skip to Main Content

ফিচার I সম্পর্ক সযতন

কোনোমতে চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপার নয়, বরং ঠিকঠাক যত্ন না পেলে জং ধরে যেতে পারে সম্পর্কে

প্রায় পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্যজীবন আজমল হোসেন ও আয়েশা আক্তারের (ছদ্মনাম)। পাঁচ দশকের এই পথচলায় কখনো মনোমালিন্য হয়নি, তা কিন্তু নয়। কখনো ঝগড়া, কখনো মতের অমিল, কখনো পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবে কুঁকড়ে থাকা—এভাবে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু চড়াই-উতরাই। কিন্তু এতসবের পরেও কেন হাত ছাড়েননি দুজন? কী এমন সুতোয় গাঁথা তাদের সম্পর্কটা? ‘একে অপরকে জানতে হয়, বুঝতে হয়, সম্মান করতে হয়। একে অপরের চাওয়া-পাওয়াগুলো গুরুত্ব দিতে হয়। আমি জানি না ভালোবাসা কী, শুধু জানি এই মানুষটাকে আমার যত্ন করতে হবে,’ বলছিলেন সত্তর বছর বয়সী আজমল হোসেন। সত্যিই তো তাই! যে মানুষটার সঙ্গে আছি, সে যদি ভালো না থাকে, তবে সম্পর্কটা ভালো থাকবে কী করে?
কিন্তু ইট-পাথরের এই ব্যস্ত শহরে যেখানে দম ফেলাই দায়, সেখানে একে অপরের যত্ন নেওয়ার সময় কই! অনেকে ভাবেন সংসার, সন্তান, চাকরি সামলে নিজেদের নিয়ে ভাবাটাই যেন আদিখ্যেতা। আবার অনেকের ভাবনা, পরিবারের জন্য এত কিছু করি তা তো ভালোবাসি বলেই, আলাদা করে ‘ভালোবাসি’ কেনই-বা বলতে হবে! আসলে ভালোবাসাটা প্রকাশের জন্য মুখে উচ্চারণের প্রয়োজন পড়ে না; বরং ছোট ছোট কাজ, ছোট ছোট কথার মাধ্যমেই প্রকাশ করা যায় সঙ্গীকে কতটা ভালোবাসি। একে অপরের প্রতি ভালোবাসার এই বহিঃপ্রকাশও সম্পর্কের যত্ন নেওয়ার একটি মাধ্যম। আপনার ঘরের এক কোণে রাখা গাছটি যেমন যত্নের অভাবে নেতিয়ে পড়ে, তেমনি সম্পর্কের যত্নআত্তি না করলে তা হয়ে পড়ে নির্জীব।
একটি সুন্দর, সাবলীল সম্পর্কের মূলমন্ত্র হলো একে-অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। প্রত্যেক মানুষের আলাদা সত্তা আছে, আলাদা একটা মনন আছে। এমনই দুটি আলাদা মানুষ এক ছাদের নিচে থাকতে গেলে মতের অমিল হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে সম্পর্কে তিক্ততা আসতে দেওয়া বুদ্ধিমত্তার কাজ নয়। কোনো বিষয়ে দুজনের চিন্তাধারা না মিললে তা নিয়ে বসে কথা বলুন। সঙ্গীকে বুঝিয়ে বলুন আপনার কথা, বা তার কথার সঙ্গে আপনি কেন সহমত নন। কিন্তু কখনোই যেন তাতে তিরস্কারের সুর না থাকে।
সুন্দর একটি সম্পর্কের পরিচর্যায় প্রয়োজন সময় ও ধৈর্য। চাকরি, ঘরদোর সামলে দিনের একটা সময় শুধু নিজেদের জন্য বরাদ্দ রাখুন। জগতের বাকি সব চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে একান্তে কিছু সময় কাটান। দিন যতই যাচ্ছে, আমরা হয়ে পড়ছি আরও ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার জাঁতাকল থেকে বেরিয়েই কিছুটা সময় না হয় থাকুক নিজেদের। হয়তো একসঙ্গে কফি খাওয়া, নয়তো বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করা—এ রকম ছোট ছোট মুহূর্তই হতে পারে একে অপরকে গভীরভাবে জানার এক যথার্থ মাধ্যম। যান্ত্রিক জীবনে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বদৌলতে যতই কথা হোক না কেন, পাশে বসে সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানোকে তা টেক্কা দিতে পারবে না কখনোই। অবসর সময়ে মুঠোফোনে সময় ব্যয় না করে সামনে থাকা মানুষটার সঙ্গে সময়টা কাটান। মানুষটাকে বোঝান, বয়স বাড়লেও ভালোবাসাটা কমেনি।
একটি সম্পর্কে, বিশেষ করে দাম্পত্যজীবনে সংকট থাকবেই। অনেক সময় এই সম্পর্কের ওপর আসতে পারে হতাশাও। কিন্তু তাই বলে দমে গেলে চলবে না। অনেকের ধারণা, কাউকে ভালোবাসা মানে সেই মানুষটার সবদিক সমানভাবে ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসা কি আসলেই তাই? একজনকে ভালোবাসতে হলে কি তার মন্দ দিকটাকেও ভালোবাসতে হবে? এর উত্তর মিলবে এস্থার পেরেলের কাছে। প্রায় ২০ বছর ধরে সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন বেলজিয়ান এই সাইকোথেরাপিস্ট। তার মতে, একজন মানুষকে ভালোবাসতে হলে তার সবদিকই ভালোবাসতে হবে—এমনটা নয়। যে সম্পর্কগুলো নিঃশর্ত নয়, সেগুলোই বরং তার কাছে রোমাঞ্চকর প্রেমের একটি বাস্তবসম্মত রূপ। এস্থার বলেন, ‘আমাদের ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও আমরা যেমন নিজেদেরকে গুরুত্ব দিই, ভালোবাসি; একটা ত্রুটিপূর্ণ সম্পর্কের বেলায়ও কি তা করতে পারি না?’
সম্পর্ক বিকাশের জন্য এর প্রতি মনোযোগী হওয়ার গুরুত্বের সীমা নেই। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা দেখা দিলেই কেবল সম্পর্কটাতে সময় দিই। একবার সেসব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে আমরা আবার নিজেদের ক্যারিয়ার বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু একটা সম্পর্ক সুন্দরভাবে চলতে প্রয়োজন সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ও মনোযোগ। ব্যস্ত এই জীবনে সহজেই তা করা সম্ভব। স্মরণে আনুন প্রথম তাকে দেখার স্মৃতি। প্রেমের কিংবা বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে যেভাবে কথা বলতেন দুজনে, যেভাবে একে-অপরের দিকে তাকাতেন, সেই প্রাণময়তা ধরে রাখুন আজীবন। সঙ্গীর বয়স বাড়লেও সে কিন্তু সেই একই মানুষ রয়ে গেছে এখনো। তাই সতেজ রাখুন অনুভূতিগুলো।
নিজেদের মধ্যে যথাসাধ্য সহজ-সাবলীল যোগাযোগ ধরে রাখুন। আপনার যা প্রয়োজন, তা সঙ্গীকে সর্বদাই খুলে বলার করুন চেষ্টা। অনেক বছর ধরে একসঙ্গে থাকার পর এমন হতেই পারে, আপনারা একে অপরের অনেক না-বলা-কথা বুঝে নিতে পারেন; কিন্তু তা সব সময় কার্যকর নয়। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। পাঁচ বছর আগে আপনি যা চাইতেন, পাঁচ বছর পর তা না-ও চাইতে পারেন। সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা ও স্পষ্টবাদী না হলে উদ্রেক ঘটতে পারে বিভ্রান্তির; যা থেকে তৈরি কোনো ছোট ঘটনার ভুল-বোঝাবুঝিতে সম্পর্ক ভাঙনের দিকেও গড়াতে পারে। তাই স্পষ্টবাদী হোন, সঙ্গীকেও স্পষ্টবাদী হতে জোগান প্রেরণা। সঙ্গীর সামনে পরিণত হোন একটি খোলা বইয়ের মতো। সেই সঙ্গে তাকেও সুযোগ দিন নিজেকে মেলে ধরার। এতে একে অপরের অবস্থান বোঝাও হবে সহজ।
রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন যথাসম্ভব। ‘রাগের মাথায় বলা কোনো কথা কিন্তু সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে সহজেই। পরে যতই অনুশোচনা করুন, সেই ফাটলের আকার ধীরে ধীরে এমন রূপ নিতে পারে, যা মেরামতের আর সুযোগ থাকবে না,’ কথাগুলো বলছিলেন সদ্য বিবাহিত মেহজাবিন (ছদ্মনাম)। দীর্ঘ ৮ বছরের প্রেমকে এই তো কয়েক মাস আগেই পরিণত এক রূপ দিয়েছেন তিনি। এত বছর ধরে সুস্থ সম্পর্ক ধরে রাখার রহস্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমরা দুজনই নিজেদের একটা আলাদা সময় দিই। নিজেরা আগে শান্ত হয়ে তবেই একে অপরের সঙ্গে কথা বলি। অনেক সময় এমন হয় যে অফিসের কোনো কাজ বা বাড়ি ফেরার পথের কোনো ঘটনায় মন-মেজাজ ভালো থাকে না। এমন অবস্থায় বাড়ি ফিরেই যদি আমরা একে অপরের সাথে কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে সেই রাগটা অজান্তেই সঙ্গীর ওপর ঝাড়ছি।’ নিজেদেরকে সব সময় একটা আলাদা সত্তা হিসেবে সম্মান দেন বলেও জানালেন তিনি। মেহজাবিনের ভাষ্যে, ‘দুজন আলাদা দুটি মানুষ। আমাদের মধ্যে ভিন্নতা থাকবে—এটা মেনে নিয়েই সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখছি।’
সম্পর্কের যত্ন নিতে একে অপরের সহযোগী হওয়াটাও কিন্তু জরুরি। যতটা সম্ভব সঙ্গীর সঙ্গে কাজ ভাগ করে নিন। এতে যেমন কমে আসবে কাজের চাপ, তেমনি সঙ্গীর মনেও পাবেন বিশেষ আস্থার জায়গা। স্বাভাবিকভাবে, বিবাহপূর্ব প্রেমের সম্পর্কের চেয়ে দাম্পত্যজীবনে জটিলতা একটু বেশি। বিশেষ করে পরিবারে সন্তানের আগমনের পর যেন যেকোনো একজনের ওপর কাজের চাপ বেড়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা ভালো। মা হওয়ার পর নারীর মধ্যে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি বাবা হওয়ার পর পুরুষের মাঝেও আসে আমূল বদল। জীবনের বিশেষ এই সময়টায় একে অপরের পাশে থাকুন। সঙ্গীকে বুঝতে দিন, আপনি আছেন তার পাশে। আমেরিকার স্যান ডিয়েগোতে অবস্থিত উইলিকনসন অ্যান্ড ফিঙ্কবেইনার ল’ফার্ম পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঘরের কাজ ও সন্তান পালনে স্বামী তেমন অবদান না রাখলে সেসব সম্পর্কে বিবাহবিচ্ছেদের হার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেশি! আমেরিকায় চালানো ১১৫টির বেশি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এ তথ্য দিয়েছে ফার্মটি। ধারণা করা যায়, আমাদের দেশে এই হার অপেক্ষাকৃত কম; তবু আপনি নিশ্চয় চাইবেন না শতকরার হিসাবে এই জংধরা সম্পর্কগুলোর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে?
একটা সম্পর্ক যেমন শুরু হয় দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, সেটির দারুণ বিকাশ ঘটানোর জন্য থাকা চাই দুজনেরই ভূমিকা। একজন সঙ্গী হওয়ার আগে মানুষটার বন্ধু হয়ে ওঠুন। দেখুন সে কী চায়। জানুন কিসে তার ভয়। একটা মানুষকে শুধু সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা না করে আলাদা এক সত্তা হিসেবে নিলে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ধরে রাখাও সহজ। সম্পর্কটা যেন কোনো প্রতিযোগিতা হয়ে না ওঠে। দুজন মানুষ একটি পারস্পরিক বন্ধুসুলভ সহাবস্থানে থাকতে পারে, তা-ই যেন হয় লক্ষ্য। আর ছোটখাটো ভুলভ্রান্তিতে অহেতুক ইগো না দেখিয়ে জেমসের মতো দরাজ গলায় গেয়ে উঠতেই তো পারেন—‘যদি কখনো ভুল হয়ে যায়/ তুমি অপরাধ নিয়ো না…!’

 সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top