skip to Main Content

যাপনচিত্র I স্বস্তিই সব

আরিফিন শুভ। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা। এ প্রজন্মের দাপুটে প্রতিনিধি। কেমন তার একান্ত জীবন?

প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়। তবু প্রতিদিন সকালে একটা নিয়ম তিনি ঠিকঠাক মেনে চলেন, অনেকটা অলিখিত রিচুয়ালের মতো। তা হলো, ঘুম ভাঙতেই দরজা খুলে ঢুকে পড়েন মায়ের রুমে। মায়ের সঙ্গে দেখা করেই দিন শুরু হয় তার। বললেন, ‘মা একটু অসুস্থ। আমার রুমের দরজা খোলার শব্দটা হওয়ামাত্রই তিনি আশা করেন, তার সঙ্গে দেখা হবে। তাই ঘুম ঘুম চোখে মায়ের রুমে যাই। অন্যথায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েন: “শুভ উঠল, আমার সঙ্গে এখনো দেখা করেনি।”’
এরপর ব্রেকফার্স্ট। তাতে খাদ্য বলতে শুধুই ওটস। এটা তার নিত্যদিনের রুটিন। তারপর ফ্রেশ হয়ে, শুট বা কাজ না থাকলে রেডি হয়ে চলে যান জিমে। আরিফিন শুভ জানালেন, শুট না থাকলে সাধারণত একটু দেরি করে, ১০-১১টার দিকে ঘুম ভাঙে তার। এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন, ‘যেহেতু ১১টার আগে আমার জিম খোলে না, সে কারণে হয়তো সাইকোলজিক্যাল বিষয় যে, আমি ওই সময় অনুযায়ীই ঘুম থেকে উঠি।’
জিমে মূলত কার্ডিও বেসড ওয়ার্কআউট করেন। তবে ওয়ার্কআউট সাধারণত নির্ভর করে, তিনি কোন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছেন, সেটার ওপর। ক্যারেক্টার অনুযায়ীই নিজেকে শারীরিকভাবে প্রস্তুত করেন এই স্বাস্থ্যসচেতন অভিনেতা। এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আমরা দেখতে পাব তার অভিনীত চরিত্রগুলোর দিকে তাকালে।
শুট না থাকলেও যে সারা দিন একদম ফ্রি থাকেন, এমনটা সচরাচর ঘটে না। হয়তো কোনো মিটিং কিংবা অন্য কোনো কাজ থাকে। সে ক্ষেত্রে সকালে প্রস্তুতি নিয়েই বাসা থেকে বের হন, যেন জিম শেষ করে সরাসরি ওই পূর্বনির্ধারিত মিটিং বা কাজে চলে যেতে পারেন। অন্যথায়, বিরল হলেও, যদি সারা দিনের মতো ফ্রি থাকেন, তাহলে জিম থেকে সরাসরি ফিরে আসেন বাসায়, বেলা দেড়টা-দুইটার দিকে। তারপর পরিবারের সঙ্গে সারেন মধ্যাহ্নভোজ। যদি খুব স্ট্রিক্ট ডায়েটে না থাকা হয়, তাহলে তার দুপুরের তালিকায় সাধারণত নরমাল খাবারই থাকে—মাছ, সবজি, ডাল, ভাত…প্রভৃতি।
ফ্রি থাকলে দুপুরের খাওয়া ও গোসল শেষে একটু ভাতঘুম দিয়ে নেন শুভ। বললেন, ‘ভাতঘুম মানে, একটা কিছু দেখতে দেখতে চোখটা হয়তো লেগে যায়।’ আর বিকেলটা? এমন দিনে বিকেলে বাড়ির লোকদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতেই ভালোবাসেন এ অভিনেতা। কখনো কখনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডাবাজিও করেন। বন্ধু প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমার খুব একটা নতুন বন্ধু নেই। যারা আছে, বেশ পুরোনো বন্ধু। পরিচিত তো প্রচুর; কিন্তু বন্ধু খুবই লিমিটেড। আমি বলব না, সিলেক্টিভ; বরং লিমিটেড। কারণ, বহু বছর ধরে যাদের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং, তারাই।’ আর সন্ধ্যাটা মায়ের সঙ্গে টিভি দেখে কাটাতে ভালোবাসেন। ‘টিভি দেখাটা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে মায়ের সঙ্গে সময় কাটানো,’ যোগ করলেন আরিফিন শুভ।
রাতের খাবারটা সাধারণত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে সেরে ফেলার চেষ্টা করেন তিনি। বড়জোর নয়টা। চরিত্র অনুযায়ী স্ট্রিক্ট ডায়েটে না থাকলে সাধারণত নরমাল খাবারই থাকে তার নৈশভোজে। বললেন, ‘পরের দিন কাজ থাকলে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, ঘুমের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যায়। নো গ্যাজেট, নাথিং।’ এর আগে মেডিটেশনও সেরে ফেলেন।
শুভ বললেন, ‘আরেকটা জিনিস। আমার ফোন কিন্তু কোনো দিনই বাজে না, ভাইব্রেট করে না। কারণ, ওটা আমাকে একটু ডিসট্র্যাক্ট করে। পাঁচ-ছয় মিনিট পর পর তো ফোন দেখার একটা হেবিট আছেই। কিন্তু ফোন বেজে ওঠা…এটা কখনো হয় না। তাই সাড়ে দশটার মধ্যে সব প্রস্তুতি নিয়ে শুয়ে পড়ি। এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাই। ফলে পরের দিন আরামসে ছয়টা-সাড়ে ছয়টার মধ্যে উঠে গোসল করে মেকআপে বসে যাওয়া যায়।’ তবে স্বীকার করলেন, পরের সকালে কাজ না থাকলে একটু দেরি করেই ঘুমোতে যান। খুব বেশি দেরি অবশ্য নয়।
পোশাকের প্রশ্নে শুভর সোজাসাপ্টা জবাব, ‘যেকোনো সিচুয়েশনে কমফোর্ট আমার কাছে সবচেয়ে আগে। শুধু কাজের প্রয়োজনে কখনো কখনো হয়তোবা আনকমফোর্টেবল কোনো পোশাক পরি, কিন্তু পারসোনাল কিংবা নরমাল কাজের সময় চেষ্টা করি কমফোর্টেবল ক্লোদিংয়ের।’
অভিনেতা হিসেবে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগের দিনগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এখন মাঝেমধ্যে খানিকটা অস্বস্তি হয়, জানালেন শুভ। বললেন, ‘শুরুর দিকে নিজেকে ডিসট্র্যাক্ট করার চেষ্টা করতাম। তারপর দেখলাম, ডিসট্র্যাকশন মানে ইমোশনকে একধরনের সাপ্রেশন করা। সেটা পরবর্তী পর্যায়ে বার্স্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই একসময় আস্তে আস্তে চেষ্টা করলাম এটাকে অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়ার।’ আর তাতে সহায় হয়ে এসেছে মেডিটেশন। বললেন, ‘মেডিটেশন শুরু করেছি সম্ভবত ২০১৫ সালে। আমার কয়েকজন বন্ধু তা করত। তাদের কাছ থেকে শুনতাম, “তুই একটু ট্রাই কর।” এই মেডিটেশন কোত্থেকে এসেছে? মেডিটেশন করবার ওরিয়েন্টেশন সম্পর্কে একেকজনের ধারণা একেক রকম। কেউ বসে ধ্যান করেন। এই যে আমি এতক্ষণ কথা বলছিলাম, এর মাঝখানে সম্ভবত ৮ সেকেন্ড চুপ ছিলাম। এই ৮ সেকেন্ডে আমি মেডিটেশন করে নিয়েছি।’
‘মেডিটেশনের কারণ, প্রথমত আমরা ভীষণ স্ট্রেসফুল লাইফ কাটাই, দ্বিতীয়ত আমাদের জীবন ভীষণ আনসার্টেন। আমাদের জীবনের একটা বিষয় হচ্ছে, এ সপ্তাহে হয়তো আমার যেকোনো একটা কাজ খুব সমাদৃত হচ্ছে, পরিমণ্ডল এক রকম থাকবে, ঠিক পরের সপ্তাহে আমার কোনো একটা কাজ খুব একটা সমাদৃত হচ্ছে না, তখন ওই একই পরিমণ্ডল চেঞ্জ হয়ে যাবে। আমরা কী পেলাম তাহলে? এক্সটারনাল পরিমণ্ডল আমাদেরকে এফেক্ট করে। কিন্তু সেটা আমাদের জীবনে করতে দেওয়া উচিত না। কোনো একটা কাজ সমাদৃত হচ্ছে, সেটাতেও আমি “থ্যাংক ইউ”; কোনো একটা কাজ সমাদৃত হচ্ছে না, সেটাতেও বলি “থ্যাংক ইউ।” মানে, আমি মানসিকভাবে নিজেকে ডিটাচড রাখার চেষ্টা করি। কতটা পারি, জানি না। কারণ, ঘাড়ের ওপর উঠে বসে মানুষজন! ভালো হলেও, খারাপ হলেও। সে কারণে আমি ভালোটা থেকে দূরে থাকি, খারাপটা থেকেও। শুধু কাজটা করে যাই। পরিমণ্ডলের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখি। দূরত্ব মানে এমন নয় যে, ইনটেনশনালি আমি কারও সঙ্গে কথা বলছি না; বরং চেষ্টা করি নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার যে, এখন যারা খুব প্রশংসা করছে, পরের সপ্তাহেই যদি কোনো একটা কাজ তাদের ভালো না লাগে, এই মানুষগুলোই নিন্দা করবে। তো ভাই, তুমি নিজের কাজটুকু করে যাও। কোন কাজটা সমাদৃত হবেই—সেই গ্যারান্টি তো আমি দিতে পারব না। তাই সেখান থেকেই মেডিটেশনের বিষয়টা এসেছে,’ ব্যাখ্যা দেন শুভ।
অন্যদিকে, নিজের জীবনদর্শন প্রসঙ্গে বলেন, ‘জীবনকে কীভাবে দেখি, সেটা সব সময় সিচুয়েশন অনুযায়ী চেঞ্জ হতে থাকে। কিন্তু কীভাবে দেখার চেষ্টা করি, সেটাই বড় ব্যাপার। আজকে আমি যা, সেটা কাল না-ও থাকতে পারি। কাল আজকের সিচুয়েশনে না-ও থাকতে পারি। ভালো-মন্দ—দুই বিবেচনাতেই। এটাই আমার ফিলোসফি।’
তাকে দেখে যারা অভিনয়ে আসার স্বপ্ন বোনেন, সেই অচেনা অনুরাগীদের, এমনকি তার কাছ থেকে প্রেরণা খোঁজা নতুন অভিনেতাদের উদ্দেশে শুভর পরামর্শ, ‘ওয়ানডে খেলার প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে টেস্ট ম্যাচ খেলার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কালকে একটা কাজ প্রশংসিত না-ও হতে পারে। তাই আজকের সাফল্যে উদ্বেলিত হওয়ার মানে নেই; বরং আমরা যেন ওয়ানডে ম্যাচ নয়, টেস্ট ম্যাচে বিশ্বাসী হই।’

 রুদ্র আরিফ
ছবি: ক্যানভাস

This Post Has 2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top