skip to Main Content
তিন দশকে ‘রঙ বাংলাদেশ’

বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল ফ্যাশন ব্র্যান্ড জগতে পরিচিত নাম ‘রঙ বাংলাদেশ’। ৩০ বছর ধরে চলছে যাত্রা। তিন দশকে দেশের ট্রেন্ড পরিবর্তিত হয়েছে। ক্রেতা চাহিদাও বদলেছে। সে সবের বিস্তারিত জানতে আলাপ হলো কর্ণধার সৌমিক দাসের সঙ্গে:

ক্যানভাস: তিন দশকের যাত্রা এককথায় কেমন?

সৌমিক দাস: অম্লমুধর। নানা ঘাত-প্রতিঘাতও সামলাতে হয়েছে আমাদের এই কাল পরিক্রমায়। ছাত্রাবস্থায় শখের বশে শুরু হয় পথচলার।

ক্যানভাস: শুরুর গল্পটা জানতে চাই।

সৌমিক দাস: চারুকলার সৃজনশীল ছাত্রদের কাছে তখন আসত অনুষ্ঠান সজ্জার অনুরোধ। পরিচিতি ছিল ‘ক্ষ্যাপের কাজ’ হিসেবে। তো, এই ক্ষ্যাপ এক সময়ে পার্টটাইম ইনকামের একটি উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চাহিদা বাড়ে। ফরমায়েশকারী আর চারুকলার ছাত্রদের যোগাযোগ সহজ করার উদ্দেশ্যে ‘রঙ– চারু ও কারুকেন্দ্র’ যাত্রা শুরু করে । সময়, ১৯৯৪ এর ২০ ডিসেম্বর। নারায়ণগঞ্জের সান্তনা মার্কেটে ভেতরের ১০ফুট বাই ১০ফুট জায়গা। চারজন। আর্থিক পুঁজি মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা। কিন্তু শক্তিশালী বিনিয়োগ বন্ধুদের আন্তরিকতা, উৎসাহ, ভালোবাসা।

ক্যানভাস: ক্লোদিং লাইন তৈরির শুরু কীভাবে?

সৌমিক দাস: বাংলাদেশে উৎসব পুরো বছর জুড়ে কমই আয়োজন করা হয়। সারা বছর সমান ব্যস্ততা থাকে না। তাই আয়ের নতুন পথের উদ্দেশ্যে পরিচিত পরিচিত বড় বোন-ভাবীর তৈরি ও সংগ্রহ করা পোশাক সেই কেন্দ্রে আউটলেটে বিক্রয়ের চেষ্টা। এরপর ক্রমান্বয়ে নিজেদের ডিজাইনের পোশাক তৈরিতে হাতখড়ি ও নতুন নতুন সামগ্রীর সংযোজন।

‘রঙ বাংলাদেশ’। ছবি: রঙ বাংলাদেশের সৌজন্যে

ক্যানভাস: কোন পণ্য নিয়ে প্রথম দিকে কাজ করতেন?

সৌমিক দাস: টাঙ্গাইলের শাড়ির প্রতি ক্রেতার আগ্রহ ছিল। এই শাড়িগুলোর তাঁতিদের জন্যে আমরা বেইলি রোডে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একবারে অনেক বিনিয়োগ করিনি আমরা। অল্প অল্প করে শাড়ি নিতাম সপ্তাহে সপ্তাহে, বিক্রি করে আবার আনতাম। ধীরে ধীরে তাদের আস্থা অর্জিত হলো। বিশ্বাস করে আমাদের বাকিতে শাড়ি দিতে শুরু করলেন। আমাদের পথচলা সুগম হলো। ভিন্ন ধরণের রং-নকশার পোশাকের জন্যে আমাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল, এভাবেই এগিয়ে যাওয়া ।

ক্যানভাস: ফ্যাশনপ্রিয় মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল?

সৌমিক দাস: দেশের ফ্যাশনপ্রিয় মানুষের ভালোবাসাই নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যত্রও বিক্রয়কেন্দ্র বিস্তার হয়। এই জয়যাত্রায় ধীরে ধীরে অনন্য ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পায় ‘রঙ’। ফ্যাশনশিল্পে দেশীয় উৎসবগুলোর গুরুত্ব নাগরিক জীবনে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত করতে যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মুখ্য ভুমিকা রেখেছে, তার অন্যতম পথিকৃৎ ‘রঙ’। নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক সামগ্রীর নানা প্রদর্শনী আয়োজনের পাশাপাশি ২০১০ সালে ‘রঙধনু’ শিরোনামে অনন্য প্রদর্শনী আয়োজন করে বিপুল সুনাম করেছিল ‘রঙ’।

ক্যানভাস: ‘রঙ বাংলাদেশ’ নিয়ে কীভাবে এগোলেন?

সৌমিক দাস: সময়ের চাহিদায় প্রতিষ্ঠানের কান্ডারিরা হাঁটেন ভিন্ন পথে। ‘রঙ’ থেকে ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর পতাকা হাতে পথ হাঁটি আমি। ঠিক ৮ বছর আগে। ২০১৫ সালে। ছন্দপতনের বিহ্বলতা কাটিয়ে, সূচনা দিনের প্রত্যয়ে ‘রঙ বাংলাদেশ’ এগিয়েছে। অবশ্য সেটা সম্ভব হয়েছে দেশ-বিদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ‘রঙ’ অনুরাগীদের সমর্থনে। চলমানতার আঙ্গিক পরিবর্তন সত্ত্বেও লক্ষ্যে অবিচল থেকে এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টায় নতুন করে বিকশিত হয়েছে ‘রঙ বাংলাদেশ’। অপরিসীম উৎসাহ, উদ্দীপনার সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে এগিয়েছে ‘রঙ বাংলাদেশ’।

সৌমিক দাস। ছবি: রঙ বাংলাদেশের সৌজন্যে

ক্যানভাস: কেমন আছে ‘রঙ বাংলাদেশ’ পরিবার?

সৌমিক দাস: সময়ের সঙ্গে বড় হয়েছে ‘রঙ বাংলাদেশ’ পরিবার। ফ্যাশন অনুরাগীদের ভালোবাসায় শাখা ছড়িয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর একটি শক্তিশালী টিম, ফ্যাশনের এই কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিচ্ছে। দেশীয় ফ্যাশন শিল্পের অন্যতম এই ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে। ফলে ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর অনুরাগীরা হাতের নাগালেই পাচ্ছেন প্রিয় ব্র্যান্ডের পোশাক ও সামগ্রী। সমান্তরালে ডিজিটাল উৎকর্ষের সঙ্গে তালমিলিয়ে গড়ে উঠেছে ‘রঙ বাংলাদেশ’ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, নিজস্ব ই-কমার্স সাইট ও ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যম। ফলে দেশ-বিদেশের ক্রেতারা বাসায় বসেই পাচ্ছেন সকল সামগ্রী।

ক্যানভাস: আপনারা মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তনকে কীভাবে আপনাদের পণ্যের সঙ্গে একাত্ম করেছেন?

সৌমিক দাস: মানুষের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, ফ্যাশন সবই পরস্পরের পরিপূরক-সম্পর্কযুক্ত। পণ্য যেমন জীবনযাপনে প্রভাব ফেলে, তেমনি জীবনযাপনের প্রয়োজনে পণ্যের তারতম্য, পণ্যের পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটে। তিন দশকের অভিযাত্রায় জীবনযাপনের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক ফ্যাশন ভাবনায়ও পরিবর্তন এসেছে নিয়মিত। প্রথম থেকেই সময়কে রাঙানোর ব্রতে দেশীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় আমরা পণ্য তৈরি করে আসছি। এক যুগেরও বেশি লেগেছে আমাদের প্রসার হয়ে থিতু হতে, বাংলাদেশের মানুষের ফ্যাশন ভাবনায় মণিকোঠায় স্থান করে নিতে।

দীর্ঘ এই সময়ে অভিজ্ঞতায় ধীরে ধীরে জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আমাদের পণ্যের পরিধি বেড়েছে, নানা ধরনের নতুন নতুন প্রোডাক্ট-লাইন যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে জীবনযাপনের পরিবর্তনের প্রতি আরও মনোনিবেশ করতে বয়স, থিমভিত্তিক ভাবনায় মূল মাদারব্র্যান্ড ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে আলাদা হিসেবে আরও চারটি সাব-ব্র্যান্ড চালু করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠদের জন্য ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’, তরুণদের জন্য ‘ওয়েস্টরঙ’, ছোটদের জন্য ‘রঙ জুনিয়র’ আর বাংলাদেশকে দেশ এবং দেশের বাইরে পরিচিত করাতে আছে ‘আমার বাংলাদেশ’।

এই ব্র্যান্ড মূলত: বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা পোশাক, উপহার সামগ্রী বা স্মারক উপহারের– যাতে করে এর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় এক টুকরো বাংলাদেশ। তাই আলাদা আলাদা মানুষের জীবনযাপনের প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই সামগ্রী তৈরিতে ও ভোক্তার কেনার জন্য বাছাই অনেক সহজ হয়ে গেছে ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর পণ্যে।

ক্যানভাস: তিন দশকে ফ্যাশনে পরিবর্তনের কি আপনাদের নকশায় প্রভাব ফেলেছে?

সৌমিক দাস: ফ্যাশনের পরিবর্তন আর নকশায় এর প্রতিফলন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, সব সময় হালনাগাদ থাকতেই হয়। আমরাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছি নকশার উৎকর্ষে, কাজের মাধ্যমে, উপকরণের পরিবর্তনে। নামেই যার পরিচয়, ‘রঙ বাংলাদেশ’ নকশায় রঙের বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। নান্দনিক উজ্জ্বল রং, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নকশার স্বাতন্ত্র্য, আধুনিকতার সংযোগ, বয়স ও বিষয়ভিত্তিক প্রোডাক্টলাইন ‘রঙ বাংলাদেশ’কে অনন্য বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে।

আধুনিক এই ডিজিটাল সময়ে পুরো পৃথিবীর ফ্যাশন এখন হাতের মুঠোয়। তাই পরিবর্তনের ধারাও আমাদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলে বেশ দ্রুত। ঐতিহ্যগত নকশার সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে পণ্যের নকশার প্রেরণায় যোগ হয় নানা মাত্রা । সকল দেশীয় উৎসবে থিমভিত্তিক সামগ্রী তৈরির অনন্য ধারণা প্রচলনে পথপ্রদর্শক এই প্রতিষ্ঠান। ‘রঙ বাংলাদেশ’ বরাবরই থিম নির্ভর কাজ করে থাকে; তা সে উৎসবই হোক বা উপলক্ষ্য। সেই ধারা অব্যাহত রেখেই এগিয়ে চলেছে।

‘রঙ বাংলাদেশ’। ছবি: রঙ বাংলাদেশের সৌজন্যে

ক্যানভাস: বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এমন কোন কোন থিম নিয়ে কাজ করেছেন?

সৌমিক দাস: ২০১৫ সাল থেকে ইতোমধ্যে হায়া সোফিয়া মসজিদ, ইন্দোনেশিয়ান বাটিক, কাঠখোদাই নকশা ,বাংলার এতিহ্যবাহী গয়না, শিল্পী যামিনী রায়ের চিত্রকলা, নকশি কাঁথা, ইবান টেক্সটাইল, আফ্রিকান মাড হাউস, ইসলামিক নকশা, শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রকলা, সন্দেশের ছাঁচ, জ্যামিতিক নকশা, ইসলামিক নকশা, ফ্লোরাল মোটিফ, শীতলপাটি, সাঁওতালদের দেয়ালচিত্র, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল, চাকমা সম্প্রদায়ের আলাম, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর রেখাচিত্র, মান্ডালা, ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল, রাজস্থানী ডিজাইন, মোগল আর্ট, কাতান, টাইলস, শতরঞ্জি, মধুবনী, সুজনী সেলাই, আলপনা, কলমকারী, কারপেট, ট্রাক আর্ট, অরিয়েন্টাল রাগ, পূজার ফুল, পাখির রং থিম নিয়ে প্রোডাক্ট লাইন তৈরি করেছে ‘রঙ বাংলাদেশ’।

ক্যানভাস: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।

সৌমিক দাস: ২৯ বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে সমুন্নত রেখে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘রঙ বাংলাদেশ’ সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে দুর্দান্ত টিমওয়ার্কে সৃজনশীল ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি এটি জয় করেছে শুভানুধ্যায়ীদের আস্থা। ভবিষ্যতেও দেশজ উপকরণ, উজ্জ্বল রং আর বিষয়ভিত্তিক নকশা বিন্যাসের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পোশাকে ধরে রাখায় চেষ্টায় ত্রুটি থাকবে না; বরং ‘রঙ বাংলাদেশ’ এর পণ্যকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব টেকসই ফ্যাশন ও পুনর্ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়েই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়াসী।

সময় আমরা রাঙিয়ে চলেছি সূচনা-প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে। ‘রঙ বাংলাদেশ’ একান্তভাবে বিশ্বাস করে যাদের নিয়ে এবং যাদের জন্য এই সৃষ্টিযজ্ঞ, তারা সব সময়ের মতোই সাথী হবেন। সব সময়ে তাদের যে সমর্থন মিলেছে, তাতে ‘রঙ বাংলাদেশ’ অভিভূত ও কৃতজ্ঞ। অতএব সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই টিকে থাকবে ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর লেগাসি।

  • সারাহ্ দীনা/ ক্যানভাস অনলাইন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top