skip to Main Content

ফুডচেইন I শূন্য থেকে চূড়ায়

স্টারবাকস। আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কফি হাউস চেইন। এক স্বপ্নবাজের হাত ধরে করছে কফি-দুনিয়া শাসন

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে, আমেরিকার সিয়াটল শহরের কেন্দ্রস্থলে দারুণ এক গল্পের মঞ্চ তৈরি করেন তিন কলেজপড়ুয়া বন্ধু গর্ডন বোকার, জেভ সিগল ও জেরি বোল্ডউইন। একটি কফি কোম্পানি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কফির প্রতি তাদের, বিশেষ করে গর্ডনের ছিল ভীষণ দুর্বলতা। সুযোগ পেলেই কানাডার উপকূলীয় নগর ভ্যাঙ্কুভারে ছুটে যেতেন তিনি, কফি আনার জন্য। তার কাছে সেখানকার কফির মান বাকি সব কটির চেয়ে ভালো মনে হতো। সেই কফি বন্ধুদের ভালো লাগত। তারা তার কাছ থেকে কিনে নিতেন। এর সূত্র ধরেই ওই তিন বন্ধুর মাথায় আসে একটি কফি শপ চালুর ভাবনা। সে সময় চাহিদা থাকলেও ধারে-কাছে ভালো মানের কফি শপ সহজলভ্য ছিল না।
পিটস কফির প্রতিষ্ঠাতা এবং যুক্তরাষ্ট্রে কাস্টম রোস্টেড কফির প্রবর্তনকারী আলফ্রেড পিট সে সময় পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন গর্ডনদের সঙ্গে। তিনি ছিলেন কফি ব্যবসার একজন বিশেষজ্ঞ। এমনকি সে সময় দেশের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত বারিস্তাও ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পিটের সহায়তায় ওই তিন বন্ধু সিয়াটলের বিখ্যাত পাইক প্লেস মার্কেটে একটি কফি স্টোর ও রোস্টারি চালু করেন। নাম রাখেন স্টারবাকস। তিন-চার মাস পিটের কাছ থেকে কফি ব্যবসা শেখার পর তারা তিনজন প্রত্যেকের ১ হাজার ৩৫০ ইউএস ডলার বিনিয়োগ এবং সঙ্গে ৫ হাজার ডলার ঋণ নিয়ে এই উদ্যোগ গড়ে তোলেন। শুরুতে সেখানে রেডিমেড কফি নয়; বরং কফি বিনসহ কফি বানানোর অন্যান্য উপকরণ বিক্রি করা হতো। সেখান থেকে কফিপ্রেমীরা বিন কিনে বাসায় বানাতে পারতেন। পাশাপাশি গর্ডনরা রোস্টেড কফির পাইকারি ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় করতে থাকেন কফি সরবরাহ। ছড়াতে থাকে স্টারবাকসের ব্যবসা।
১৯৮০ সালে স্টারবাকস থেকে নিজের মালিকানার অংশ ছেড়ে দেন জেভ সিগল। এর কিছুদিন পর প্রতিষ্ঠানটি তার প্রথম ডিরেক্টর অব মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস হিসেবে নিয়োগ দেয় সেই হাওয়ার্ড শুল্টজকে, যিনি সত্যিকার অর্থেই দারুণ দক্ষ ছিলেন। প্রথম থেকেই কেন এখানে কফি বিক্রি করা হয় না, তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তও ছিলেন। এদিকে ১৯৮২ সালে মালিকানা ছেড়ে দেন গর্ডনও। শুধু রয়ে যাওয়া জেরি এ সময়ে পিটস কফিও কিনে নেন। ১৯৮৩ সালে স্টারবাকস থেকে হাওয়ার্ডকে ইতালির মিলানে পাঠানো হয় একটি ট্রেড শোতে অংশ নিতে। তিনি সেখানকার এক স্থানীয় ক্যাফেতে প্রথম পান করেছিলেন এসপ্রেসো। এ ঘটনা তার জীবন আমূল বদলে দেয়। মিলান থেকে ফিরে মালিককে ব্যবসা প্রসারের পরামর্শ দেন। কফি বিনের পাশাপাশি এসপ্রেসো বিক্রির আইডিয়াও দেন। তা জেরির মনে না ধরলেও পরীক্ষামূলক হিসেবে কফি বিনের পাশাপাশি মাত্র একটি আউটলেটে এসপ্রেসো বিক্রি শুরু করে স্টারবাকস। এত ধীরলয় নীতি ভালো লাগেনি হাওয়ার্ডের। সেই সঙ্গে এই সুবর্ণ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাননি। বলে রাখা ভালো, স্টারবাকসের লোকেশনে তখনো ক্রেতাদের বসার ব্যবস্থা ছিল না এবং হোল-ইন-দ্য-ওয়াল কফি বিক্রি করা হতো।
১৯৮৬ সালে স্টারবাকসের চাকরি ছেড়ে দেন হাওয়ার্ড। এরপর বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন নিয়ে নিজেই একটি কফি চেইন খোলেন। নাম রাখেন জিওরনেল কফি। পরের বছর অবশ্য স্টারবাকস ছেড়ে দেন জেরি বোল্ডউইনও; সিদ্ধান্ত নেন শুধুই পিটস কফি পরিচালনার। এ সময়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে স্টারবাকস কিনে নেন হাওয়ার্ড; আর জিওরনেল ও স্টারবাকসকে মার্জ করে ফেলেন। তিনি কেনার সময় স্টারবাকসের শাখা ছিল মাত্র ৬টি। আগ্রাসী নীতি অবলম্বন করে হাওয়ার্ড দুই বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির আউটলেটের সংখ্যা ৪৬টিতে উন্নীত করেন, যেখানে বার্ষিক ২ লাখ রোস্টিং কফি উৎপাদিত হচ্ছিল। ১৯৯২ সালের মধ্যে স্টারবাকসের আউটলেট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৫। সে বছর তাদের রেভিনিউ ছিল ৭৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার, যা ১৯৮৭ সালে ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির কফি শপের সংখ্যা পৌঁছায় হাজারের বেশি, যাতে জাপান ও সিঙ্গাপুরে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক দুটি শাখাও অন্তর্ভুক্ত। সেখানেই থেমে না গিয়ে, হাওয়ার্ডের আগ্রাসী ও সময়োপযোগী নেতৃত্বে স্টারবাকসের বিকাশ এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে পরবর্তী বছরের মধ্যে শাখার সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় দুই হাজার।
স্টারবাকসের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে হাওয়ার্ড বলেছেন, ‘বিনিয়োগ করার জন্য আমি যে ২৪২ জনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাদের মধ্যে ২১৭ জন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বারবার বলেছিলাম, আপনার বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্তের যে মূল্য দিতে হবে, তা হবে বেশ হতাশাজনক।’ বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে ৪ মিলিয়ন ডলার মূলধন তুলেছিলেন তিনি। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতার ব্যাপারে তার ছিল ভীষণ আত্মবিশ্বাস। নিজের পকেট থেকে মূলধনের একটি পয়সাও খরচ না করে তার আইডিয়া বাস্তবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। আর তাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিলেন সাধারণ ক্যাফেকে স্ট্যাটাস সিম্বলে রূপান্তরকারী। কোম্পানিটি ওয়াল স্ট্রিটেও তালিকাভুক্ত হয়েছিল।
নিজের টিমের প্রতি হাওয়ার্ড ছিলেন সহানুভূতিশীল। তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করতেন। তিনি তার পরিবারের আর্থিক অসুবিধার কথা স্মরণ করে এবং বাবা মারা যাওয়ার পরপরই স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে স্টারবাকস ছিল আমেরিকার প্রথম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যেটি তার সব কর্মচারী, এমনকি পার্টটাইমারদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা অফার করেছিল। বিশেষ করে খুচরা শিল্পে এই সুবিধা সেই সময় প্রচলিত ছিল না।
১৩ বছর সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব সামলিয়ে, ২০০০ সালে সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করে, এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন হাওয়ার্ড। তত দিনে স্টারবাকস ১২টির বেশি দেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কফি শপ অপারেট করছিল। ২০০০-০৭ সালের মধ্যে তাদের কফি শপের সংখ্যা পৌঁছে যায় ১৫ হাজারে। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটির গড়ে দেড় হাজারের বেশি নতুন শপ চালু হচ্ছিল। এর মধ্যে ২০০৭ সালেই চালু হয় আড়াই হাজারটি। কিন্তু সে বছরের শেষের দিকে অর্থনৈতিক ধসের মুখে পড়তে হয় স্টারবাকসকে। দ্রুতই তাদের গ্রোথ কমতে থাকে; স্টক প্রাইস নেমে যায় ৫০ শতাংশ। হাওয়ার্ড তখন সরাসরি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন না। ২০০৮ সালে কোম্পানির ক্রান্তিকালে তিনি আবার আগের দায়িত্বে ফিরে আসেন। আর এ খবরেই স্টক প্রাইস বেড়ে যায় ৯ শতাংশ। এবার তিনি দ্রুত গ্রোথ থেকে সরে এসে কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্সে জোর দেন। ২০০৮ সালে ৬০০টি এবং পরের বছর ৩০০টি শপ বন্ধ করে দেন। সঙ্গে ৬৭ জন বারিস্তাকে ছাঁটাই করেন।
এক বিকেলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের সব কফি শপ বন্ধ রেখে, সেগুলোতে কর্মরত ১ লাখ ৩৫ হাজার বারিস্তাকে নতুনভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ডেকে পাঠান; আর তাদেরকে এমন কিছু ধারণা দেন, যার ফলে কাস্টমাররা কফি শপে আসতে আরও বেশি আগ্রহী হন। হাওয়ার্ড চেয়েছিলেন কাস্টমাররা এখানে শুধু কফি পান করতে আসবেন না, বরং ভালো একটি সময় কাটিয়ে যাবেন। অনেক কফি শপেই বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন তিনি। এই উদ্যোগ স্টারবাকসের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। বারিস্তাদের তিনি শেখান, কীভাবে সিগনেচার এসপ্রেসো বানানো সম্ভব। তাতে প্রতিটি শপেই বিক্রি বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে স্টারবাকসের শেয়ার বাড়ে ১৪৩ শতাংশ। ২০০৯-১২ সময়কালে তেমন নতুন কোনো শপ চালু না করলেও ২০১২ সালের পর আগের মতো আবারও বাড়তে থাকে স্টারবাকসের বিস্তার। ২০১৭ সালে তাদের কফি শপের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ হাজারে। হাল হারানো প্রতিষ্ঠানকে আবারও চাঙা করে দিয়ে, ২০১৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেন হাওয়ার্ড। অবশ্য ২০২২ সালে আবারও সেই দায়িত্ব নিতে হয় তাকে; তবে এ বেলা অন্তর্বর্তীকালীন সিইও হিসেবে। এখনো সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি।বর্তমানে ৮০টি দেশে ৩৫ হাজার ৭১১টির বেশি স্টোর আছে স্টারবাকসের। এগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ হাজার ২৫৫টি। তাদের বেশ কিছু সিগনেচার স্টোর রয়েছে। সবচেয়ে বড় স্টোর শিকাগোতে অবস্থিত। পাঁচতলাবিশিষ্ট ওই স্টোরের আয়তন ৩৫ হাজার বর্গফুট। প্রায় ১০০০ মানুষের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই স্টোর চালু হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। এর আগে স্টারবাকসের সবচেয়ে বড় স্টোরটি ছিল জাপানের টোকিওতে, যার আয়তন ৩২ হাজার বর্গফুট। প্রতিবছর ৬ লাখ ৮০ হাজার কিলোগ্রাম কফি রোস্ট করা হয় এই প্রতিষ্ঠানে। পাওয়া যায় শতাধিক ধরনের পানীয়, যার মধ্যে ৬০টি শুধু জাপানেই মেলে। তাদের কফি চেইন এতই ইউনিক, প্রতিদ্বন্দ্বী ডাঙ্কিন ডোনাটস, টিম হোর্টন্স ও কস্তা কফির মোট আউটলেটের সংখ্যা যোগ করলেও স্টারবাকসের সমান হবে না। আনুমানিক ৩২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক রাজস্ব আয় করা এই কোম্পানির আসল কারিগর হাওয়ার্ড শুল্টজ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ ধনী। তিনি তার সকল কর্মচারীর জন্য একটি যথাযোগ্য করপোরেট কাঠামো বেছে নিয়েছেন, যা সামাজিক সমতা ও টিমওয়ার্ককে এক করেছে। সবকিছুর পরও তিনি অতীত পারিবারিক প্রেক্ষাপট আর ইতিহাস ভুলে যাননি। বাঁক নেওয়ার আগে তার জীবন যে কেটেছিল চরম দারিদ্র্য আর টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে!
 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top