skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I বাড়ন্ত শিশুর পুষ্টি

শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে, মূলত তখন থেকেই তার মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এই বিকাশ চলতে থাকে। জীবনের কোনো পর্যায়েই যেন শিশুর পুষ্টি উপাদানে ঘাটতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা চাই; বিশেষ করে বাড়ন্ত শিশুর ক্ষেত্রে। পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

জন্মের পর নবজাতকের মুখে মধু, পানি, চিনির সিরাপ ইত্যাদি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে আমাদের দেশে। ধারণা করা হয়, তাতে বড় হতে হতে শিশুটি মিষ্টি স্বরের অধিকারী হয়। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, এমন কাজ মোটেই ঠিক নয়। জন্মের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শিশুর মুখে মধু, চিনি, এমনকি পানি দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। এ সময় মায়ের বুকের দুধ ছাড়া বরং অন্য কোনো খাদ্য উপাদান শিশুকে দিলে পরবর্তীকালে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, যেসব শিশু ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ খায়, পরবর্তীকালে তাদের অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কম। কেননা এই ছয় মাস মায়ের বুকের দুধ শিশুর শরীরে সারা জীবনের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে দেয়। তাই শূন্য থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোকে বিজ্ঞানীরা একটি নামও দিয়েছেন, এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং।
ছয় মাস পর থেকে শিশু বেশ দ্রুত বাড়তে থাকে। তাই এ সময় শুরু করতে হয় বাড়তি খাবার। যোগ করতে হয় কিছু খাদ্য উপাদান। একে বলে উইনিং ফুড। এ সময় আলু, গাজর কিংবা আপেল সেদ্ধ করে একটু চটকে দিয়ে শুরু করা যায়। যেহেতু এই প্রথম মায়ের বুকের দুধের বাইরে কোনো খাবারের স্বাদ শিশু গ্রহণ করবে, তাই হুট করে বেশি খাবার দেওয়া ঠিক হবে না; বরং ধীরে ধীরে অভ্যাস করানো শ্রেয়। নয়তো শিশুর মাঝে খাদ্যে অনীহা কিংবা খিটখিটে মেজাজ দেখা দিতে পারে। তবে এ সময় খাদ্য উপাদানের বাইরেও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা চাই, যেন শিশু সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে।
 শিশুকে খাওয়ানোর জন্য মা যখন প্রস্তুত, তখন বাড়তি খেয়াল রাখা চাই বাটি-চামচের দিকেও। কেননা যে চামচ মুখে দেওয়া হবে, সেটির যদি হাইজিন মেনটেইন করা না হয়, তাহলে শুরুতেই শিশুর পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
 কম ফোটানো পানিতে অনেক সময় মাইক্রো অর্গানিজম বেঁচে থাকে। সে ক্ষেত্রে কলেরাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে শিশু। তাই পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা চাই।
 হঠাৎ করেই যেহেতু নতুন খাবার শিশু গ্রহণ করতে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে মা অথবা যত্নদানকারীকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে শিশুর পায়খানা ঠিক আছে কি না। কেননা কোনো নির্দিষ্ট খাবার হজমে সমস্যা হলে সেটি শিশুর পায়খানা শক্ত কিংবা নরম করে দিতে পারে।
 মা অথবা যত্নদানকারীর হাত যেন সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখা জরুরি।
সাধারণত দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যেই শিশু হাঁটতে শেখে। দৌড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে। সময় যত যেতে থাকে, শিশুর দুরন্তপনাও বাড়ে। বাড়ন্ত বয়সে এমন দুরন্তপনা খুবই স্বাভাবিক। এ বয়সের শিশু মানেই খাবার ফেলে দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা ইত্যাদি। স্বাভাবিক শিশুর দুরন্তপনা থাকবে না, এমনটা ভাবাই যায় না। সে ক্ষেত্রে বাড়ন্ত বয়সে শিশুদের কোনো পুষ্টি উপাদানে যেন ঘাটতি না পড়ে, সেই খেয়াল রাখা চাই। ওর খাদ্যতালিকায় অবশ্যই রাখা চাই কিছু পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার। কী সেগুলো। চলুন, জানি।
ক্যালসিয়াম
হাড় ও দাঁত মজবুত করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হলো ক্যালসিয়াম। সব বয়সের মানুষের জন্যই এই মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাড়ন্ত বয়সের শিশুর ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে একটু সযতেœই। কেননা, এই সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের অভাবেই হোক কিংবা বাড়তি ক্যালসিয়ামের চাহিদার কারণে; পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম শরীরে না থাকলে বাড়ন্ত শিশুর হাড় ভঙ্গুর, হাড়ের দুর্বলতা, এমনকি জয়েন্ট পেইন, মাসল পেইন ইত্যাদি সমস্যা হতে পরে। এ ক্ষেত্রে শিশুকে প্রতিদিন অন্তত এক গ্লাস দুধ দিতে পারেন। অনেকেরই লেকটোজ ইনটলারেন্স থাকায় দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার খাদ্যতালিকা থেকে একেবারেই বাদ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে মনে রাখা চাই, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের জন্য দুধের তৈরি খাবার কিংবা দুধ যদি একান্তই বাদ দিতে হয়, তার বদলে রাখা চাই কিছু ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্য। সে ক্ষেত্রে দিতে পারেন আমন্ড মিল্ক। শিশুকে বাইরের খাবার একেবারেই দিতে যারা নারাজ, তারা ঘরেই তৈরি করতে পারেন এমন মিল্ক। আপনাদের জন্য রইল বাসায় আমন্ড মিল্ক তৈরি করার সহজ পদ্ধতি:
 ১০-১২টি আমন্ড বা কাঠবাদাম সারা রাত এক কাপ পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে বাদামি রঙের খোসাটি ছাড়িয়ে, এক কাপ পানি সহযোগে ভালোভাবে ব্লেন্ড করে নিন। তারপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিলেই প্রস্তুত হয়ে গেল দারুণ সাদা রঙের আমন্ড মিল্ক। আপনার শিশু খেলাধুলা একটু বেশিই যদি করে, সে ক্ষেত্রে সামান্য চিনি যোগ করে নিতে পারেন ওই মিল্কে। তাতে ক্যালরি ও স্বাদ- দুটোই বাড়বে।
ভিটামিন ডি
বাড়ন্ত শিশুর ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি-এর অভাব অনেকাংশেই দেখা দিতে পারে। শহুরে শিশুরা সাধারণত খোলা মাঠ, সূর্যের আলো খুব একটা পায় না। স্কুল থেকে শুরু করে খেলাধুলার জায়গায়ও যেন শুধুই কৃত্রিম আলো ও আলোকসজ্জা। সূর্যের আলোতে এক্সপোজ কম হওয়ার কারণে শিশুর শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য অবশ্যই রাখা চাই তালিকায়। সাধারণত শুধু খাদ্য থেকে ভিটামিন ডি পাওয়ার উপায় খুব কম। তবে কিছু খাদ্য এই ভিটামিন তৈরিতে সাহায্য করে। তাই সময়-সুযোগ থাকুক বা না থাকুক, অবশ্যই নিয়ম করে ১৫-২০ মিনিট শিশুকে রোদে রাখুন। সঙ্গে ওর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় রাখুন মাশরুম, চর্বিযুক্ত মাছ, ডিমের কুসুম ও ভিটামিন ডি ফর্টিফাইড যুক্ত কিছু সিরিয়াল অথবা খাদ্য উপাদান।
শিশুর শরীরে ভিটামিন ডি কম থাকলে কিছু পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব:
 সকালের রোদে ১৫-২০ মিনিট নিয়ম করে শিশুকে রাখুন। এ ক্ষেত্রে ওর শরীরের ৩৫-৪০ শতাংশে যেন সরাসরি রোদ লাগে, তাই স্লিভলেস পোশাক পরাতে পারেন।
 রোদে যাওয়ার সময় কুসুমসহ একটি ডিম হালকা তেলে পোচ করে শিশুকে খাওয়ান। এক মাস এভাবে নিয়মিত সান এক্সপোজ করানো হলে ওর দেহে থাকা ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে।
 মধ্য-সকাল বা বিকেলে শিশুকে মাশরুম স্যুপ খেতে দিতে পারেন।
 ভিটামিন ডি এনরিচড মিল্ক বা ইয়োগার্ট রাখতে পারেন শিশুর খাদ্যতালিকায়।
মনে রাখা জরুরি, ভিটামিন ডি-এর অভাব হলে শিশুর গ্রোথ ব্যাহত হয়, ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যায়, এমনকি ওর রিকেট রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
প্রোটিন
সকল পুষ্টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন অন্যতম নিউট্রিয়েন্ট। সেল রিপেয়ার কিংবা মাংসপেশির সকল গঠনগত ও বৃদ্ধির কাজ একমাত্র এটিই করে থাকে। তাই প্রোটিনের ঘাটতি মানে শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধি ও বিকাশে বাধা। ওর খাদ্যে প্রোটিনের যেন ঘাটতি না থাকে, সেটি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা চাই। যেসব শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ-মুরগি, ডিম, দুধ ইত্যাদি খায় না, তাদের ক্ষেত্রে মায়েরা অনেক সময় দুশ্চিন্তায় থাকেন শিশুর পর্যাপ্ত ও সঠিক গ্রোথ নিয়ে। বাড়ন্ত বয়সের শিশু যেহেতু একটু দুরন্ত হয়ে থাকে, ওর খাবারগুলো যেন আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। যেমন শিশু যদি মাছ খেতে পছন্দ না করে, তাকে মাছের চপ, ফিশ কাটলেট, ফিশ স্যান্ডউইচ কিংবা ফিশ পেটি দিয়ে বাসায় বার্গার বানিয়ে দিতে পারেন। এগুলো যেমন হেলদি, তেমনি খেতেও দারুণ। শিশুকে আরও দিতে পারেন মিক্সড নাট, বাদামের বরফি, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ- যাতে ডিম, চিকেন ও সবজি মিশ্রণ থাকবে।
মোটকথা, শিশুর সুস্থতায় ওর বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপেই বাড়তি খেয়াল রাখা পরিবারের সবার দায়িত্ব। কেননা শিশু থাকে বড়দের ওপর নির্ভরশীল। নিজের সুবিধা-অসুবিধা বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি। তাই একটু আদর ও যত্নই বাড়ন্ত শিশুর সঠিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। সে সঠিক ও পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে কি না, ওর গ্রোথ ঠিক আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনে কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে পারেন।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top