skip to Main Content

মনোযতন I আইডেনটিটি ক্রাইসিস?

পরিচয়-সংকট। এমনই এক তীব্র অনুভূতি, যা যেকোনো সময় হানা দিয়ে একজন ব্যক্তিমানুষের মনোজগতে চালাতে পারে তাণ্ডব! এ থেকে রেহাই পাওয়ারও রয়েছে উপায়। জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

রূপকথার সেই দাঁড়কাকের কথা মনে পড়ে? যে ময়ূরের রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে মিছে ময়ূর সাজিয়ে জাতভাইদের ডেকে বলেছিল, ‘ছি ছি, তোরা কত কুৎসিত। দেখলেই ঘেন্না হয়! তোদের অমন কদাকার চেহারার সঙ্গে আমায় একেবারেই মানায় না। তোরা নিজের মতো করেই থাক বাপু। আমি বরং চললাম ময়ূরের দলে। এখন থেকে ময়ূরদের সঙ্গেই থাকব।’ সেই অহংকারী দাঁড়কাককে কিন্তু ময়ূরেরা ঠিকই চিনতে পেরেছিল। ঘিরে ধরে একে একে খুলে নিয়েছিল শরীরের সব পালক। ঠুকরিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল শরীর। কোনোমতে জান নিয়ে একসময় সে পালিয়ে এসেছিল জাতভাইদের কাছে। কিন্তু বিধি বাম! জাতভাইরাও দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে।
বলি, নিশ্চয়ই সেই দাঁড়কাক নন আপনি; জন্ম থেকেই পেয়েছেন ময়ূরের বাহারি পেখম! তবু মিছে মায়ায় পড়ে, অন্য ময়ূরের ভাসা-ভাসা ফিকে পরিচয়ে মুগ্ধ হয়ে নিজের পরিচয়টা ভুলে যাবেন না। এই যে আমাদের একেকজনের একেক পরিচয়, এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ আমাদেরকে গুরুত্ব দেয়। আর সেই গুরুত্বই হয়তো আমাদের নিয়ে যায় পরিচয়-সংকটের দিকে। ভুলিয়ে দেয় আমরা যে মানুষ, সেই চরম সত্যটা। অথচ মানুষ পরিচয়ের চেয়ে বড় কোনো পরিচয় আমাদের নেই। পরিচয় নিয়ে এই যে সংকট, এই যে টানাহেঁচড়া, এই যে গুটিয়ে থাকা—এ থেকে একসময় আমরা নিজেকে নিয়ে যাই অন্য জগতের দিকে। যে জগৎ কেবলই অন্ধকার আর একাকী পড়ে যাওয়া কোনো অতল খাদের শূন্যতায় ঘেরা।
মানুষের মনোজগতে কলকাঠি নাড়া সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর অন্যতম হচ্ছে আইডেনটিটি ক্রাইসিস। সরল বাংলায়, পরিচয়-সংকট। এই সংকটের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। সাধারণত টিনএজে এর সূত্রপাত হলেও জীবনের যেকোনো সময়ে হানা দিতে পারে। আমি আসলে কে, কী হতে চাই, কীভাবে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরব—এসব প্রশ্নের দিশা খুঁজে না পাওয়াই আমাদের ঠেলে দেয় পরিচয়-সংকটের দিকে।
পরিচয় সন্ধান
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, আইডেনটিটি ক্রাইসিস মানে আত্মপরিচয় অর্জনে ব্যর্থতা। একে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তির সময়ও বলা যেতে পারে, যেখানে একজন ব্যক্তির পরিচয়ের অনুভূতি অনিরাপদ। এটি সাধারণত ব্যক্তির প্রত্যাশিত লক্ষ্য অথবা সামাজিক ভূমিকা পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও স্মৃতি জড়িত—যা একজন ব্যক্তির আত্মগত অনুভূতি তৈরি করে। এটি অবিচ্ছিন্ন সব চিত্র তৈরিতেও সহায়তা করে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের নতুন দিকগুলো বিকশিত বা শক্তিশালী হওয়ার পরও মোটামুটি স্থির থাকে।
জার্মান-আমেরিকান মনোবিশ্লেষক এরিক এরিকসনের মতে, একজন মানুষের আত্মপরিচয়ের অনুভূতি বিকশিত হয় তার কিশোর বয়সে। যদিও পরিচয়ের গঠন ও বৃদ্ধি শুধু কৈশোরেই সীমাবদ্ধ নয়। পরিচয় এমন একটি বিষয়, যা সারা জীবন পরিবর্তন হয়। এমনকি মানুষ যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, সেগুলোতে এটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই পরিচয়-সংকট জীবনের যেকোনো সময়, যেকোনো বয়সেই ঘটতে পারে।
তবু একটু মোটাদাগে সম্ভাব্য সময়গুলো দেখে নিতে পারি:
 বয়ঃসন্ধিকাল: সাধারণত এ সময়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি পরিচয়-সংকটে ভোগে। মূলত শারীরিক পরিবর্তনই আমাদের তখন এ নিয়ে বেশি ভাবিয়ে তোলে। নিজেকে জানতে এ সময়ে অনেকে বেছে নেয় ভুল পথ, যা পরবর্তীকালে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
 নতুন সম্পর্ক: বিয়ের পর নতুন পরিবারে প্রবেশ করেন নারীরা। মুখোমুখি হন অনেক নতুন মুখের। তাতে খাপ খাইয়ে নিতে প্রায়ই পড়তে হয় পরিচয়-সংকটে। নিজের চেনা পরিবেশটা তখন অনেক অপরিচিত মনে হয়।
 সম্পর্কচ্ছেদ: যেকোনো সম্পর্ক কিংবা বিবাহবিচ্ছেদও এই সংকটকে প্রকট করে তুলতে পারে; তা নারী-পুরুষ—উভয়ের ক্ষেত্রেই।
 সন্তান জন্মের পর: সন্তান যেকোনো মা-বাবার জীবনে অনেক বড় একটি পাওয়া। কিন্তু সন্তানের সার্বক্ষণিক যত্ন নিতে গিয়ে অনেক সময় মা-বাবা, বিশেষ করে মা তার নিজের খেয়াল রাখতে পারেন না। তাতেই এই বিড়ম্বনা হাজিরা দেওয়ার সুযোগ পায়।
 বেকারত্ব: সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পাওয়া যায় না। পেলেও তা হাতে গোনা। বেকার অবস্থায় দিন যত কাটতে থাকে, অনেকের সমালোচনা, কটূক্তি ইত্যাদি কারণে পরিচয়-সংকট তত তীব্র হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
 চাকরি পাওয়া কিংবা হারানোর পর: ‘সোনার হরিণ’ বলে বিবেচিত চাকরি যদি পাওয়াও যায়, অনেক সময় তা মনমতো হয় না। কর্মক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। তাতে মনোজগতে বাড়ে চাপ। হাজিরা দেয় পরিচয়-সংকট। আবার কোনো কারণে চাকরি গেলেও একই আপদ।
 অবসর গ্রহণের পর: জীবনের দীর্ঘ সময় কর্মব্যস্ততায় কাটানোর পর, একজন মানুষ যখন শেষ বয়সে অবসর গ্রহণ করেন, তখন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে পারে এই সংকট।
মুশকিল আসান
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক ও নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘পরিচয়-সংকটের নির্দিষ্ট কোনো দাওয়াই নেই। এর সমাধান করতে পারেন নিজেই। তবে কেউ দীর্ঘদিন এ সংকটে ভুগলে কিংবা সংকটটি চরম আকারে দেখা দিলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া শ্রেয়।’
ডা. হিমু আরও বলেন, ‘আসলে আমরা ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পরিচয় নিয়ে বড় হই। সেই স্কুলজীবন থেকে শুরু। প্রথমে বাবা-চাচা—নানাজনের পরিচয়ে। এই যে আমাদের পরিচয়, এগুলো মানুষ প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই তৈরি করে। কিন্তু এসব পরিচয় দিয়েই শুরু হয় মানুষ পরিচয় ব্যতীত অন্য পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠার ধারা। এরপর ধীরে ধীরে ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ আরও নানান পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন একেকজন ব্যক্তিমানুষ। এসব পরিচয় একসময় মানুষ পরিচয়কে আড়াল করে ফেলে। ছাত্রাবস্থায় এই পরিচয়ের ধারণা নিজেদের ভেতর একধরনের আমিত্ব তৈরি করে, যা অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা, গুরুত্বপূর্ণ আর বড় করে ভাবতে শেখায়—যা মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে হয়ে ওঠে বড় বাধা। এভাবেই তৈরি হয় শ্রেণিবিন্যাস। আর তাতে শঙ্কা থাকে শ্রেণিবৈষম্য তৈরির। মানবসমাজে শ্রেণিবৈষম্যের কারণে সৃষ্ট সমস্যার মুখোমুখি আমাদের কমবেশি সবাইকে পড়তে হয়।’
‘পেশার ভিত্তিতে মানুষের বিভিন্ন পরিচয় তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা আক্ষরিক অর্থেই পরিচয় হিসেবে থাকা জরুরি। অথচ এই পরিচয় যদি মানুষ পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখনই তা বিপত্তি বাধায়। তাই মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো পরিচয়ই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়—এই ধারণাকে আপনার ভেতর লালন করুন। এতে করে খুব সহজে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন,’ পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমুর মতে, এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনাকে পরিচয় সম্পর্কে একান্ত অনুভূতি উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শুধু উপলব্ধি করলেই চলবে না; সেগুলো স্বীকার ও ভালোভাবে গ্রহণ করাও শেখা চাই। আর নিজেকে বলুন, আপনি যা অনুভব করেন, তা সঠিক। এ ছাড়া কিছু বিষয়কে দিতে পারেন বিশেষ গুরুত্ব—
 নিজের বিশ্বাস ও আগ্রহ: নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নিজ ভাবনার প্রতিও নজর রাখুন। পাশাপাশি ভেবে বের করুন, কোন কোন বিষয়ের প্রতি কৌতূহল রয়েছে আপনার। এমন কিছু কি আছে, যা পছন্দ করেন না? এককথায়, নিজেকে নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করা, নিজ শখ ও আগ্রহগুলোর অনুসন্ধান এবং নিজেকে আরও ভালোভাবে জানাও আপনার চলার পথকে তুলনামূলক সহজ করে দেবে।
 লক্ষ্য নির্ধারণ: জানি, আপনি ব্যস্ত! তবু একটু সময় বের করুন নিজের জন্য। একান্ত ব্যক্তিগত সেই সময়ে নিজের লক্ষ্য ঠিক করুন। আপনি কী অর্জন করতে চান, কোন ধরনের কাজে আনন্দ পান—সেসব খুঁজে বের করুন। সেই সঙ্গে খুঁজে খুঁজে বের করুন, আপনার জীবনে এমন কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় আছে কি না, যা পূরণ হয়নি। সেই বিষয়টি পূরণের উপায় খুঁজুন। এতে একধরনের তৃপ্তি পাবেন। আর তা আপনাকে পরিচয়-সংকট থেকে বের করে আনতে সহায়তা করবে।
 সমর্থনে শক্তি: আমরা সমাজবদ্ধ জীব। তাই আশপাশের মানুষ, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের ওপর ভরসা রাখা জরুরি। এতে একধরনের সামাজিক সমর্থন আপনি পাবেন। এই সমর্থন আপনার মানসিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এতে আপনি নতুন উৎসাহে কাজ করতে পারবেন।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলে জীবন। এই চলার পথে আমরা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ি, কখনো কখনো আমাদের কাছে ‘মানুষ’ পরিচয়ের চেয়ে আমাদের পেশাগত, বংশগত কিংবা সামাজিক মর্যাদাগত পরিচয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হয়তো অজান্তেই মনে হয় ‘মানুষ’ হওয়া কোনো বিশেষ পরিচয় নয়! অথচ এটিই আমাদের প্রকৃত ও শেষ পরিচয় হওয়া উচিত। এভাবে ভাবতে পারলে আইডেনটিটি ক্রাইসিস কাটানো খুব একটা মুশকিল হওয়ার কথা নয়।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top