ফিচার I গালিবের শহর কলকাতা
কলকাতায় এসেছিলেন মির্জা গালিব। বেড়াতে নয়, অর্থের প্রয়োজনেই। কিন্তু বিফল হয়েছিলেন। অধিকন্তু, লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল। লিখেছেন অতনু সিংহ
‘সে এলো আমার ঘরে, আহা পরমের একি লীলা/ আমি একবার তাকাই ঘরের দিকে আর একবার তাঁর দিকে!’
পুরোনো দিল্লি থেকে পুরোনো কলকাতার দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। তখন চলাচল ছিল স্থলপথে হেঁটে, ঘোড়ার পিঠে, পালকিতে আর জলপথে নৌকা কিংবা জাহাজে। বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সীমিতসংখ্যক লোকই সুদূর দিল্লি থেকে বাংলার কলকাতায় যাতায়াত করতেন। বিশেষত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। রাজকার্যের লোকজন আর কিছু ব্যবসায়ীরও যাতায়াত ছিল। তো নানা প্রতিকূলতা পার করে একদিন কলকাতায় এলেন উপমহাদেশের উর্দু ও ফার্সি কবিতার (শায়েরি) সম্রাট মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ, যাঁর ডাকনাম গালিব। যেভাবে বহু পথ অতিক্রম করে একদা তাঁর পিতামহ কাউকান বেগ খাঁকে তুরস্ক থেকে ভারতবর্ষে পা রাখতে হয়েছিল। রাজস্থানের জয়পুর, পাঞ্জাব ও আগ্রায় ছিল তাঁদের বসবাস। গালিবের জন্ম আগ্রায়। কিন্তু বিয়ের পর তিনি দিল্লিতে চলে আসেন। সেখানেই তাঁর শায়েরি ভুবন। পুরোনো দিল্লির আলো-আঁধারিতে আজও সেই সব শায়েরির শব্দ ধ্বনি তোলে, আজও কিয়ারোস্কিউরোয় বিভাজিত আলো খেলা করে উর্দুকাব্যের স্মৃতির মতোই, গালিব হেঁটে চলেন চাঁদনী চকের অলিগলিতে। এই দিল্লি যাপনের মধ্যেই তাঁর জীবনে একবার খুলে গিয়েছিল পুবের উঠোন। ভারতবর্ষের পূর্বদিকে ভাগীরথী নদীর গা ঘেঁষে মাথা তুলে দাঁড়ানো কলকাতা শহরে তিনি যাপন করেছিলেন বেশ কিছুটা সময়।
এটা ঠিক, ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখার জন্য কলকাতায় আসেননি। তখন কলকাতা এক প্রিমিটিভ মায়ানগর, যা শ্বেতাঙ্গদের উদ্যোগে গড়ে উঠলেও, ক্রমে তা দেশীয়দেরই নয়া-আস্তানা হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, কাব্য, গান, চারুকলা চর্চার মতো সামগ্রিক বৌদ্ধিক চর্চার স্থান। এহেন কলকাতায় এলেন মির্জা গালিব। অবশ্য এই আগমন কোনো শৌখিন পর্যটনের কারণে নয়, তিনি কলকাতায় এসেছিলেন নেহাত দায়ে পড়েই।
তখন ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী ছিল কলকাতা। গালিবের প্রাপ্য পেনশনের টাকা একসময় বন্ধ করে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্যই কলকাতায় আগমন ঘটেছিল কবির। ছিলেন প্রায় দেড় বছর। ১৮২৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতায় পা রাখেন। নেহাত অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কলকাতায় এলেও কলকাতা তথা বাংলার প্রেমে পড়েছিলেন গালিব। তাঁর চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, তিনি থাকতেন সিমুলিয়া বাজারের কাছে, আজকে যেটা উত্তর কলকাতার সিমলা। বারবার সিমলা বাজার, গোল তালাও, চিৎপুর বাজারের কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষকদের বক্তব্য, আজকের ১৩৩ নম্বর রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের বাড়িটিতেই থাকতেন গালিব। বাড়িটি রামদুলাল সরকার স্ট্রিট আর বেথুন রো’-এর সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর একটু পাশেই আজকের হেদুয়া পার্ক ও সুইমিংপুল। অদূরে বিখ্যাত নকুড়ের সন্দেশের দোকান।
গালিবের কলকাতা আগমনের কারণ ও প্রেক্ষিত কিঞ্চিৎ জটিল। তাঁর পিতামহ তুরস্ক থেকে যখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন, তখন দিল্লির মসনদে মোহাম্মদ শাহ। বিভিন্ন সময়ে নানা আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় শাসকের হয়ে সামরিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন কাউকান বেগ খাঁ। তাঁর দুই পুত্র আবদুল্লাহ বেগ খান এবং নসরুল্লাহ বেগ খানও পৈতৃক পেশা অনুসরণ করে সৈনিকের জীবিকা গ্রহণ করেন। গালিবের বাবা আবদুল্লাহ বেগ খাঁ প্রথমে লক্ষ্ণৌর নবাব আসফ-উদ-দৌলার রাজত্বে সামরিক চাকরিতে যোগদান করেন। পরে পাড়ি দেন হায়দরাবাদে। আলওয়ারে তৃতীয় চাকরির সময় একটি যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তখন গালিবের বয়স পাঁচ।
গালিবের মা, আরেক ভাই ও এক বোনের দায়িত্ব নেন চাচা নসরুল্লাহ বেগ। আগ্রায় ছিল তাঁর বাসস্থান। তিনি আগ্রার সুবেদার, মারাঠাদের খুব বিশ্বস্ত সৈনিক। কিন্তু চাচার মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দেয়। একদিন তিনি ফিরিঙ্গিদের পক্ষ অবলম্বন করেন। চাচার অভিভাবকত্বে গালিবদের সংসার ভালোই অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু হাতির পিঠ থেকে পড়ে নসরুল্লাহর মৃত্যু হয়। গালিবদের পরিবার এবং চাচার পরিবারে নেমে আসে আর্থিক বিপর্যয়। গালিবের পিতামহের ছিল এক জায়গির। এখান থেকে বছরে এক লাখ টাকা রোজগার হতো তাঁদের। কিন্তু গালিবের বাবা ও চাচার মৃত্যুর পর ওই জায়গির অধিগ্রহণ করেন লর্ড লেক। এর বদলে গালিবদের বছরে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। (একে পেনশন বলা হতো। মাসোহারাও বলা হয়) ওই টাকা চাচার পরিবারের সঙ্গে সমান দুই ভাগে ভাগ করে নিতেন গালিবরা। কিন্তু ক্রমে এই অর্থের পরিমাণ বার্ষিক ৩ হাজার টাকায় নেমে আসে। গালিবরা নিজস্ব ভাগে পেতেন বার্ষিক ৭৫০ টাকা। এই টাকাও বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রাপ্যের জন্য গালিব দিল্লির রেসিডেন্টের দ্বারস্থ হলেন, লাভ হলো না। গেলেন ফিরোজপুর, লক্ষ্ণৌ। সেখান থেকে বারানসি, পাটনা হয়ে এলেন বাংলায়। দরবার করলেন মুর্শিদাবাদে। তখন মুর্শিদাবাদের নবাব হুমায়ুনজাহ (যিনি হাজারদুয়ারি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন)। পেনশনের জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজধানী কলকাতায় এলেন গালিব।
কলকাতার উর্দু কবি মহলের সঙ্গে কাব্য, ধর্ম ও সমাজসংক্রান্ত বিষয়ে চালিয়েছেন বাহাস। কবিতাও লিখেছেন এই শহরকে নিয়ে। ঘুরে বেড়িয়েছেন রাস্তায় রাস্তায়। কলকাতায় থাকার সময় মৌলালীর দরগা আর কাঠবাগান মসজিদে যেতেন। ক্যালকাটা মাদ্রাসা কলেজেও (আজকে যেটা আলিয়া মাদ্রাসা বা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস) গিয়েছেন। গালিব নিয়মিত নকুড়ের মিষ্টি খেতেন। কলকাতায় থাকার সময় কবির সঙ্গে দেখা হয় রাজা রামমোহন রায়ের। দুজনের নাকি বেশ আড্ডাও হয়েছে কয়েকবার। এমনকি রাধাকান্ত দেবের সঙ্গেও গালিবের মোলাকাত হয়েছে।
একদিন গালিবকে একটি মুশায়েরায় আমন্ত্রণ জানানো হলো। তালতলায় ওই মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার ক্যাম্পাসে। সেখানে তখন পড়ানো হতো গণিত, দর্শন ও তর্কবিদ্যা। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠও শুরু হয়েছে ব্রেটন সাহেবের উদ্যোগে। তো ওইখানে মুশায়েরায় গালিব পাঠ করলেন ফার্সি ও উর্দু বচনে বেশ কিছু ‘শের’। সেগুলোর একটি ‘শের’ নিয়ে আপত্তি জানালেন মির্জা কাতিলের শিষ্যরা। গালিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, গালিব ফার্সি ব্যাকরণ জানেন না! হাফিজের কবিতা উদ্ধৃত করে গালিব দেখাতে চাইলেন, তিনি যেভাবে ভাষার কাব্যিক প্রয়োগ করেছেন, তাতে ব্যাকরণ অশুদ্ধ হয়নি; ঠিক একইভাবে হাফিজের কবিতাতেও ব্যাকরণ উঠে এসেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন, কে বড় কবি— হাফিজ, নাকি মির্জা কাতিল? মির্জা কাতিলের লেখা পড়ে যারা ফার্সি ভাষা শিখে গালিবকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের দিকেই গালিব এই প্রশ্নটা ছুড়লেন। আরও বললেন, ‘ফার্সি ভাষা হলো আমির খসরু, শিরাজি ও ইস্পাহানিদের মাদার-ই-জুবান (মাতৃভাষা)। আমি তাঁদের লেখা পড়ে ব্যাকরণ শিখেছি।’ কিন্তু মির্জা কাতিলের অনুরাগীদের অভিযোগ তাতেও প্রশমিত হলো না। তাদের মতে, গালিব ফার্সি ভাষাকে অপমান করেছেন, তাঁর মুন্ডুপাত করা উচিত। পরিস্থিতিকে কোনোভাবে মোকাবিলা করে সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন। কিন্তু কলকাতার উর্দু ও ফার্সি কবিতার বৃত্তে গালিবের নামে কুৎসা শুরু হলো। পোস্টার লাগানো হলো তাঁর বিরুদ্ধে। গালিবের মন ভারাক্রান্ত হলো কলকাতার এই চেহারা দেখে। যদিও তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বোঝালেন যে আসলে তাঁর প্রতিভা আর পান্ডিত্যের কারণে ঈর্ষার আগুনে জ্বলছে কলকাতার মধ্য মেধার উর্দু-ফার্সি কবিসমাজ।
না, কলকাতা থেকে গালিব পেনশন উদ্ধার করতে পারেননি। উপরন্তু তাঁর কপালে জুটেছিল লাঞ্ছনা! বিষাদগ্রস্ত গালিব ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। কলকাতার প্রতি তাঁর ভালোবাসার পরিণামে পাওয়া লাঞ্ছনার জবাবে তিনি লিখেছিলেন, ‘কলকাত্তা কা জো জিকর কিয়া তুনে হাম নসিন/ এক তির সিনে মে মারা কি হায় হায়।’ যার বাংলা অর্থ, কলকাতার নাম শুনেই যেন আমার বুকে তির বিঁধেছে! কবিদের জীবন এমনই। তাঁরা যখন অতীত হয়ে যান, বর্তমান তখন স্তুতিবাক্য পেশ করে তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে, কিন্তু কবিদের জীবিতাবস্থার যাপন এমনই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-তিরস্কার আর গলাধাক্কা খাওয়ার মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে দুর্বহ। যেভাবে গালিব উপমহাদেশের এক শহর থেকে অন্য শহরে এসেছিলেন আর্থিক প্রয়োজনে, পরে ওই শহরকেই আপন করে নিয়েছিলেন, ওই শহরের মানুষের সঙ্গে, শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে, দিনযাপনের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন, গলাধাক্কা খেয়েছেন; সেভাবেই একদিন বরিশাল থেকে জীবনানন্দ কলকাতায় যান, অসামান্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েও আজ গালিবকে নিয়ে আমরা কতই না মাতামাতি করি, গালিবের নামে কলকাতার রাস্তার নাম জ্বলজ্বল করে। একদার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের নাম বদলে মির্জা গালিবের নামে করা হয়েছে। আজকের এই মির্জা গালিব স্ট্রিটের অদূরেই তালতলায় একদিন গালিবের মুন্ডুপাত করতে চেয়েছিল নির্বোধের দল।
ছবি: তানিয়া সরকার ও ইন্টারনেট