skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I রবেন দ্বীপে ইতিহাস পাঠ

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাই শুধু নন, আরও এক কিংবদন্তি নেতা বন্দি ছিলেন এ দ্বীপে। পর্যটকদের কাছে তাই ভ্রমণ হয়ে ওঠে দুর্দান্ত এক ইতিহাসের পাঠও। ঘুরে এসে লিখেছেন বিধান রিবেরু

রাষ্ট্রীয় কারাগারের ভেতরে না গেলে রাষ্ট্রকে সত্যিকার রূপে চেনা হয় না। কেপটাউনের ওয়াটারফ্রন্টে নেলসন ম্যান্ডেলা গেটওয়েতে এই কথাগুলো লেখা বড় বড় করে, রলিহলাহলা নেলসন ম্যান্ডেলার বরাত দিয়ে। রলিহলাহলা নামটি রেখেছিলেন ম্যান্ডেলার বাবা। থেম্বু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীজাত শব্দটির অর্থ ‘গাছের ডাল ধরে টানাটানি’; তবে আরেকটি সাধারণ অর্থও আছে, সেটি হলো ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’। ম্যান্ডেলা ওরফে মাদিবা আদতে সমস্যাই সৃষ্টি করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়ে এসে জুড়ে বসা ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য। মাদিবা বিশ্বাস করতেন, এই উপনিবেশের কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার নানা স্তরে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে কেপটাউনে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘উপনিবেশবাদ ও বর্ণ-বিভেদ (অ্যাপারথেইড) স্পষ্ট দুই মেরু তৈরি করেছে সমাজে। যত দিন না আমরা শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আশ্রিত-আশ্রয়হীন, খুব ধনী-গরিবের বিশাল ভেদাভেদ কমিয়ে আনছি, তত দিন এই গভীর বিভাজন বিরাজ করবে।’
এই বক্তৃতার পর দুই দশক কেটে গেছে, মাদিবাও আর বেঁচে নেই, কেপটাউনের তীরে অতলান্তিকের অজস্র ঢেউ আছড়ে পড়েছে, ভেদ কি দূর হয়েছে আদৌ? হয়নি যে তার প্রমাণ পাওয়া যায় দেশটির পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও কলামে চোখ রাখলেই। তারা এখনো এই বিভেদরেখা নিয়ে চিন্তিত। প্রোটিয়া এক পণ্ডিতের লেখা কলামে পড়লাম, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ যত সহজে সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে, তত সহজে সেটার সমাধান করতে পারে না। না পারার কারণ বোধ হয় শত শত বছরের বঞ্চনা ও অপমানের ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। তেমনই এক দগদগে ক্ষতের নাম রবেন আইল্যান্ড। টেবিল বে-এর মাঝে, গ্রীষ্মের দখিনা-পুবালি আর শীতের উত্তুরে-পশ্চিমা বাতাসের ঝাপটায় অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ দশমিক আঠারো বর্গকিলোমিটারের উপবৃত্তাকার ছোট দ্বীপটি। কেপটাউন থেকে এগারো কিলোমিটার দূরের এই কুখ্যাত দ্বীপ-কারাগারেই ১৮ বছর সশ্রম কারাভোগ করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী নেতা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা।
আমি আর মনে ফেরি ছাড়ার ঠিক আধ ঘণ্টা আগেই হাজির হই ম্যান্ডেলা গেটওয়েতে। আগের দিনই আমরা বাপ-বেটা মিলে টিকিট কেটেছিলাম বেলা এগারোটার। টিকিট বিক্রেতাই বলছিলেন, যত সকালে যাবেন, তত ভালো। কারণ, তখন ঢেউয়ের আছাড় কম খেতে হবে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঢেউয়ের আকারও বাড়তে থাকে। সেটার প্রমাণ আগেই পেয়েছি। যাহোক, আমরা ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঘাটের ভবনে লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম। দোতলা ভবনটি ম্যান্ডেলার কারাজীবনের নানা ছবি দিয়ে চমৎকার করে সাজানো। দোতলার ছবিঘর ঘুরে নিচে নেমে দাঁড়াতে হয়। প্রথমে একটু দ্বিধা ছিল, মনের মাত্র সাড়ে ছয়, ওর মতো শিশু নিয়ে সেখানে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না। কিন্তু অপেক্ষারত অবস্থায় দেখলাম, মনের চেয়েও ছোট শিশুরা বাবা-মায়ের সাথে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, একদল স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে, সবাই বেশ হল্লা করতে করতে আমাদের পাশে এসে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সকলের বয়স দশের এদিক-সেদিক। মনেও ওদের দেখে একটু উৎসাহ পেল মনে হয়।
ঠিক এগারোটায় ঘাটে ফেরি এসে ঠেকল। ফেরিটির নাম দেখলাম খোউসা ভাষায় রাখা হয়েছে ‘সিখুলুলেকিল’; এর অর্থ ‘আমরা মুক্ত’। জুতসই নাম। একটি দল যানটি করে দ্বীপ থেকে ফিরে এসেছে। এবার আমরা উঠব। ডকের ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন এক চিত্রগ্রাহক আমাদের ছবি তুলে বললেন, ‘১৮ বছরের জন্য কারাভোগ করতে যাচ্ছ, শুভেচ্ছা রইল!’ কথাটি ঠাট্টা করে বললেও, গা ছমছম করে উঠল। ধীর পায়ে আমরা ফেরির ভেতরে গিয়ে বসলাম। মনেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। ফেরিটি যখন ছাড়ল তখন অতলান্তিকের দক্ষিণাংশে সূর্য যেন চূর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছে। প্রায় মধ্যগগনে তিনি। দেখলাম ছোট ছোট ঢেউয়ের ফনায় চিকচিক করছে রোদের ঝিলিক। দূরে টেবিল পর্বত দেখা যায়। তার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা আধুনিক জনপদ। ফেরির ভেতরে টিভিতে চলছে রবেন আইল্যান্ডের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু সেদিকে কারও মন নেই। থাকার কারণও নেই। কারণ, বাইরে যে সুন্দর খেলা করছে, তা অতুলনীয়। কুড়ি মিনিটের মতো চলার পর রবেন দ্বীপ চোখের সীমার ভেতর চলে এলো। দেখলাম ঝাঁক বেঁধে উড়ছে পানকৌড়ি। দু-একটি ডুব দিচ্ছে সাগরের জলে, তো আবার ভুস করে মাথা বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকছে ফেরির দিকে। ফেরি দ্বীপের আরও কাছাকাছি এলে বলে দেওয়া হলো, আমরা যেন আড়াই ঘণ্টা পর ঠিক সময়ে ফেরিতে ফিরে আসি, নয়তো রাত্রি যাপন করতে হবে কারাগারে। ওখানকার বিছানাপত্তর তো এখন খালিই আছে!
দ্বীপের নাম রবেন রেখেছে ডাচরা। ডাচ ‘রবেন’ শব্দের অর্থ সিল মাছ। বোঝাই যাচ্ছে, সিল মাছের আধিক্য দেখেই এই নাম রাখা। আমরা অবশ্য দ্বীপে নামার মুখে অত সিল মাছ দেখিনি, হয়তো অন্য প্রান্তে আছে। তবে দেখলাম, অজস্র পানকৌড়ি আর তাদের জলকেলি। সামুদ্রিক শৈবালে ঘেরা দ্বীপটিতে নানা বর্ণের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বাস। আমাদের বলে দেওয়া হলো, কোনো কিছু যেন না ছিঁড়ি এবং না ধরি। আমাদের নির্দিষ্ট একটি বাসে ঘুরিয়ে দেখানো হবে কিছুদূর, তারপর ম্যান্ডেলার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। এই কারাগার দ্বীপের তিন ভাগের এক ভাগ জুড়ে মাত্র। অতটুকুই আমাদের দেখানো হবে। বাকিটুকুতে মানুষের যাতায়াত সীমিত। কারণ, এতে প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়বে, তাই এই কঠোর সতর্কতা। মনে আর আমি ফেরি থেকে নামলাম। নেমেই চোখে পড়ল বিশাল সাদাকালো ছবি দাঁড়িয়ে আছে উঁচু প্রাচীরের সামনে। ছবির এক কোনায় লেখা, এই দ্বীপে প্রথম বন্দিদের আনা হয় ১৯৬২ সালে। ওই বছরেই সরকারবিরোধী সমাবেশ করে গ্রেপ্তার হন ম্যান্ডেলা। এই গ্রেপ্তারের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর হাত আছে। তাদের ধারণা, ম্যান্ডেলার সঙ্গে কমিউনিস্টদের সখ্য ছিল নিবিড় এবং তিনি যেকোনো মুহূর্তে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। গ্রেপ্তার করে ম্যান্ডেলাকে প্রথম জোহানেসবার্গের মার্শাল স্কয়ার কারাগারে রাখা হয়। তারপর শুরু হয় প্রহসনমূলক রিভোনিয়া ট্রায়াল। ম্যান্ডেলা সেই বিচারের সময় স্পষ্টই বলেছিলেন, তিনি সকল রকম আধিপত্যের বিপরীতে গিয়ে কালো-সাদানির্বিশেষে সবার জন্য গণতন্ত্র, সমান অধিকার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। আর সে জন্য তিনি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। প্রাণ নেওয়া হয়নি ম্যান্ডেলার, তবে জনমানব বিচ্ছিন্ন দ্বীপে শরীরটাকে আটকে রাখলে, মনোবল ভেঙে দিতে দিনের পর দিন অমানুষিক পরিশ্রম করালে এমনিতেই একজন সুস্থ মানুষ নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।
আমাদের একটি বাসে করে যখন দ্বীপের ভেতর নেওয়া হচ্ছিল, কিছুদূর গিয়েই দেখা গেল কবরের সারি। গাছের আড়ালে নামে-বেনামে শুয়ে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অনেক শহীদ। বাস আবার চলতে শুরু করল। নুড়ি বিছানো পথ। আরেকটু সামনে গিয়ে আমাদের বাসের গাইড দেখালেন চুনাপাথরের আকর। দ্বীপের মুরে’স বে হারবারের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এই জায়গাটিতেই ম্যান্ডেলা ও অন্য রাজবন্দিদের দিয়ে চুনাপাথর ভেঙে টুকরো টুকরো করানো হতো। বিশ্ববাজারে চুনাপাথর তেমন কোনো দামি জিনিস নয়। তারপরও রাজনৈতিক বন্দিদের তপ্ত রোদের ভেতর, ধবধবে সফেদ চুনাপাথরের রুক্ষ জমিতে কাজ করানো হতো একটা কারণেই, তাদের মনোবলে চিড় ধরানোর জন্য। চুনাপাথরের বালুকণা আর প্রতিফলিত আলোতে একসময় ম্যান্ডেলার চোখে সমস্যা হয়। আর এ কারণেই তিনি পরবর্তী জীবনে তীব্র আলো সহ্য করতে পারতেন না; রোদচশমা পরে থাকতেন। তার রসবোধ এতটাই প্রবল ছিল যে, কেউ যদি কখনো জিজ্ঞেস করত চশমা নিয়ে, তিনি বলতেন, ফ্যাশন, স্রেফ ফ্যাশনের কারণে পরেন। আসল কারণ কিন্তু রবেন আইল্যান্ডের এই চুনাপাথরের আকরে লুকায়িত।
ম্যান্ডেলা ১৯৬২ সালে রাজনৈতিক অভিযানে সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করে আফ্রিকার বারোটি দেশ ঘুরে, লন্ডন হয়ে যখন দেশে ফেরেন, তখন বিপদের গন্ধ পেয়ে অ্যাপারথেইড সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। এরই মধ্যে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র শাখার নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলা বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছেন। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করে ১৯৬৩ সালে তাকে প্রিটোরিয়া সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। পরের বছর ম্যান্ডেলা, ওয়াল্টার সিসুলু, আহমেদ কাথরাদা, গোভান এমবেকি, রেমন্ড ম্লাবা, ডেনিস গোল্ডবার্গ প্রমুখ নেতাকে রবেন দ্বীপের কারাগারে পাঠানো হয়। অপরাধ—তারা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাষ্ট্রের পরিচালক যদি বর্ণবাদী হয়, তবে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে তারা কোনো ভুল কাজ করেননি। এই দ্বীপ কারাগারে তাদের মতো শুধু রাজনৈতিক বন্দি নয়, সাধারণ অপরাধীদেরও রাখা হতো। এমনকি ১৯৩১ সালের আগ পর্যন্ত কুষ্ঠরোগীদেরও রাখা হতো বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। তারাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে, ১৮৯৫ সালে, এই দ্বীপে গুড শেপার্ড নামের একটি গির্জা নির্মাণ করেন, নিজেদের প্রার্থনার জন্য। সেটা এখনো দেখভাল করে রাখা হয়েছে, পর্যটকদের খাতিরে। আমরা সেটি দেখলাম। গাইড অবশ্য আরও একটি ছোট গির্জা আমাদের দেখিয়েছিলেন, গথিক শৈলীতে নির্মিত সুদৃশ্য উপাসনালয়টি গ্যারিসন গির্জা নামে পরিচিত। ১৮৪১ সালে বানানো। রাজনৈতিক বন্দিদের অনেকে ধর্মবিশ্বাসী না হয়েও প্রতি রোববার এই গির্জায় আসতেন শুধু দিনের হিসাব ঠিক রাখার জন্য। নয়তো দিন-তারিখ গুলিয়ে যেত। দিন-তারিখের হিসাব গুলিয়ে যাওয়া মানে বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেওয়া এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ তৈরি হওয়া। তাই রাজনৈতিক বন্দিরা সাত দিনের হিসাব ঠিক রাখতে এবং নিজেদের ভেতর চিন্তার আদানপ্রদানের জন্য গির্জার চৌকাঠে পা রাখতেন নিয়ম করে।
গির্জার ছবিটি আমি বাসের জানালা থেকে তুলে নিলাম। লক্ষ করলাম, এর প্রবেশপথটি পুব দিকে, আর পেছনের দিকটি পশ্চিমে। এই দিক নির্ধারণের সঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের যেমন যোগ আছে, তেমনি আরম্ভ ও অন্তেরও রূপক জারি আছে। কিছু দূরে দেখা মেলে একটি স্কুলের। বর্তমানে বন্ধ। গাইড জানালেন, স্কুলটি এখন সফেদ শঙ্খচিলদের দখলে; আসলেই তাই। ঝাঁকে ঝাঁকে শঙ্খচিল বা সিগাল এখানে-সেখানে জটলা পাকিয়ে আছে। এরা যেন জোহানেসবার্গের গ্যাংস্টার। স্কুলের আর আলাদা করে চুনকাজ করাতে হচ্ছে না; এদের বিষ্ঠাতেই গোটা স্কুল সাদা হয়ে গেছে! এসব বিহঙ্গ এতটাই সংঘবদ্ধ আর হিংস্র যে, এদের বিতাড়িত করা যাচ্ছে না সহজে। তবে গাইড বললেন, শিগগিরই পাখিদের হটানোর ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।
বাসটি একপর্যায়ে থামল এক মাঠের প্রান্তে। মাঠের একদিকে ‘কেরামাত’, মানে মাজার; আরেক দিকে উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগার। মাজারটি বানানো হয়েছে শ্রদ্ধা জানিয়ে। ১৭৫৪ সালে এই দ্বীপে শেখ মাদুরা মারা যান, তিনি ছিলেন রাজপুত্র, তার সম্মানেই মাজারটি বানানো হয়। পরে অবশ্য শেখ মাদুরার মরদেহ ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় নিয়ে কবর দেওয়া হয়। ইসলামের সঙ্গে রবেন দ্বীপের যোগসূত্রের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মাজার। আর এর ঠিক সামনেই যে কাঁটাতারবেষ্টিত কারাগার, সেখানেই বন্দিজীবন কাটিয়েছেন ম্যান্ডেলা।
আমাদের বাস থেকে নামানোর পরপরই সামনে এসে দাঁড়ালেন এক বয়স্ক মানুষ। নাম তার ডেডে খোৎসো নেৎসোলেনজি। প্রথমেই জানালেন, তিনি এই কারাগারে বন্দি ছিলেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভ্য হওয়ার অপরাধে তাকে ১৯৮৪ সালে এই দ্বীপে এনে বন্দি করা হয়। তখন তার বয়স উনিশও হয়নি। ম্যান্ডেলাকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। ম্যান্ডেলার সাথেই, ১৯৯১ সালে তার মুক্তি মেলে এই কারাগার থেকে। ডেডে আরও জানালেন, তার মতো রাজনৈতিক বন্দি এখন বেঁচে আছেন মাত্র আটজন। প্রথমে তিনি দেখালেন, কাঁটাতারের ভেতর বন্দিজীবনে যেখানে তারা মাঝেমধ্যে টেনিস খেলতেন, সেই জায়গাটি। পরে নিয়ে গেলেন নিজের সেলে, সেখানে গাদাগাদি করে বন্দিদের রাখা হতো। ঠান্ডায় কষ্ট পেতেন, খাবারে কষ্ট পেতেন। তবে নিজেদের ভেতর তারা পারস্পরিক বোঝাপড়া অটুট রাখতেন। একে অন্যকে শিক্ষিত করার কাজটি করতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। কারণ, রাজনৈতিক বন্দিদের অনেকেই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। তারাই দায়িত্ব নিতেন শিক্ষার আলোবঞ্চিত তরুণ বন্দিদের শিক্ষিত করার। কারাগার কর্তৃপক্ষের নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে, চুরি করে কাগজ-পেনসিল দেওয়া-নেওয়া তো হতোই, এমনকি সিমেন্টের থলে দিয়ে বই বানিয়েও পাচার হতো এক হাত থেকে অন্য হাতে। ম্যান্ডেলা বলতেন, তরুণদের এই দ্বীপেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দিতে হবে। যারা আইন, দর্শন, সাহিত্যসহ নানা বিষয়ে শিক্ষিত, তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে অন্যকে আলোকিত করার। এই শিক্ষাদান নীতির নাম রাখা হয়েছিল ‘ইচ ওয়ান টিচ ওয়ান’।
১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার দ্বীপটিকে মূলত রাজনৈতিক বন্দিদের কারাগার হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলাকে নিয়ে আসা হয়, আর নম্বর দেওয়া হয় ৪৬৬/৬৪, অর্থাৎ ’৬৪ সালে আনা চারশ ছেষট্টি নম্বর কয়েদি। ডেডে আমাদের একটি উঠোনের মতো জায়গা পার করে নিয়ে গেলেন সেই ঐতিহাসিক ৪৬৬৬৪ নম্বর কয়েদির তালা মারা কক্ষে। আট ফুট বাই সাত ফুট মাপের ঘরটিতে মোটা শিকের ছোট্ট জানালা। তিনটি পাতলা কম্বল, একটি থালা আর চামচ, পাশে রাখা টিনের বিন। এই ক্ষুদ্র ঘরটিতেই আঠারো বছর বন্দি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। আত্মজীবনী ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’-এ তিনি লিখেছেন, ‘বন্দিশালা শুধু আপনার স্বাধীনতাকেই ছিনিয়ে নেয় না, এটি আপনার পরিচয়কে ছিনিয়ে নিতেও উদ্যত হয়।’
কিন্তু মাদিবার পরিচয় দুই বছর কম দুই দশকেও ছিনিয়ে নিতে পারেনি বর্ণবাদী সরকার; বরং বন্দি অবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের ভেতর বাহাস করে নিজেদের পরিচয়কে আরও স্পষ্ট ও পরিণত করে নিতে পেরেছেন তিনি। ম্যান্ডেলার মতোই আরেক লড়াকু নেতা রবার্ট সোবুকুয়েকেও রাখা হয়েছিল রবেন দ্বীপে। তবে তাকে রাখা হয়েছিল সম্পূর্ণ একা করে। ম্যান্ডেলা বা এএনসির অন্য নেতাদের সঙ্গে তার দেখা দূরে থাক, কেউ জানতেই পারেননি এই দ্বীপে বন্দি আছেন রবার্ট সোবুকুয়ে। এমন বিচ্ছিন্ন করে রাখার ভেতরেই আসলে এই নেতার গুরুত্ব লুকিয়ে আছে। গাইড আমাদের বাসে করে আসতে আসতেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা একটি বিচ্ছিন্ন হলুদ বাড়ি, যেখানে সর্বদা ছয়জন প্রহরী নিয়োজিত থাকত সোবুকুয়ের জন্য। দুবেলা খাবার দেওয়া হতো দূর থেকে। এই প্রহরীদের সঙ্গেও কথা বলার অনুমতি ছিল না সোবুকুয়ের। গাইড বলছিলেন, এই নেতা মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা যান; অ্যাপারথেইড সরকার তাকে শুধু বন্দিই করেনি, বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল রাজনৈতিক বন্ধুদের কাছ থেকে। তিলে তিলে তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করাই ছিল তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য।
সরকার কেন এত ভয় পেয়েছিল সোবুকুয়েকে? এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি আর মনে দ্বীপ থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, তখন ডেডেকে বিদায় জানাতে কাছে গেলাম। বললাম, ‘আমি সৌভাগ্যবান যে আপনার মতো একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে পরিচয় হলো। একটা ছবি তোলা যাবে?’ তিনি সানন্দে রাজি হলেন। ছবি তোলার পর আমার মোবাইল আর এস-পেন এগিয়ে দিলাম। তিনি নিজের নাম আর বন্দি নম্বর ৩৮/৮৪ লিখে দিলেন কালো স্ক্রিনে।
ফেরিতে ওঠার আগে ভাবছিলাম, দ্বীপটি এখন অভিশাপমুক্ত; মানে কাউকে আর এখানে এনে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় না। দ্বীপে লোকজন থাকেন, তারা কারাগার-জাদুঘরেরই কর্মচারী ও তাদের পরিবার। তবে সংখ্যায় খুব কম। ১৪৮৮ সালে বার্থলোমিয়ো ডায়াস নামের পর্তুগিজ নাবিক ছোট্ট এই দ্বীপ আবিষ্কার করেছিলেন। পরে ডাচরা এর দখল নেয় এবং মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দী থেকে এই রবেনে দ্বীপান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কেপটাউনকে রক্ষার জন্য এখানে দুর্গ বানানো হয়। যদিও যুদ্ধ করতে হয়নি। কিন্তু অ্যাপারথেইড সরকার ষাটের দশকে এখানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য বন্দিশালা গড়ে তোলে এবং দলে দলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এনে বিনা বিচারে আটকে রাখে। তারা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল, দ্বীপটিতে একদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে তাদের অমানবিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস জেনে যাবে আর ঘৃণা পোষণ করবে?
লোকজন বন্দিশালা দেখে, মাথার ভেতর রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে ফিরছে ফেরির দিকে। আমরাও ফিরছিলাম। কিন্তু একটি স্যুভেনির শপ দেখে আটকে গেলাম। দোকানে ঢুকে পোস্টার আর বইয়ের দিকেই আমার চোখ পড়ল। কিন্তু মনে অস্থির হয়ে উঠেছে। হাত ধরে টানছে আর বলছে, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি চলো, ফেরি ছেড়ে দিচ্ছে। শেষে আমাদের এই জেলখানায় রাতে থাকতে হবে।’ মনের টানাটানিতে কোনো বই ভালো করে দেখতেই পারলাম না। কিন্তু মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে রবার্ট সোবুকুয়ে। ওয়াটার ফ্রন্টের শপিং মলে থাকা এক্সক্লুসিভ বুকশপে নিশ্চয় কোনো বই পাওয়া যাবে ওনার ওপর।
এসব ভাবতে ভাবতে কালের সাক্ষী রবেন দ্বীপ ছেড়ে উঠলাম ফেরিতে। ফেরি ছাড়তেই মনে ঘুমে ঢলে পড়ল আমার কোলে। কী আর করা, আমি একা একা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছালাম ঘাটে। মনেকে ডেকে তুলতে হলো। ঘড়িতে তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় আড়াইটা। ডক থেকে বেরোবার পথেই দেখি আমাদের ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন সেই আলোকচিত্রী। ৫০ র‌্যান্ড দিয়ে কিনে নিলাম ছবিটি।
মনে ক্ষুধার্ত; আমিও। আগের দিনের মতো সে আবার হটডগ খেল। সেই আফ্রিকান ট্রেডিং পোর্ট ভবনের সামনে থাকা ছোট্ট হটডগ কিং দোকানটি। খোলা চত্বরে চলছে আফ্রিকান ঐতিহ্যের নাচগান। দেখতে দেখতে দুজনে দুপুরের খাওয়া সারলাম, এরপর বইয়ের দোকানের দিকে হাঁটা দিলাম। বইয়ের দোকানে ঢুকেই মনেকে রিডিং টেবিলে বসিয়ে দিলাম কিছু বাচ্চাদের বই দিয়ে। তারপর গেলাম বায়োগ্রাফি সেকশনে। তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। নেই। রবার্ট সোবুকুয়ে নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয়, সৈয়দ মুজতবা আলীকে পেলাম। তার ‘দেশে-বিদেশে’ বইটির অনুবাদ রাখা আছে ভ্রমণের তাকে। তবে সোবুকুয়ে-বিষয়ক বই না পেয়ে, ভগ্নহৃদয় নিয়ে প্রথম নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা এলিস গিয়ের জীবনীনির্ভর গ্রাফিক নভেল নিয়ে, কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম। পয়সাও দিয়ে দিলাম। বেরিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন রবার্ট সোবুকুয়ে! পেয়ে গেছি! দোকানিকে প্রায় লাফিয়ে গিয়ে বললাম, ‘বইটা দিন, ওটাও নেবো।’ সোবুকুয়ের বন্ধু, সাংবাদিক বেঞ্জামিন পোগ্রান্ডের লেখা জীবনীগ্রন্থ, ‘রবার্ট সোবুকুয়ে: হাউ ক্যান ম্যান ডাই বেটার’। মনে পড়ল প্রতুলের গানের কথা: ‘সব মরণ নয় সমান।’ লোকটি মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, ডাক দিয়েছিলেন মুক্তিসংগ্রামের।
দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার কেন ভয় পেয়েছিল সোবুকুয়েকে, তার বিস্তারিত উত্তর পেলাম কিতাবে। তবে এখানে সংক্ষেপ করেই বলছি। আগ্রহী পাঠক অন্য সূত্র থেকে গোটা ইতিহাস জেনে নিতে পারবেন। ঘটনা হলো, ১৯৮৬ সালের আগ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষদের সর্বক্ষণ পরিচয়পত্র বা পাসবই বহন করতে হতো। সেই পাসে কালো মানুষটির পুরো পরিচয় তো লেখা থাকতই, এমনকি সে কোন এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে, কোথায় পারবে না, সেটারও উল্লেখ থাকত। পরিচয়পত্র বহন না করলে যেমন গ্রেপ্তার ও সাজা হতো, তেমনি অনুমোদিত এলাকার বাইরে গেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হতো তৎক্ষণাৎ। ভাবা যায়? নিজ ভূমে পরবাসী! নথিতে দেখা যায়, ১৯৫৮ সালে নানাবিধ দমনমূলক আইনকানুনের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় দৈনিক গড়ে এক হাজার সাতাশি জন কৃষ্ণাঙ্গকে গ্রেপ্তার বা সাজা দেওয়া হয়েছে। তখন কালো মানুষদের সংখ্যা ছিল সোয়া এক কোটির মতো। কালোদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার পেছনে এক-তৃতীয়াংশ কারণই থাকত পরিচয়পত্র বহন না করা। শুধু কি তাই? প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর জায়গাগুলো থেকেও বিতাড়িত করা হতো কালো মানুষদের। জেল-জরিমানা ও ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কৃষ্ণাঙ্গরা। তেমনি এক সময়ে ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) ছেড়ে আসেন রবার্ট ম্যাঙ্গালিসো সোবুকুয়ে। আদিবাসী শব্দ ‘ম্যাঙ্গালিসো’র অর্থ ‘চমৎকার’; তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের চমৎকার ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য ১৯৫৯ সালে গড়ে তোলেন নতুন দল প্যান-আফ্রিকানিস্ট কংগ্রেস (পিএসি)।
এএনসির সঙ্গে পিএসির বড় ধরনের মতপার্থক্য ছিল। অনেকটা যেন মহাত্মা গান্ধী আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বন্দ্ব। ম্যান্ডেলার এএনসি বলত সাদা-কালো মিলিয়েই দেশ গঠন করতে হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশটি সাদা-কালো-মিশ্র সকলের। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ডাচ-পর্তুগিজ-ফরাসি-ইংরেজদের উপনিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন সোবুকুয়ে। তিনি মনে করতেন, দক্ষিণ আফ্রিকা কালোদের। এখানে কালোদের গণতন্ত্রই কায়েম করতে হবে। সাদাদের প্রভুত্বকে বিদায় দিয়ে, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সোবুকুয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তিনটি লক্ষ্য স্থির করলেন। আব্রাহাম লিংকনের প্রতিধ্বনি করে তিনি বললেন, রাজনৈতিকভাবে, সরকার হবে আফ্রিকানদের, আফ্রিকানদের দ্বারা ও আফ্রিকানদের জন্য। যারা কেবল আফ্রিকার প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করবে এবং যারা আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিক শাসন মেনে নিতে প্রস্তুত, তারাই একমাত্র আফ্রিকান বলে গণ্য হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোবুকুয়ে লক্ষ্য স্থির করলেন, আধুনিক সামাজিক প্রগতিকে ধারণ করে ভূমির ওপর চাপ কমিয়ে, দ্রুত শিল্প-কলকারখানার প্রসার ঘটাতে এবং সম্পদের সুষম বণ্টন সুনিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক স্তরে, সোবুকুয়ে বললেন, মানবিক সত্তার পূর্ণ বিকাশ এবং বর্ণবাদী বিশ্বাসের যত রকম ধরন আছে, সব কটিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
সোবুকুয়ের এই তিন লক্ষ্য দেখেশুনে লোকেদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, তিনি কি সমাজতন্ত্রী, না সাম্যবাদী? তবে এ রকম নামাঙ্কিত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেননি সোবুকুয়ে; তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা যদি পুরোপুরি কোনো আদর্শকে গ্রহণ না করি, তাহলে ওই আদর্শকে অনুসরণ করারও দরকার নেই।… আমরা পশ্চিম থেকে নিয়েছি, পূর্ব থেকে নিয়েছি—রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিয়েছি পশ্চিম থেকে এবং পরিকল্পিত অর্থনীতি পূর্ব থেকে। আর এই পরিকল্পিত অর্থনীতি নিরর্থক হবে যদি এটি শেষ পর্যন্ত সমতা বিধান না করে।’ সোবুকুয়ের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বিধেয় দিয়ে বোঝা যায়, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি শোষণ ও বৈষম্যহীন, বর্ণবাদমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি। আর সে জন্য পিএসি গঠনের দেড় বছরের মাথায় এক কর্মসূচি হাতে নেন সোবুকুয়ে। ডাক দেন দক্ষিণ আফ্রিকার সকল কৃষ্ণাঙ্গকে, আসুন, যে পরিচয়পত্র বহন করা নিয়ে জেল-জুলুম করা হচ্ছে, সেই পাসবই আমরা বাসায় রেখে বেরোব, থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করব। বলব, আমাদের গ্রেপ্তার করুন। এক কোটির ওপর কৃষ্ণাঙ্গকে বিচার ও জেলে পোরার সক্ষমতা শ্বেতাঙ্গ শাসকদের নেই।
দিনটি ছিল ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ। যদিও আন্দোলনের তারিখ প্রথমে ৭ মার্চ নির্ধারণ করেছিলেন সোবুকুয়ে, কিন্তু লিফলেট ছাপানো শেষ না হওয়ায় তারিখ পিছিয়ে একুশে যায়। গ্রীষ্মের সেই সকালবেলা প্রথমে চার-পাঁচজন সোবুকুয়ের সঙ্গী হলেও, ধীরে ধীরে তার সাথে মিছিলে শামিল হয় প্রায় দুশো মানুষ। সকলে তারা জড়ো হয় অরল্যান্ডো পুলিশ স্টেশনে। সোবুকুয়ের ডাকে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকায় যার যার নিকটস্থ থানার সামনেই জড়ো হতে থাকে কালো মানুষের দল। বুফেলং ও বোয়াপেতং অঞ্চল থেকে প্রায় চার হাজার মানুষ সমবেত হয় ভ্যান্ডারবিজলপার্ক এলাকার থানায় সামনে। পুলিশ গুলি করে সেখানে। একজন মারা যায়। প্রথম শহীদ। গুলি চলে বুফেলংয়েও। এভাটনে জড়ো হয় দশ হাজার মানুষ। তারা স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হতে এসেছে। সোবুকুয়ের ডাকে। সে সময় বিমানবাহিনী থেকে জঙ্গিবিমান ওড়াতে থাকে সমাবেশের ওপর। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেটাকে পাত্তাও দেয়নি। ওদিকে শার্পভিলে চলে এসেছে প্রায় সাত হাজার লোক। সবদিকে টান টান উত্তেজনা। প্রশাসন বুঝতে পারছে না এই জোয়ার ঠেকাবে কী করে! নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও, শার্পভিলে হঠাৎ দু-একটি গুলি করে বসে পুলিশ। এরপর সমাবেশের দিকে পুলিশের রাইফেল ও স্টেনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া হয় টানা চল্লিশ সেকেন্ড। কিছুক্ষণ পর সেখানে লাশের সারি পড়ে থাকতে দেখেন উপস্থিত সাংবাদিকেরা। ওখানে মারা গিয়েছিল ৬৮ জন। আহত হয়েছিল ১৮৬ জন। বলা হয়, ২১ মার্চের ঘটনায় সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৭২ ছাড়িয়ে গিয়েছিল হয়তো। সমাবেশে আসা মানুষদের ওপর যখন গুলি ছোড়া হয়, তখন দিদ্বিদিক উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করেছিল আন্দোলনকারীরা। সত্তর ভাগের ওপর মানুষ আহত হয় পিঠে গুলি লেগে। অথচ পুলিশ মিথ্যাচার করে, বলে, পাথর নিক্ষেপের জবাবে তারা গুলি ছুড়েছে। পরে জানা যায়, সামান্য আহত হয়েছে মাত্র তিনজন পুলিশ। সেদিন আসলে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশে।
যে পাসবইকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন ঘনীভূত হয়ে ওঠে এবং রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে, সেই পাসকে কালোরা আফ্রিকান্স ভাষায় বলত ‘ডমপাস’, মানে ‘স্টুপিড পাস’। তো এই বোকা পরিচয়পত্রের উছিলায় কাতারে কাতারে লোক এনে থানার সামনে জড়ো করার মধ্য দিয়ে সোবুকুয়ের উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনকে স্থবির করে দেওয়া, পাশাপাশি বর্ণবিদ্বেষী নিপীড়নের প্রতিবাদ জানানো। এই উদ্দেশ্য শাসকদের বুঝতে দেরি হয়নি। কিন্তু তাদের বোঝাবুঝি পরিণত হয় আতঙ্কে। অ্যাপারথেইড সরকার হয়ে ওঠে রক্তপিপাসু। কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন পায় ভিন্ন মাত্রা। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া তারিখ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় সেদিন থেকে। সোবুকুয়ের প্যান-আফ্রিকানিস্ট কংগ্রেসের প্রথম বড় প্রতিবাদ কর্মসূচিতে এমন উত্তাল ঢেউ, গুলি, মৃত্যু, রক্তপাত—সব মিলিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে সরকার। তড়িঘড়ি করে সোবুকুয়েকে আন্দোলনের প্ররোচনাকারী অভিযোগে গ্রেপ্তার ও তিন বছরের জেল দেওয়া হয়। যেন বিনা বিচারে আরও আটকে রাখা যায়, সে জন্য সংসদে তথাকথিত ‘সোবুকুয়ে ক্লজ’ নামের বিশেষ আইন পাস করে সোবুকুয়েকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রবেন আইল্যান্ডে। একেবারে বিচ্ছিন্ন জায়গায়, নির্জন একটি ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়। বিনা বিচারে ছয় বছর বন্দি থাকেন তিনি। এরপর রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও কিম্বারলিতে তাকে আবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সোবুকুয়ে গৃহবন্দিই ছিলেন। কিন্তু তাকে যেভাবে একাকিত্বের দংশনে হত্যা করেছে অ্যাপারথেইড সরকার, তাতে তিনি মারা যাননি, বরং আরও বেশি অমরত্ব লাভ করেছেন। সংক্ষেপে এটাই রবার্ট সোবুকুয়ের মৃত্যুহীন জীবনের ইতিহাস।
সেদিনের মতো সোবুকুয়ের ওপর লেখা বইটি নিয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। কেপটাউনের পথঘাট, পার্ক, এমনকি দালানকোঠা—সবকিছুতেই উঁকি দিয়ে যায় ডাচ ঔপনিবেশিক শক্তির শৈলী। এই দৃশ্য এক অদ্ভুত সহাবস্থানের অনুভূতি দেয়, আবার ইতিহাসের নিষ্ঠুর অধ্যায় থেকে উঠে আসা বর্ণবিদ্বেষ অস্বস্তিও তৈরি করে। এখনো যে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থা জারি আছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেটি হয়তো কাটবে ধীরে ধীরে, তত দিনে অতলান্তিকের বুকে অনেক জল গড়িয়ে যাবে।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top