skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I যথোচিত যকৃৎ

২৮ জুলাই। ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস ডে। হেপাটাইটিসের পাশাপাশি লিভারের আরও বেশ কিছু জটিল অসুখের কথা আজকাল হরদম শোনা যায়। লিভার সুস্থ রাখতে খাদ্যাভ্যাসের বিশেষ পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

লিভার বা যকৃৎ। মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দেহ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণের কাজ করতে বা দেহকে ডিটক্সিফাই রাখতে সাহায্য করে। আমরা প্রতিদিন যত তেল বা চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করি, তা হজমের জন্য বাইল অ্যাসিড অত্যন্ত প্রয়োজন। আর তা লিভারের মাধ্যমে পেয়ে থাকি।
দুর্ভাগ্যক্রমে, লিভারের নানা সমস্যায় আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেমন হেপাটাইটিস, জন্ডিস, লিভার সিরোসিস ইত্যাদি অসুখের দাপট দেখা যায় চারপাশে। এ ধরনের শারীরিক সমস্যা হওয়ার পেছনে কলকাঠি নাড়ে নানা কারণ। আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে বিক্রি হয় বিভিন্ন ধরনের শরবতসহ নানা তরল পানীয়। যখনই উত্তপ্ত গরমে চারপাশ খাঁ খাঁ করে, আমরা অনেকে খেয়াল রাখি না—কী খাচ্ছি, কোথা থেকে খাচ্ছি। মুহূর্তেই মনের তৃপ্তি মেটাতে অনেকে না বুঝে, যাচাই না করে বিভিন্ন পানীয় গ্রহণ করি। ফলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে হয়। আর তা পরিণামে ডেকে আনে লিভারের অসুখ-বিসুখ।
ভাবনার ব্যাপার হলো, লিভারের অসুখগুলো একবারে সব বোঝা যায় না; বরং উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। যেমন খাবার খাওয়ার পরেই পেটে ফোলা ভাব, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, ওজন কমে যাওয়া, চুলকানি হওয়া প্রভৃতি। এ ছাড়া চোখ, হাতের তালু, পায়ের নখ হলুদাভ ধারণ করা।
দেহকে ডিটক্সিফাই করতে না পারলে আমাদের পক্ষে সুস্থ থাকা মুশকিল। তাই লিভার সুস্থ রাখতে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি—
 সকালে বিরিয়ানি দিয়ে নাশতা সারেন, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। এ ছাড়া নেহারি দিয়ে পরোটা অথবা গরুর মাংস দিয়ে লুচি অনেকের বাসায় প্রধান ব্রেকফাস্ট। জানা কথা, অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার লিভারের সমস্যার অন্যতম কারণ। যদিও লিভার এ ধরনের খাবারগুলোকেও হজমে সাহায্য করে; কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণে লিভারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত ফ্যাট লিভারের চারপাশে জমতে শুরু করে। ফলে লিভার বড় হয়ে যাওয়া, ফ্যাটি লিভার ইত্যাদি সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। পাশাপাশি, লিভারের কোষগুলো অতিরিক্ত কাজ করার ফলে অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে তা লিভারকে তুলনামূলক দ্রুত কাবু করে ফেলার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ কারণে যাদের এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস রয়েছে, তাদের অবশ্যই তা একটু পরিবর্তন করে হেলদি ব্রেকফাস্ট গ্রহণ করা প্রয়োজন।
 অ্যালকোহল বা মদ্যপানের বদভ্যাস রয়েছে কারও কারও। অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ লিভারের অসুখ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। অনেকের ধারণা, ভালো মানের অ্যালকোহল গ্রহণে লিভারের ক্ষতির ঝুঁকি নেই। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেটি যে মানেরই হোক না কেন, লিভারের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সাবধান!
লিভারের সুস্থতার জন্য তালিকায় রাখতে পারেন কিছু খাবার। তবে খেয়াল রাখা চাই, লিভারের অসুখ হয়ে গেলে এই খাবারগুলো গ্রহণ করা যাবে কি না, তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে জেনে নেওয়া জরুরি।
 হলুদ: জন্ডিসসহ লিভারের অন্যান্য অসুখে সারা দেহ হলুদাভ ধারণ করে; অথচ টারমারিক বা হলুদ লিভারের অসুখ হওয়ার আগে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন গ্রহণ করা হলে সুস্থতা পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে রাতে কাঁচা হলুদ ভিজিয়ে রেখে, পরদিন সকালে খালি পেটে পানীয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। এটি পেট পরিষ্কারের পাশাপাশি রক্ত বিশুদ্ধকরণে কাজে দেবে।
 রসুন: লিভারের সুস্থতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারের জুড়ি নেই। তালিকায় রাখতে পারেন রসুন। এই মেডিসিনাল ফুডে রয়েছে সেলেনিয়াম, যা লিভারকে যথাযথভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। রসুন খাওয়া যেতে পারে কারি রান্নায়; অথবা বিকেলের নাশতা হিসেবে মুড়ি ভাজার সঙ্গে এক কোয়া রসুন হতে পারে দারুণ স্ন্যাকস।
অতিরিক্ত সুগার এড়িয়ে চলাই স্বাস্থ্যসম্মত। বাল্যকালে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও ধরে রাখলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। অনেকে মনে করেন, ডায়াবেটিস না হয়ে থাকলে সিম্পল কার্বোহাইড্রেট যেকোনো ব্যক্তির জন্যই ভালো অথবা খাদ্যতালিকায় রাখলে কোনো সমস্যা হবে না। অথচ লিভারের সমস্যায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে অনেক সময় রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে এসব রোগীর খাদ্যতালিকা থেকে চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো অবশ্যই বাদ দেওয়া চাই।
লিভারের সমস্যায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে আরও একটি নিষেধাজ্ঞা থাকে প্রোটিন গ্রহণের বেলায়। অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ না করাই ভালো। অন্যদিকে, ফার্স্ট ক্লাস প্রোটিনগুলো গ্রহণ করলেও দুধ ও দুধজাতীয় খাবারে থাকে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা। এসব ক্ষেত্রে এসজিপিটি ও লাইপেজ বেশি থাকায় দুধে তৈরি খাবারগুলো কম কিংবা একেবারে না খাওয়াই মঙ্গল।
সাধারণত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের অসামঞ্জস্যের কারণে মানবদেহে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা বাসা বাঁধে। লিভারে কোনো সমস্যা আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা জানা জরুরি। রক্তের রিপোর্ট অথবা আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে লিভারের অবস্থা জানা সম্ভব। রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে লিভারের পাশে ফ্যাট জমে ফ্যাটি লিভার তৈরি হয়, যা বিভিন্ন গ্রেডের ওপর নির্ভর করে সমস্যা প্রকাশ করে। ফ্যাটি লিভার কমাতে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন এই রেসিপি—

 উপাদান: অঙ্কুরিত ছোলা বা স্প্রাউট (এক বাটি), শসা (একটি), টমেটো (এক বাটি), অ্যাভোকাডো (প্রয়োজনমতো), অলিভ অয়েল (এক চা-চামচ), লেবুর রস (আধা চা-চামচ), পুদিনাপাতা (সামান্য পরিমাণ)।
 প্রণালি: এক বাটি কাঁচা ছোলা এক থেকে দুই রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এর মধ্যে ছোলা স্প্রাউট বা অঙ্কুরিত হবে। এটি প্রথমে একটি বাটিতে নিয়ে, এরপর একে একে শসার কুচি, টমেটো কুচি দিয়ে মিক্সড করে নিন। এরপর অলিভ অয়েল ও লেবুর মিশ্রণ শেষে সামান্য পুদিনাপাতা যোগ করে নিলেই খাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
এই রেসিপিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, আয়রন এবং প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মিলবে। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন অন্যান্য খাবারের পরিবর্তে বিকেলে অথবা মধ্য সকালে খাওয়া যেতে পারে এ ধরনের হালকা স্যালাদ। যাদের ওজন অথবা রক্তের চর্বি নিয়ে দুশ্চিন্তা, তাদের জন্যও এটি একটি দারুণ রেসিপি।
তবে খেয়াল রাখা চাই, লিভারের অসুখে থাকে নানা নিষেধাজ্ঞা। কোন ধরনের অসুখে ভুগছেন, তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা ও খাদ্যব্যবস্থা শুরু করা চাই। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ অথবা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করাই উত্তম।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top