skip to Main Content

মনোযতন I উৎকণ্ঠার উৎপাত

অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। অজান্তেই বাসা বাঁধা এক মারাত্মক মনোরোগ। চিনবেন কী করে? তাড়াবেন কোন উপায়ে? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

কত কাজ, ব্যস্ততা এখন আমাদের। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, অফিস, পরিবার, সাংসারিক, সামাজিক—কত দায়িত্ব ঘাড়ে। তাই কখনো কখনো আমাদের হাঁপিয়ে উঠতে দেখা যায়। তবু এসবে নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখেছি! যদিও কেউ কেউ আফসোস করে বলি, ‘নিজের জন্য যদি একটু সময় পেতাম; থাকতে পারতাম যদি একা!’ আনমনে যারা এমন কথা বলেন, তারা যদি কখনো একটু সময় বের করতে পারেন, ঠিকই সে সময়টুকু উপভোগ্য করে তোলেন। আপনি কি এই উপভোগকারীর দলে? নাকি একটু সময় বের করতে পারলে তা কেমন করে কাটাবেন—এই নিয়ে মনের ভেতর রাজ্যের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কাজ করে আপনার? এই উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তার কথা কাউকেই যে ঠিক বোঝানো যায় না! বরং আপনার আতঙ্ক, ভয়, অস্বস্তি, অস্থিরতা, গলা শুকিয়ে আসা, এমনকি বুক ধড়ফড় বাড়তে শুরু করে। নিজের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা উৎকণ্ঠা নামের দানব যেন আপনার টুঁটি চেপে ধরে! এই সব উদ্বেগ আপনাকে উপভোগ্য সময় থেকে তাড়িয়ে দূরে নিয়ে যায়। একেই বলে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার।
ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু সারা পৃথিবীতে হয়েছে বিস্তর গবেষণা। এখনো হচ্ছে। তবে মনকে আশ্বস্ত করার মতো চূড়ান্ত ফল উঠে আসেনি এখনো। অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের এই অনুভূতি মানুষের মনোজগতের এমন দুর্বল এক অবস্থা, যার মাধ্যমে যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। আক্রান্ত মানুষটির মনের সঙ্গে সঙ্গে তখন তা শরীরের জন্যও প্রচণ্ড ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি ডেকে আনতে পারে অকালমৃত্যু।
পরিচয়ের সন্ধান
অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার হলো উৎকণ্ঠাজনিত সমস্যা। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহিদ বলেন, ‘অ্যাংজাইটি বা উৎকণ্ঠা আমাদের নিত্যদিনের সমস্যা। যেকোনো বিষয়ে আমাদের একটু মানসিক চাপ বা উদ্বেগ হয়েই থাকে। আমরা বলি, এই উদ্বেগ না থাকলে পারফরম্যান্সই হয় না। মধ্যম মানের বা নির্দিষ্ট মাত্রার উৎকণ্ঠা থাকা যেকোনো কাজের জন্যই ভালো। উদ্বেগ একেবারে কম হলে আমাদের কোনো কাজেই আগ্রহ থাকবে না; কিছুই আমরা করতে চাইব না। ধরুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কাল আপনার ক্লাস আছে, সেখানে যেতে হবে—এই মানসিক চাপ যদি অনুভব না করেন, বা আপনার পরীক্ষা সামনে, আপনাকে পড়তে হবে—সেটি যদি মনে না করেন, ভেতরে ভেতরে একটু দুশ্চিন্তা যদি না থাকে, তাহলে আপনি হয়তো পড়তেই বসবেন না। তবে যদি উৎকণ্ঠার মাত্রাটা অতিরিক্ত হয়ে যায়, যতটুকু আপনার চিন্তা না করলেও চলবে, অস্থির না হলেও চলবে, তার চেয়ে অতিরিক্ত হয়ে যায়, আর সেটি দৈনন্দিন কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আপনার কাজে, অন্যের সঙ্গে মেলামেশায়, পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটায়, তাহলে আমরা বলব, এটি ডিজঅর্ডার বা ব্যাধির পর্যায়ে চলে গেছে।’
লক্ষণ দেখে চেনা
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে ভোগা একেক ব্যক্তির একেক রকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। মূলত সার্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে তা। তবু সাধারণ কিছু উপসর্গ কম-বেশি সবার মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। সেগুলো হচ্ছে—
 আতঙ্কিত, ভয়, অস্বস্তি লাগা এবং অস্থিরতা বোধ করা;
 বিপদ বা ভয়ংকর কিছুর শঙ্কায় থাকা;
 ঘুমের সমস্যা হওয়া, অর্থাৎ ঘুম কমে যাওয়া কিংবা বেড়ে যাওয়া;
 হাত-পায়ের তালু ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কিংবা ঘামা;
 গলা শুকিয়ে আসা এবং বুক ধড়ফড় করা;
 বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া;
 কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা;
 অতিরিক্ত ও নেতিবাচক চিন্তা করা;
 যেকোনো কিছু কিংবা যেকোনো স্থান সম্পর্কে অতিরিক্ত ভীতি কাজ করা;
 শ্বাসকষ্ট, কানে অবাঞ্ছিত শব্দ হওয়া ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে।
কারণ জানা
আগেই বলেছি, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার নিয়ে হয়েছে রাজ্যের গবেষণা। এখনো হচ্ছে। তবে এই মানসিক রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি। একই পরিস্থিতিতে একজনের হয়তো সমস্যা হচ্ছে না; কিন্তু আরেকজন ভুগছেন ভয়াবহ মানসিক চাপে। বৈজ্ঞানিকভাবে অ্যাংজাইটির জন্য দায়ী অ্যাড্রেলিন ও করটিসলের মতো হরমোন। এগুলোর নিঃসরণের সঠিক কারণও জানা যায়নি। তবে অ্যাংজাইটিতে ভোগার সাধারণ কিছু কারণে চোখ বুলিয়ে নিতে পারি—
 জেনেটিক: অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বংশপরম্পরায় হতে পারে। অ্যাংজাইটির ইতিহাসে ৩০ শতাংশের মতো মানুষের পরিবারে আগে থেকেই কেউ না কেউ এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
 ব্রেন কেমেস্ট্রি: গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের যে অংশগুলো ভয়, আবেগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, সেসব অংশের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ত্রুটির কারণেও স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি হতে পারে।
 নির্দিষ্ট ওষুধ: নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ অপব্যবহার বা অপরিমিত পরিমাণে গ্রহণের ফলে স্নায়ুচাপ থেকে অ্যাংজাইটিসহ অন্যান্য মানসিক রোগ হতে পারে।
 নেশাজাতীয় দ্রব্য: ধূমপান, মদ্যপানের মতো নেশা সব সময়ই মানুষের জন্য খারাপ কিছু বয়ে আনে। এসবের কারণে অ্যাংজাইটিও ঘটতে পারে। আবার হঠাৎ নেশা ছেড়ে দেওয়ার ফলে শরীরে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তার থেকেও এমনটি হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা হুট করে কোনো নেশা থেকে বেরিয়ে না এসে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসারে ছাড়তে বলেন।
 পারিপাশির্^কতা: এটি নির্দেশ করে আপনার সেই পরিস্থিতিকে, যেখানে যথেষ্ট উত্তেজিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো উপকরণ রয়েছে। যেমন অবহেলা, ঘৃণা, নিকটস্থ কারও মৃত্যু ইত্যাদি নেতিবাচক পরিস্থিতি। আবার চাকরি পাওয়া, সন্তান জন্মদান ইত্যাদি হলো ইতিবাচক পরিস্থিতি। এই দুটোই প্রভাব ফেলতে পারে।
 শারীরিক অবস্থা: নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক পরিস্থিতিতে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা, হরমোনাল ইমব্যালেন্স হলে সাধারণত মানুষের অ্যাংজাইটি হয়ে থাকে।
 অন্যান্য: এ ছাড়া পূর্ববর্তী কোনো মানসিক রোগ থাকা, যেমন—ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তার অ্যাংজাইটি হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। শৈশবের কোনো কষ্টদায়ক স্মৃতি, শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নিপীড়ন মানুষের মনে দাগ কেটে রাখে, যা পরবর্তীকালে অ্যাংজাইটিরূপে প্রকাশ পেতে পারে। দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভুগলে, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের প্রভাবে মানুষের মধ্যে অ্যাংজাইটি কাজ করে। অন্যদিকে, সাধারণত পারিবারিক কলহ থাকলে সন্তানের আত্মমর্যাদাবোধ কমে যায়। এই আত্মসম্মানবোধ বা কনফিডেন্স কম থাকার কারণেও কেউ কেউ অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারেন।
সমাধানের খোঁজ
ওপরের লক্ষণ ছাড়াও আরও নানা ধরনের অ্যাংজাইটি হয়ে থাকে, যা ব্যক্তিভেদে একেক রকম। তবে এর মধ্যে দু-তিনটি লক্ষণ দেখা দিলেই সতর্ক হতে হবে। এ-ও ঠিক, নির্দিষ্ট অ্যাংজাইটির জন্য নির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে, সে সম্পর্কে ধারণা থাকলে তা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা সাবধানে থাকা সম্ভব। চলুন, অধ্যাপক সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহিদের সঙ্গে সমাধানের পথ খুঁজি—
 সবার আগে আপনার অ্যাংজাইটির ধরন সম্পর্কে জানুন। কিসে বা কী কারণে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, সেই বিষয়ে অবগত থাকলে তা থেকে বিরত থাকা কিংবা সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে তৈরি রাখা সহজ।
 আপনার রিল্যাক্সেশন মেথড কী? সাধারণত ব্রিদিং এক্সারসাইজ, কাজের ফাঁকে ছোট ছোট বিরতিতে যাওয়া ইত্যাদি উপকারে আসে।
 নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করুন। চেষ্টা করুন প্রয়োজনে নিজের ওপর জোর খাটিয়েই নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে ইতিবাচক চিন্তার মধ্যে প্রতিস্থাপন করার। শুধু তা-ই নয়; একে অভ্যাসে পরিণত করুন।
 ব্যায়াম করুন। ধীরে হাঁটা নয়, ঘাম ঝরিয়ে দৌড়ানো বা সাঁতার কাটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি ভেতরের সংকোচ ভেঙে দেয়।
 যেকোনো সমস্যার কথা কাছের কিংবা বিশ্বাসযোগ্য কারও সঙ্গে শেয়ার করুন; অথবা বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
অ্যাংজাইটি নিয়ে দৈনন্দিন জীবনযাপন খুবই কষ্টের। কেননা, প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা কিংবা উৎকণ্ঠা নিয়ে বেঁচে থাকা সহজ নয়। তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। যদি অ্যাংজাইটি উপসর্গ থাকে, তাহলে চিকিৎসক শুরুতেই শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। শারীরিক কোনো সমস্যা থেকে অ্যাংজাইটি না হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রচলিত পদ্ধতিতে এর ধরন বের করে চিকিৎসা করবেন। সঠিক ও সম্পূর্ণ চিকিৎসা এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। চাইলে অনলাইনেও কোনো মনোরোগবিদের সঙ্গে কথা বলে সেশন নিতে পারেন।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top