু বেশি মোটা করে কাটা হয়েছে। তাই জর্জ ক্রাম আরেক থালা আলুভাজা আনলেন তার সামনে। এবারের আলুগুলো আরেকটু পাতলা করে কাটা ছিল। কিন্তু এবারও তা প্রত্যাখ্যান করলেন অতিথি ভ্যান্ডারবিল্ট। এতে কিছুটা রাগ হলো রসুইকর ক্রামের। তবে সেই রাগ অতিথির ওপর না ঝেড়ে বইয়ে দিলেন আলুর ওপরে। ভীষণ পাতলা করে কেটে তেলে ভাজা করলেন আলুগুলো। তাতে লবণ ছিটিয়ে পরিবেশন করলেন অতিথির টেবিলে। অবশেষে তুষ্ট হলেন ভ্যান্ডারবিল্ট। শোনা যায়, স্বাদে তিনি এতই মোহিত হয়েছিলেন যে গোগ্রাসে পাতলা আলুভাজাগুলো সাবাড় করে ফেলেছিলেন। ধারণা করা হয়, সেটিই ছিল পটেটো চিপসের উৎপত্তির লগ্ন। রাগের ফলাফলে তৈরি হলো মুখরোচক এই পদ।
পটোটো চিপস উদ্বোধনে এই ঘটনা ইতিহাস নয়, বরং মিথ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনার সত্যতা নিরূপণ করা যায় না দুটি কারণে। প্রথমত, ১৮৫৩ সালের গ্রীষ্মে কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন না। ওই সময় সারাটোগায় এ ধরনের আলুভাজা নতুন কোনো পদ ছিল না। এর প্রায় চার বছর আগে এলিজা নামের এক বাবুর্চির তৈরি একই ধরনের আলুভাজার ভূয়সী প্রশংসা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিউইয়র্ক হেরাল্ড’ পত্রিকায়। এলিজাও ছিলেন সারাটোগার বাসিন্দা।
জর্জ ক্রামের যে মিথ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তা চাউর হয় মূলত ১৮৮৫ সালে। মানে, এই গল্প প্রচারের ৩৬ বছর আগেও আলুর চিপসের অস্তিত্ব ছিল। তবে মিথে কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্টের জায়গায় আলবিট হুইনি নামে এক কৃষককেও স্থান দেওয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। ধারণা করা হয়, জর্জ ক্রামের রেস্তোরাঁয় ধনকুবের ভ্যান্ডারবিল্ট নন, বরং কৃষক আলবিট হুইনি অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনাটি মিথ হলেও আলুর চিপসের জনপ্রিয়তা বাড়াতে জর্জ ক্রামের অবদান ব্যাপক। পাতলা করে কাটা আলুর পদটি সারাটোগা চিপস হিসেবে পরিচিতি পায় তারই বদৌলতে। ১৮৬০ সালে খোলা তার নিজের রেস্তোরাঁর সবচেয়ে আকর্ষণীয় পদটি ছিল এই চিপস।
১৮২৪ সালে জন্ম নেওয়া জর্জ ক্রাম প্রথম জীবনে শিকারি ও পর্যটকদের গাইড ছিলেন। শেষে হয়ে যান শেফ। এই পেশাতেই থিতু হন। ১৮৫০ সালে যোগ দেন মুনস লেক হাউসে। এরপর চিপস আবিষ্কারের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ১৮৬০ সালে মাল্টায় রেস্তোরাঁ খুলে বসেন। সেখানকার প্রতিটি টেবিলেই অ্যাপেটাইজার হিসেবে রাখা হতো পটেটো চিপস। নিউইয়র্কের আশপাশেই তার চিপসের প্রচার ও প্রসার ছিল। ১৮৯০ সালে তার রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি মারা যান ১৯১৪ সালে। তবে তিনি চিপস আবিষ্কারক হিসেবে কোনো পেটেন্ট আবেদন করেননি। এমনকি জীবদ্দশায় তার বক্তব্যে এবং ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত হওয়া আত্মজীবনীতেও চিপস আবিষ্কারের বিষয়ে বলেননি কিছুই।
আবিষ্কারক হিসেবে জর্জ ক্রামকে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও খাদ্যটিকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে তার অবদান কেউ অস্বীকার করে না। চিপস আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তার বোন ক্যাথরিন আন্ট কেট উইকের নামও। বিভিন্ন সূত্রে উইককেও চিপসের জনক হিসেবে দাবি করা হয়। এমনকি উইক নিজেও সেই দাবি করেছিলেন। দৈনিক সারাটোগান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ১৯২৪ সালে উইককেই সারাটোগা চিপসের উদ্ভাবক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেই দাবির পক্ষে উইকের বক্তব্য ছিল, তিনি আলু পাতলা করে কেটে রেখেছিলেন। দুর্ঘটনাক্রমে তা ভাজার কড়াইয়ে পড়ে। তিনি তার ভাই ক্রামকে সেটির স্বাদ নিতে অনুরোধ করেন। সুস্বাদু হওয়ায় সেটি রেস্তোরাঁর অতিথিদের সামনে পরিবেশনের সিদ্ধান্ত হয়। শুধু ক্রামের বোন উইকই নন, মুনস লেক হাউসের মালিক ক্যারি মুনও আলুর চিপসের জনক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
পটেটো চিপস উদ্ভাবন নিয়ে আরেকটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। স্বাস্থ্যরক্ষাকারী খাদ্য হিসেবেই নাকি এই পদের উদ্ভব। ১৮১৭ সালে ব্রিটিশ ডাক্তার উইলিয়াম কিচিনার ‘দ্য কুক’স ওরাকল’ নামে একটি বই লেখেন। ১৮২২ সালে সেটির নতুন সংস্করণ বেরোয়। সেখানে পটেটো চিপসের বর্ণনা মেলে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমে আলুর খোসা ছাড়াতে হবে। সেগুলো এমনভাবে কাটতে হবে যেভাবে একটি লেবুর খোসা ছাড়ানো হয়। টুকরাগুলো তেলে ঠিকঠাকভাবে ভাজতে হবে। মচমচে হয়ে এলে ওপরে লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে।’ এই রেসিপিতে কোয়ার্টার ইঞ্চি পুরু করে আলু ফালি করার কথা বলা হয়েছে। ভাজতে বলা হয়েছে শূকর কিংবা গরুর চর্বিতে।
যাহোক, সারাটোগার জর্জ ক্রাম ছাড়াও পটেটো চিপসের প্রচার ও প্রসারে আরও কজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৯৫ সালে উইলিয়াম ট্যাপেন্ডন নামে এক ব্যক্তি নিজের কিচেনে আলুর চিপস বানানো শুরু করেন। তিনি তা যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ডের আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করতেন। বিভিন্ন মুদিদোকানেও মিলত তার চিপস। ১৯২১ সালে এই খাবারের ব্যবসা শুরু করেন বিল ও স্যালি উর্টজ দম্পতি। ঘণ্টায় ৫০ পাউন্ড চিপস তৈরি করতেন তারা। ‘হ্যানোভার হোম ব্র্যান্ড পটেটো চিপস’ নামে সেগুলো অল্প সময়েই আশপাশের অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। চাহিদা এতই বেড়ে যায়, ১৯৩৮ সালে ঘণ্টায় ৩০০ পাউন্ড চিপস তৈরি করতে হতো তাদের।
১৯২০ সালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার লারা স্কুডার নামে এক উদ্যোক্তা আলুভাজাকে প্যাকেট করে বিক্রি শুরু করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি মোম কাগজ ব্যবহার করতেন। আলুর চিপসে বিভিন্ন ফ্লেভার যোগ হতে থাকে ১৯৫৪ সালে আইরিশ ব্যবসায়ী জয় স্টুড মারফির মাধ্যমে। তিনি ‘টাইটো’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেছিলেন। তিনিই চিপসের সিজনিং চালু করেছিলেন। সিজনিংয়ে ব্যবহৃত হতো লবণ, ভেষজ বা মসলা, চিজ, অনিয়ন, ভিনেগার ইত্যাদি।
এই হলো পটেটো চিপসের সংক্ষিপ্ত উৎপত্তির ইতিহাস। খাবারটিকে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে একে ‘ক্রিস্প’ বলা হয় আর উত্তর নিউজিল্যান্ডে ‘চিপিস’।

 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top