skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I হাসির মহিমা

মানবসভ্যতার একেকজন প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে কিছু দায়ভার। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, কোনো পরিস্থিতিতে, কোনোভাবেই অন্যের হাসি কেড়ে না নেওয়া

শিশুর হাসিমুখ কার না ভালো লাগে! এই হাসি ঘিরে কালে কালে লেখা হয়েছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প; আঁকা হয়েছে ছবি। এখনো হচ্ছে। চিরকাল হবে। বলা হয়ে থাকে, মানবকুলে শিশুর হাসির মতো নির্মল আনন্দের অভিব্যক্তি দ্বিতীয়টি আর নেই। বয়স বাড়তে থাকে যত, বাস্তবতা উপলব্ধি করার সক্ষমতা যত গড়ে উঠতে থাকে মানসপটে, ব্যক্তিমানুষ সেই নির্মলতা একটু একটু করে খুইয়ে ফেলেন। এ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই বলে হাসতে একদম ভুলে যাওয়া কাজের কথা নয়। কেননা, হাসি স্রেফ অভিব্যক্তিই নয়, মানবজীবনে ভালো থাকার এক মহৌষধও বটে!

দুই
গবেষণায় জানা যায়, একজন শিশু প্রতিদিন গড়ে ৪০০ বার হাসে। সেই তুলনায় হাসিখুশি প্রাপ্তবয়স্করা হাসেন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ বার। অন্যদিকে, সাধারণ প্রাপ্তবয়স্করা হাসেন গড়ে মাত্র ২০ বার। অথচ হাসি আবেগ প্রকাশের এমন একটি শারীরিক প্রতিক্রিয়া, যার মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের শারীরবৃত্তিক পরিবর্তনের দেখা মেলে। মুখমণ্ডল আর পেশি প্রসারিত ও সংকুচিত হয়, হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপে ঘটে পরিবর্তন, বেড়ে যায় শ্বাসের গতি। এর ফলে শরীরের সবখানে প্রবাহিত হয় বাড়তি অক্সিজেন, যা শরীরকে করে তোলে চাঙা। তাই অনেক সময় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা কোনো কোনো রোগীকে নিয়মিত হাসির চর্চা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ঘিরে অনেক কমিউনিটিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রকমের লাফিং ক্লাব। এমন ক্লাবের সভ্য হয়ে হাসাহাসি করা যাদের কাছে ঝক্কি মনে হয়, তারা ঘরেই সারতে পারেন এই চর্চা। গবেষণা বলে, ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে যারা শরীরচর্চা করেন, প্রতি দশ মিনিটে তাদের হৃৎস্পন্দন যতটুকু বাড়ে, মাত্র এক মিনিটের প্রাণখোলা হাসিতে সেই স্পন্দন বাড়ে ততটুকু! তা ছাড়া দশ থেকে পনেরো মিনিট হাসলে খরচ হয় পঞ্চাশ ক্যালরি। হাসির উপকার রয়েছে আরও। এটি সহনশীলতা বাড়ায়, শারীরিক ব্যথা ও মানসিক চাপ কমায়, বৃদ্ধি ঘটায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, রক্তে ক্ষতিকর গ্লুকোজের পরিমাণ কমায়। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে হাসি নিয়ে একবার এক মজার নিরীক্ষা করা হয়েছিল। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা দেখতে চেয়েছিলেন, কাউকে কমেডি নাটক দেখালে তার রক্তপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়; উল্টো দিকে, ট্র্যাজেডি দেখালে তা ঘটে কেমন। নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে তাদের অভিমত, হাসির নাটক যারা দেখেছেন, তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে বেড়েছে রক্তপ্রবাহ। এত উপকারের পরও কি প্রিয় পাঠক, আপনি মুখ গোমড়া করে রাখবেন? হাসবেন না!

তিন
মানসিক সুস্থতার সঙ্গেও হাসির রয়েছে সরাসরি সম্পৃক্ততা। হাসির মাধ্যমে একজন মানুষের শরীর থেকে তিনটি হরমোনের নিঃসরণ ঘটেÑ ডোপামিন, এন্ডোরফিন ও সেরোটোনিন। আর তা তার মনোজগতে ছড়িয়ে দেয় আনন্দের অনুভূতি। ব্রিটিশ গবেষকদের সূত্র ধরে আমেরিকান স্বাস্থ্যসেবা উদ্যোক্তা, অধ্যাপক ও ‘স্মাইল: দ্য অ্যাস্টোনাইজিং পাওয়ারস অব আ সিম্পল অ্যাক্ট’ গ্রন্থের রচয়িতা রন গুটম্যান বলেন, ‘কেউ দুই হাজার টুকরা চকলেট খেলে তার মস্তিষ্ক যতটুকু উদ্দীপ্ত হয়, তা শুধু একবার হাসির মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।’ এমনকি জোর করে হাসাও দেহ-মনের জন্য উপকারী। অন্যদিকে, যেকোনো ধরনের সম্পর্ক সুন্দর রাখতে হাসির বিকল্প মেলা ভার। প্রখ্যাত আমেরিকান মোটিভেশনাল রাইটার উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ডের মতে, ‘একটি আন্তরিক হাসি হলো উদারতার এক সর্বজনীন ভাষা।’ তার মানে, মুখ ফুটে কিছু না বলেই, নিজ ভাষাভাষী হোক কিংবা অজানা, যে কারও সঙ্গেই হাসির ভাষায় আন্তরিক যোগাযোগ স্থাপনে কোনো অসুবিধা হয় না। তাই নিজে হাসার পাশাপাশি অন্যকেও হাসিখুশি রাখার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

চার
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি যখন বিশ^রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিদেশি শাসকদের অধীনে বিপর্যস্ত, পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা যখন প্রাণনাশী হুমকির নামান্তর, প্রতিবাদস্বরূপ ‘ক্রীতদাসের হাসি’ শিরোনামে এক দুর্দান্ত ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস লিখেছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। সেই উপন্যাসের বিখ্যাত সংলাপটি অনেকের জানা, তবু আরেকবার পাঠ করা যাক- ‘দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাসের গোলাম কেনা চলে, বন্দী কেনা সম্ভব, কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি না।’ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় সাহসিকতায় আমাদের ভূখণ্ড আজ স্বাধীন। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে, এমনকি মানবসভ্যতার একেকজন প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে কিছু দায়ভার। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, কোনো পরিস্থিতিতে, কোনোভাবেই অন্যের হাসি কেড়ে না নেওয়া।

পাঁচ
অক্টোবরের প্রথম শুক্রবার ওয়ার্ল্ড স্মাইল ডে। নিজে হাসুন, অন্যদের হাসতে দিন। হাসিখুশিতে ভরে থাকুক সবার জীবন।
শুভকামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top