skip to Main Content

স্বাদশেকড় I রামেন রসন

জাপানি খাবার। খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সঙ্গে জুড়ে আছে যুদ্ধবিগ্রহ, নিধেষাজ্ঞার মতো চাঞ্চল্যকর ইতিহাস

রামেন শব্দটি কানে এলেই প্যাকেটজাত একটি প্রিকুকড ফ্লেভার ব্লকের কথা মনে পড়ে অনেকের। এ জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন রামেনের আবিষ্কারক মোমোফুকু আন্দো। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং ইয়াকুজা অপরাধ সিন্ডিকেটের কথা বলতে হবে।
সময়টা ১৯৪৫ সালের আগস্ট। জাপান সবেমাত্র মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিয়েছে। সে সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত ওসাকা অঞ্চলে হাঁটছিলেন আন্দো। মিত্রবাহিনীর বিমানের বোমা হামলা ওই শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে আন্দো যে কারখানা ও অফিস ভবনগুলো তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সেই হতাশাগ্রস্ত দিনে, বিধ্বস্ত শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার নজরে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। তিনি দেখতে পেলেন, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কেউ একটি অস্থায়ী রামেন স্ট্যান্ড স্থাপন করেছেন। লোকজন সারিবদ্ধ হয়ে এক বাটি রামেনের জন্য অপেক্ষা করছিল। স্পষ্টতই এই চিত্র ব্যবসায়ী আন্দোর মনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। এর তেরো বছর পর ইনস্ট্যান্ট রামেন ঘিরে নিজের সুপ্ত ধারণা ও সূত্র নিখুঁত করেছিলেন তিনি। আর বিশ্বের কাছে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এই খাবারের।
শুরুতে ইনস্ট্যান্ট রামেন ছিল এমন এক খাবার, যা ‘মোর দ্যান আ ফুড’ হিসেবে বিবেচিত হতো। ক্রেতারা সপ্তাহভিত্তিক টাকা দিয়ে এর জোগান পেতেন। জাপানি খাবারটিতে ঐতিহ্যগতভাবে গমের নুডলস, ঝোল, ট্যারে ও টপিংস থাকে। অবশ্য এর রন্ধনশৈলী ও উপাদানগুলোতে রয়েছে বৈচিত্র্য।
রামেনের ইতিহাস সন্ধান করতে চলুন চতুর্থ শতাব্দীতে ফিরে যাই। চীনা অভিবাসীরা তখন প্রথম জাপানে এসেছিলেন। পরবর্তী শতাব্দীতে এই দুই দেশের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সে সময় উভয় দিকে আন্তসাংস্কৃতিক বিনিময় প্রবাহিত হয়। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে, চীনা অভিবাসীরা নতুন ধরনের খাবারের পাশাপাশি কাগজ তৈরি শিল্প, চীনা ক্যালেন্ডার ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে জাপানিদের পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময়ে চীন থেকে জাপানে আমদানি হওয়া খাবারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গমের নুডলস লামিয়ান।
জাপানে পরিবেশিত প্রথম চায়নিজ নুডলসকে অবশ্য রামেন বলা হতো না। সেটি শিনা সোবা নামে পরিচিত ছিল। শিনা চীনে প্রচলিত একটি প্রাচীন জাপানি শব্দ এবং সেই সময়ে জাপানে পাওয়া যেকোনো নুডলসের ক্ষেত্রে সোবা শব্দটি ব্যবহার করার চল ছিল। এর মাধ্যমে সাধারণত বকউইট নুডলসকে উল্লেখ করা হতো। এর আপত্তিকর অর্থের কারণে, শিনা শব্দটি শেষ পর্যন্ত বর্জন করা হয়। তার জায়গায় প্রয়োগ করা হয় রামেন শব্দটি, যা সম্ভবত চীনা শব্দ লামিয়ানের জাপানি উচ্চারণ থেকে এসেছে। লামিয়ানের লা অর্থ টানা এবং মিয়ান অর্থ নুডলস।
আধুনিক রামেনের উৎস ঘিরে অনেক গল্প প্রচলিত থাকলেও বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের মতে, এটির আবির্ভাব ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। বিশ্বাস করা হয়, রাই রাই কেন নামে একটি নুডলস দোকান ১৯১০ সালে জাপানের টোকিওতে আউটলেট খুলে খাবারটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। সেখানে চীনা বাবুর্চিরা গমের নুডলস একটি নোনতা ঝোলসহযোগে পরিবেশন করতেন; এর ওপরে জুড়ে দিতেন শূকরের ভুনা মাংস, মাছের কেক ও নরি। এই উপাদানগুলোকে এখনো ক্ল্যাসিক রামেন টপিংস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেই সময়ে জাপান আরও শিল্পোন্নত হয়ে উঠছিল। দেশের ক্রমবর্ধমান শহুরে শ্রমিকশ্রেণি তাদের কর্মদিবসগুলোতে শারীরিক শক্তি অর্জন ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য সস্তা কোনো খাবারের সন্ধান করছিল। রামেন তাদের সেই চাহিদা পূরণ করেছিল বেশ ভালোভাবে।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী জাপান দখলে নেওয়ার সময়কালে রামেনের খ্যাতি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় এবং রেশন সংরক্ষণের জন্য একটি নীতির মাধ্যমে রাস্তার খাবার বিক্রেতাদের বেআইনি ঘোষণা করা হয়। তাতে বাসায় তৈরি না করে রাস্তা থেকে রামেন কিনতে অভ্যস্ত নাগরিকেরা মুশকিলে পড়েন। কেননা নতুন নীতি কার্যকর হওয়ার পরে খাবারটি কালোবাজার ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যেত না। বলে রাখা ভালো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজুড়ে জাপানে অবৈধ খাদ্য বিক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল। তারা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। কৃষি উৎপাদন হ্রাস কিংবা সম্পদ অব্যবস্থাপনার কারণে ঘাটতি থাকায় সরকারি রেশন প্রায় নিয়মিতই দেরি করে পাওয়া যেত। যুদ্ধের পর রামেন বিক্রির অপরাধে হাজার হাজার বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই ইয়াকুজা নামে পরিচিত জাপানি অপরাধ সিন্ডিকেটের নির্দেশে পরিচালিত হতেন।
তবে মোমোফুকু আন্দোর বদৌলতে ১৯৫৮ সালে রামেন সত্যিই মূলধারার খাবারে পরিণত হয়। অতীতে তিনি অস্থায়ী স্ট্যান্ড ব্যবহার করে রামেন তৈরি করতে দেখেছেন, সেই স্মৃতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে এই উদ্ভাবক ও ব্যবসায়ী বিশ্বাস করেছিলেন, সস্তা এই খাবার শ্রমজীবী জাপানি মানুষের জন্য আসলেই উপযুক্ত। নুডলস বাটিকে তিনি এমনভাবে রূপান্তর করেছিলেন, যা কয়েক মাস ধরে তাকে জমিয়ে রাখা যায় এবং পরবর্তীকালে কয়েক মিনিটের মধ্যে খাবারের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব। তিনি অবশ্য নুডলস ডিহাইড্রেট করতে শুরু করেছিলেন; তবে যত দ্রুত রান্না করতে পারবেন বলে আশা করেছিলেন, তা আর হয়নি। তারপর কয়েক মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি ফ্ল্যাশ-ফ্রাইং আবিষ্কার করেন।
ডিহাইড্রেটেড নুডলস ভাজার ফলে ভেতরে আটকে থাকা পানির ফোঁটা বাষ্পীভূত হয় এবং ছোট ছোট ছিদ্র তৈরি করে। এই পদ্ধতি দুটি সমস্যার সমাধান এনে দেয়। প্রথমত, নুডলসে কম পানি থাকার অর্থ হলো, সেগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কম। দ্বিতীয়ত, সেদ্ধ করা হলে এসব ছিদ্র খুব দ্রুত রিহাইড্রেট হয়ে যায়। মুরগির স্বাদ যোগ করে তিনি এই খাবারকে মাস্টারপিস করে তোলেন।
আন্দোর চিকেন রামেনকে এ ধরনের প্রথম পণ্য হিসেবে গণ্য করেন কোনো কোনো খাদ্যবিশেষজ্ঞ; তবে এমন দাবি সম্পূর্ণ সত্য না-ও হতে পারে। জর্জ সোল্ট তার ‘দ্য আনটোল্ড হিস্ট্রি অব রামেন’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মাতসুদা সাঙ্গিও নামে একটি কোম্পানি একধরনের নুডলস বাজারে এনেছিল, যা ‘একটি অভিন্ন পণ্য’। আজি সুকে চুকা মেন বা স্বাদযুক্ত চীনা নুডলস নামে পরিচিত ছিল সেটি। যদিও তারা কখনো পেটেন্ট পায়নি এবং কয়েক মাস চেষ্টার পর ব্যবসা জমাতে না পেরে পণ্য তৈরি বন্ধ করে দেয়; তবে সেই কোম্পানির ব্যর্থতা আন্দোর সাফল্যের রাস্তাকে উন্মোচন করেছিল।
এই খাবারে মুরগির স্বাদ যুক্ত করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরবর্তীকালে আন্দো বলেছিলেন, ‘মুরগির স্যুপ ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে প্রবর্তিত হওয়ার সময় ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়াতে সক্ষম হয়েছিল ইনস্ট্যান্ট রামেন। হিন্দুরা যেমন গরুর মাংস খেতে পারেন না, তেমনি মুসলমানরা শুয়োরের মাংস খান না। কিন্তু সম্ভবত এমন কোনো সংস্কৃতি, ধর্ম কিংবা দেশ নেই, যেখানে মুরগির মাংস খেতে নিষেধ করা হয়েছে।’
যদিও তার লক্ষ্য ছিল রামেন নুডলসকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, তবে প্রথম পণ্যটি তত সস্তা না হওয়ায় সেই আশা পূরণ হয়নি। জাপানে আত্মপ্রকাশের সময় এটিকে কিছুটা স্প্লার্জ আইটেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির জন্য সামঞ্জস্য করতে প্রতি প্যাকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ ইয়েন, যা তখনকার অন্যান্য নুডলসের তুলনায় প্রায় ছয় গুণ বেশি। রামেন যেহেতু বিদেশে কনভেনিয়েন্ট ফুডের সমার্থক হয়ে উঠেছিল, ফলে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জাপানে রামেন স্টলগুলোর পুনরুত্থান ঘটে। যুদ্ধের ঠিক পরের বছরগুলোতে রামেনকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হলেও জাপানে আমেরিকার উপস্থিতি আসলে দীর্ঘ মেয়াদে এ খাবারের জনপ্রিয়তা ও প্রোফাইলের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
এদিকে যুদ্ধোত্তর খাদ্যসংকটের সময়কালে দেশটিতে সস্তায় গম পাঠিয়েছিল আমেরিকা। এটি আংশিকভাবে ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি মানবিক প্রচেষ্টা ছিল ঠিকই, তবে কিছুটা ছিল রাজনৈতিক হিসাবও। আমেরিকান নেতারা আশঙ্কা করেছিলেন, পশ্চিমা শক্তির উত্থানের হতাশা থেকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাপান ও আমেরিকা বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে জাপানের কাছে উদ্বৃত্ত গম বিক্রি করে জাপান। একই সময়ে, আমেরিকান প্রচারকারীরা জাপান সরকারের সঙ্গে জোট বেঁধে স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে গমের গুণাবলি ও প্রশংসা প্রচার করে। এই প্রচারের একটি অংশে জাপানিদের রুটি সেঁকা শেখানোর জন্য ‘কিচেন বাস’ পাঠানো হয়েছিল, যদিও বেশির ভাগ জাপানির রান্নাঘরে ওভেনের অভাবের কারণে এই পরিকল্পনা সাফল্যের মুখ দেখেনি। এমনকি পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, ভাতের ওপর নির্ভরশীল খাবার মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে। ১৯৫০-এর দশকে যখন খাদ্য বিক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আইন শিথিল করা হয়, তখন স্বাস্থ্যকর রামেনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময়ে এর সুলভ মূল্য একে সফল হতে সাহায্য করেছিল।
সেই সময় থেকে রামেনের ধরন জটিল হতে শুরু করে। জাপানের বিভিন্ন অংশ তাদের নিজস্ব রামেনের শৈলীর বিকাশ কিংবা বিস্তার ঘটাতে থাকে। ফুকুওকা ছিল জাপানে শূকরের মাংসশিল্পের কেন্দ্রস্থল। জায়গাটি পরবর্তীকালে তনকোতসুর রামেনের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। জাপানি শূকরের কাটলেট টোনকাটসুর সঙ্গে একে মিলিয়ে অনেকে অবশ্য বিভ্রান্ত হন। বলে রাখি, টোনকাটসু মূলত ক্লাউডি স্টক, যা শূকরের হাড় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত, এমনকি কখনো কখনো তারও বেশি সময় ধরে সেদ্ধ করে বানানো হয়। এটি হাড়ের অভ্যন্তরে চর্বি, মজ্জা ও খনিজ ভেঙে এমন একটি ঝোল তৈরি করে, যা কিছুটা অস্বচ্ছ।
রামেনের শৈলী যা-ই হোক না কেন, সামুদ্রিক শৈবাল, ডিম, শিমের স্প্রাউট, ভুট্টা, পেঁয়াজ, সংরক্ষিত বাঁশের অঙ্কুর এবং ব্রেইজড শূকরের মাংস এতে সবচেয়ে প্রচলিত টপিংস। ১৯৮০-এর দশকে রামেন জাপানে খাদ্যসংস্কৃতির বিশেষ অংশ হয়ে ওঠে। শতাব্দীর ঐতিহ্যের সঙ্গে আবদ্ধ অন্যান্য জাপানি খাবারের বিপরীতে তরুণ শেফরা রামেন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মার্কিন রেস্তোরাঁ মোগল ডেভিড চ্যাংয়ের অবদান ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। গত কয়েক দশকে এ খাবারের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেতে তার রয়েছে বিশেষ অবদান। ২০০৪ সালে তিনি আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে মোমোফুকু নুডলস বার খোলেন, যা ইনস্ট্যান্ট নুডলস উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত ছিল। জাপানি রামেন চেইন ইপ্পুদো বিশ্বজুড়ে এ খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে রাখছে বিশেষ ভূমিকা। বর্ধিত জনপ্রিয়তার কারণে শিগগির রামেন জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার সুশির জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, এমন ধারণা খাদ্য ইতিহাসবিদদের অনেকের।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top