skip to Main Content

মনোযতন I মন্দ কথা কথকতা

ব্যাড ওয়ার্ড সাইকোলজি। ভাষার সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতা বিনষ্টকারী দানব। ব্যক্তিত্বহানিকরও। অন্তর থেকে একে তাড়ানোর কী উপায়? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

চলতি পথে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়লেন। অমনি আপনার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো গালি! অথচ বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী—সবার কাছে খুবই নম্র-ভদ্র মানুষ হিসেবে খ্যাতি আপনার। এই যে গালি দিয়ে তৃপ্তিবোধ করলেন, এটা কি জেনে-বুঝেই করেছেন, নাকি আপনার মস্তিষ্ক কিংবা দেহের কোনো পরিবর্তনের কারণে? হয়তো আঙুল তুলে আরও পাঁচজনকে দেখিয়ে বলতে পারবেন, যাদের সবাই গালিবর্ষণে আপনার চেয়ে কয়েক কাঠি সরেস! অথবা সমাজকে অভিযুক্ত করতে পারবেন, সবাই তো গালি দেয়! কেউ বেশি, কেউ কম। আবার অতিমাত্রায় খুশি হয়ে মুখ খারাপ করা লোকের সংখ্যাও কম নয় আশপাশে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কারও কারও তো গালি ছাড়া জমেই না! এ-ও হয়তো বলবেন, সব ভাষার এবং সব সংস্কৃতির মানুষই গালি দেয়। হালে গালি দেওয়া আরও সহজ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সৌজন্যে। এসব প্ল্যাটফর্মে কথা বলতে যেহেতু ট্যাঁকের পয়সা খরচ হয় না বললেই চলে; তাই যে কাউকে হাতের আঙুলের ইশারায় কোনো কারণ ছাড়াই গালি দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। যেকোনো জনপ্রিয় ব্যক্তির ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম পেজ ঘুরে এলেই মিলবে এর সবচেয়ে কুৎসিত প্র্রমাণ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজের ফিডেও প্রমাণ হাজির। দেখবেন, কী অবলীলায় চলছে গালির মহোৎসব!
সংজ্ঞা-নির্ণয়
বলা হয়ে থাকে, যেদিন থেকে ভাষার ব্যবহার শিখেছে মানুষ, সেদিন থেকেই শুরু গালির পথ চলা! তবে গালিগালাজ ভাষানির্ভর নয়, সংস্কৃতিনির্ভর। ফলে এর প্রকার-ধরন সমাজ, স্থান ও সময়ভেদে ভিন্নতর হয়। কথায়ই তো আছে, এক স্থানের বুলি অন্য স্থানের গালি। আবার গালি বলতে যে সব সময় অশ্রাব্য শব্দ বোঝানো হয়, তা নয়। নির্ভর করে শব্দটি কীভাবে, কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। অশ্রাব্য শব্দ প্রয়োগভেদে গালি হিসেবে গণ্য না-ও হতে পারে, আবার শালীন শব্দ ব্যবহারের মারপ্যাঁচে হয়ে যেতে পারে গালি।
গালি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. এমা বার্ন তার ‘সোয়োরিং ইজ গুড ফর ইউ’ গ্রন্থে লিখেছেন, প্রকৃতপক্ষে কোন শব্দ গালি হয়ে উঠবে, তা আমরা সবাই মিলে ঠিক করলেও গালি জিনিসটি আসলে কী, সেটি যথাযথ চিহ্নিত করা যায় না। তবে গালি এমন এক ধরনের ভাষা, যা আমরা চমকিত, স্তম্ভিত কিংবা উৎফুল্ল হলে ব্যবহার করি। অথবা ব্যবহার করি মজা করার জন্য কিংবা কারও প্রতি আক্রমণাত্মক হতে। আর এটি এমন এক সাংস্কৃতিক ব্যাপার, যা শুধু একটি জনগোষ্ঠী, ভাষা, সমাজ, দেশ বা ধর্মের মধ্যেই অর্থপূর্ণ হতে পারে।
বার্ন আরও বলেন, গালি এমন এক ধরনের ভাষা, যা আপনি কিছু পরিস্থিতিতে সাধারণত ব্যবহার করবেন না। যেমন কোনো চাকরি বা একাডেমিক পরীক্ষার ইন্টারভিউতে, কিংবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে। তবে মূল কথা হচ্ছে, যে নিজের ক্ষোভ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে না, সে-ই গালিতে কাজ সারে।
কারণ সন্ধান
সাধারণত খুব চাপের মধ্যে থাকলে অথবা আকস্মিকভাবে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মতোই গালি বেরিয়ে আসে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার গালিটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে, কিছু ভাবার আগেই ঘটে যাওয়ার মতো। এতে কি লাঘব হয় যন্ত্রণা?
চরম পরিস্থিতিতে কিংবা ব্যথা সহ্য করার ক্ষেত্রে গালি দেওয়া সহায়ক কি না, তা পরীক্ষার জন্য একটি গবেষণা করা হয় এমন—বরফ ভর্তি এক বালতিতে হাত ডুবিয়ে রাখা হয় একজনের, দেখা হয় কতক্ষণ তিনি এটি সহ্য করতে পারেন। এক ব্যক্তিকে নিয়ে দুবার করা হয় পরীক্ষাটি। দেখা যায় একবার তিনি গালাগালি দিতে থাকেন। আরেকবার ভদ্র ভাষা ব্যবহার করছেন।
বিশেষজ্ঞরা দেখলেন, পরীক্ষাধীন ব্যক্তিটি যখন গালি দিচ্ছেন, তখন তিনি বেশি সময় ধরে বরফে হাত ডুবিয়ে রাখতে এবং যন্ত্রণাটি অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সহ্য করতে পারছেন। কিন্তু যখন তিনি ভদ্রস্থ বিকল্প শব্দ ব্যবহার করছেন, তখন তার সমস্যা হচ্ছে। কারণ, ওই শব্দগুলো তার আবেগের ওপর সেই প্রভাব ফেলতে পারছে না, যা গালিসূচক শব্দগুলো পারছে। কারণ, সাধারণ শব্দ ব্যবহারের তুলনায় গালি দেওয়ার সময় মানুষের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়।
তবে কি আপনি গালিতেই আশ্রয় খুঁজবেন? মোটেই না! কেননা, গালিগালাজ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সমাজে গালির ব্যবহার এবং মানুষের ওপর এর প্রভাব নিয়ে হয়েছে আরও বিস্তর গবেষণা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সে বেশ কয়েক বছর আগে একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশ পেয়েছিল। লিখেছেন মনোবিদ টিমোথি জে। শিরোনাম, ‘দ্য ইউটিলিটি অ্যান্ড ইউবিকুইটি অব ট্যাবু ওয়ার্ডস’। তাতে লেখক বলেছেন, গালি দেওয়া অনেকটা গাড়ির হর্ন বাজানোর মতো। রাগ, হতাশা, আনন্দ কিংবা বিস্ময়—এমন আবেগের তীব্রতা বোঝাতে মানুষ মুখ খারাপ করে। আবার অন্যের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যও অনেক সময় অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে মূলত অন্যের চরিত্রের ভিন্নরূপ বের করে আনার চেষ্টা থাকে।
লৈঙ্গিক পরিচয়ের প্রভাব
বাংলায় গালির লৈঙ্গিক পরিচয়ও খুব প্রভাব বিস্তারক। তা সহজে বুঝতে পারবেন এক জরিপে চোখ রাখলে। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সেটি পরিচালনা করেছিল বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। জরিপে দেখা গেছে, বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক কথা, গালি ও তিরস্কারমূলক শব্দ সাধারণত নারীকে অবমাননার জন্য ব্যবহৃত হয়। ‘সেফ সিটিজেন ফর উইমেন’ শীর্ষক ওই জরিপমতে, ৮৮ শতাংশ নারী রাস্তায় অপমানজনক মন্তব্যের মুখে পড়েন এবং ৪৬ শতাংশ নারী অপমানজনক ভাষার শিকার হন। এর প্রমাণ পেতে দূরে যেতে হবে না। আপনার জানা বা শোনা গালিগুলোর শাব্দিক বিশ্লেষণ করলেই বুঝে যাবেন—কারণে-অকারণে ‘মা’-‘বোন’কে টেনে আনা হচ্ছে।
সমাধানে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক ও নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন, রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম গালি। তাই ছোটখাটো যেকোনো বিষয়ে গালিগালাজ করে মানসিক উত্তেজনা প্রশমনের পথ খোঁজেন। তারা এটাও মনে করেন, গালি মেডিসিনের কাজ করে। কারণ হিসেবে তাদের ধারণা, রাগ বা চরম অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারলে, ফ্রয়েডীয় তত্ত্বমতে, সেগুলো অন্তস্তলের অবচেতন স্থানে জমাট হয়ে একসময় পূর্ণশক্তি সঞ্চয় করে মনের ওপর আক্রমণ করে বসবে। এতে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বলি, এ নিছক ধারণাপ্রসূত। এর সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তাই গালি থেকে বেরিয়ে আসাটা নির্ভর করবে শুধুই আপনার মানসিকতার ওপর। নিজেকে আশপাশের মানুষ ও সমাজের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করবেন, তা একান্তই আপনার বিষয়। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে এবং গালির নেতিবাচক দিক মাথায় এনে বারবার ভাবুন। আর সমাজের যাকে আপনার কাছে আদর্শ মনে হয়, মুখ দিয়ে অশ্রাব্য ভাষা উগরে দেওয়ার আগে তার কথা চিন্তা করুন। কিংবা আপনার পরম শ্রদ্ধার মানুষ যেমন বাবা-মা, শিক্ষক কিংবা একান্ত প্রিয় মানুষটিকে মনে মনে সামনে দাঁড় করান। দেখবেন গালি আসছে না। এলেও তা আস্তে আস্তে কেটে যাবে।’
তাতেও যদি কাজ না হয়, শিগগির দ্বারস্থ হওয়া চাই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top